গত রাতটা দারুণ আনন্দে কেটেছে তহুরা খাতুনের। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের ৩-১ গোলের দুর্দান্ত জয়ে তাঁর গোল দুটি। ডিফেন্ডার আফঈদা খন্দকারের গোলের পর দলের দ্বিতীয় ও তৃতীয় গোল তহুরার। কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালায় ৪২ মিনিটেই ৩-০ করে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ হাতের মুঠোয় নেয় বাংলাদেশ। তাতে বড় অবদান রাখতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছেন তহুরা। দলকে গ্রুপসেরা করে নিয়ে গেছেন সাফের সেমিফাইনালেও।
কিন্তু মনের মধ্যে কোথায় যেন দুঃখবোধ রয়ে গেছে তহুরার। অকালপ্রয়াত বন্ধু সাবিনা ইয়াসমিনকে ভুলতে পারছেন না। ভারতের বিপক্ষে গোল করেই প্রয়াত বন্ধুকে মনে পড়েছে তাঁর।
সাবিনার কথা মনে পড়লে আজও কান্না আসে। কিছুতেই ওকে ভুলতে পারি না। ম্যাচটা উৎসর্গ করেছি ওকেই। গোল দুটিও, পুরস্কারও।প্রয়াত বন্ধু সাবিনাকে স্মরণ করে তহুরা
ময়মনসিংহের কলসিন্দুরে দুজনের বাড়ি কাছাকাছি। ৫-৬ মিনিটের পথ। সাবিনা ও তহুরা ছিলেন হরিহর আত্মা। ২০১৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন সাবিনা। সে সময় বাফুফের অনূর্ধ্ব-১৪ দলের ক্যাম্পে ছিলেন সাবিনা ও তহুরা। ছুটিতে বাড়ি গিয়ে সাবিনা জ্বরে আক্রান্ত হন। ছুটি শেষে ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসার কথা থাকলেও আগেরই দিন মারা যান সাবিনা। বন্ধু চলে যাওয়ার ৭ বছর হলেও একমুহূর্তের জন্যও তাঁকে ভুলতে পারেননি তহুরা।
প্রায় রাতেই বন্ধুর জন্য নীরবে কাঁদেন। বন্ধুকেই কাল ম্যাচসেরার পুরস্কার উৎসর্গ করেছেন তহুরা। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন ২৫ হাজার নেপালি রুপি। জাতীয় দলের হয়ে এই প্রথম ম্যাচসেরা হলেও বন্ধুকে হারানোর হাহাকারে কণ্ঠটা ধরে আসে তাঁর, ‘সাবিনার কথা মনে পড়লে আজও কান্না আসে। কিছুতেই ওকে ভুলতে পারি না। ম্যাচটা উৎসর্গ করেছি ওকেই। গোল দুটিও, পুরস্কারও। ওদের পরিবারের সঙ্গে এখনো সম্পর্ক আছে আমার। বাড়ি থেকে আমার কাছে ফোন না এলেও সাবিনার মা কিন্তু ফোন করেন সব সময়।’
বন্ধুর অকালমৃত্যর শোক প্রেরণা হয়েও ধরা দিয়েছে তহুরার কাছে। নিজেই তা বললেন, ‘ও আমার ছোটবেলার ভালো বন্ধু। বঙ্গমাতা, আন্তস্কুল পর্যায়ে একসঙ্গে খেলেছি আমরা। ও মারা যাওয়ার পর অনেক সময় একা থাকতাম, ফুটবল ছেড়ে দেব ভাবতাম। কিন্তু ছাড়িনি। ওর কথা মনে হলে ভাবি আমি খেলে যাব।’
রোদ, বৃষ্টি যা–ই হোক, আমি বিলে যেতাম। কেউ বিলে নেই কিন্তু আমি আছি। একা একা হলেও বিলে যেতাম। কেউ মাছ ধরতে পারেনি কিন্তু আমি ধরে আনতাম। এটা আমার আম্মা এখনো সবাইকে বলেশৈশব নিয়ে তহুরা খাতুন
পরিবার অবশ্য কিছুটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তহুরার সামনে। তবু ফুটবলেই আছেন, আলো কাড়ছেন। তাঁর নিজের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের জার্সিতে ৫২টি গোল করে ফেলেছেন। এর মধ্যে সিনিয়র জাতীয় দলের হয়ে ৯টি। বাকি সব গোল বয়সভিত্তিক ফুটবলে। গত বছর ১ ও ৪ ডিসেম্বর ঢাকার কমলাপুর স্টেডিয়ামে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে দুটি ফিফা প্রীতি ম্যাচে ৪ গোল করেন তহুরা। বাংলাদেশ জেতে ৩-০ ও ৮-০ গোলে। অথচ নানা হতাশায় গত বছর জুনে বাফুফের ক্যাম্প ছেড়ে তহুরা বাড়ি চলে যান। সব হতাশা দূর করে ফিরেছেন ফুটবল মাঠে। তহুরা–ফুল অকালে যে শুকিয়ে যায়নি, গতকাল কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে তা আবার দেখা গেল।
পাকিস্তান ম্যাচে ভালো করতে না পারায় তহুরার মনে হতাশা ছিল। ২০ অক্টোবর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ম্যাচে ঋতুপর্ণা চাকমা অনেকগুলো ক্রস দিলেও গোলের দেখা পাননি এই স্ট্রাইকার। তা নিয়ে মনে কষ্ট আছে তাঁর, ‘ওই ম্যাচে মিস করেছি। তাই মনে কষ্ট ছিল। সবার মধ্যে চেষ্টা ছিল যেভাবেই হোক ভারতকে হারাতেই হবে বা ড্র। সব মিলিয়ে আমি খুব খুশি যে ভারতের বিপক্ষে দুটি গোল করতে পারছি।’
পাকিস্তান ম্যাচ শেষে মনিকা চাকমা বলেছিলেন, কোচ সিনিয়রদের পছন্দই করেন না। তাঁদের বসিয়ে রাখেন। এই ব্যাপারটা দলে কতটা প্রভাব রেখেছে, জানতে চাইলে তহুরা তা এড়িয়ে যান, ‘এগুলো মাথায় নিতে চাই না। যা হওয়ার হয়েছে, এগুলো নিয়ে কথা বলতে চাই না।’
নেপালে আসার প্রথম স্মৃতিটা আজীবন মনে রাখবেন তহুরা। ঢাকার হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে গিয়ে জীবনে প্রথম লিফট দেখেন। কিন্তু সে সময় তিনি লিফটে উঠবেনই না! অন্যরা সব উঠে ওপরে চলে গেলেও তহুরা খাতুন লিফটের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তহুরার বাবা ফিরোজ মিয়া চাষাবাদ করতেন নিজস্ব জমিতে, এখন সেভাবে করেন না। মা সাবেকুন নাহার গৃহিণী। পাঁচ বোন, এক ভাই। সবার বড় বোন, তারপর ভাই, তৃতীয় তহুরা। ২০১৫ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে ঢাকায় বাফুফের ক্যাম্পে আসার আগে তাঁর জীবনটা ছিল শৈশবের চঞ্চলতায় ভরপুর। বাড়ির পাশে পুকুর আর বিলেও যেতেন মাছ ধরার নেশায়। ‘রোদ, বৃষ্টি যা–ই হোক, আমি বিলে যেতাম। কেউ বিলে নেই কিন্তু আমি আছি। একা একা হলেও বিলে যেতাম। কেউ মাছ ধরতে পারেনি কিন্তু আমি ধরে আনতাম। এটা আমার আম্মা এখনো সবাইকে বলে’—বলে যান বাংলাদেশের নারী ফুটবলের ‘মেসি’।
মানুষ দেখলে আমাদের দৌড়ানি দিত। মানুষের টিনের চালে ঢিল মারতাম। আমি আর ছোট শামসুন্নাহার পুকুরের পাড় থেকে গাছে ঢিল মেরে বরই পাড়তাম। শামসুন্নাহার, সাবিনা দেখত। সেই দিনগুলো ছিল অনেক আনন্দের।তহুরা খাতুন
তারপর যোগ করেন, ‘ঈদের দিনও আমি মাছ ধরতে গেছি। বাড়িতে এসে বকা শুনেছি। সব ছেলেমেয়ে ঈদের দিন নতুন জামাকাপড় পরে ঘুরছে আর আমি মাছ ধরছি! আসলে মাছ ধরে আমার সঙ্গে কেউ পারত না। এখনো বাড়ি গেলে মাছ ধরি। কখনো জাল দিয়ে, কখনো হাত দিয়ে। আমি পাখিও মারতাম। সবাই মজা করে বলত, পাখি মারি বলে আমার স্বাস্থ্য কম।’
প্রথম বিদেশ যাওয়ার সুযোগ হয়েছে ২০১৫ সালের এপ্রিলে। এই কাঠমান্ডুতেই সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী টুর্নামেন্টে। নেপালে আসার প্রথম স্মৃতিটা আজীবন মনে রাখবেন তহুরা। ঢাকার হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে গিয়ে জীবনে প্রথম লিফট দেখেন। কিন্তু সে সময় তিনি লিফটে উঠবেনই না! অন্যরা সব উঠে ওপরে চলে গেলেও তহুরা খাতুন লিফটের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ‘জীবনে প্রথমবার লিফটে উঠব কীভাবে, সাহস পাচ্ছিলাম না। কী করব, কী করব। ভয় লাগছিল। সঙ্গে ছিল তাসলিমা নাসরিন, আমার এলাকার মেয়ে। আমাদের দলেরই খেলোয়াড়। সে জোর করে ওঠায় আমাকে লিফটে। স্যাররা এটা দেখে হাসেন’—সহজ-সরল তহুরা বলে যান একনিশ্বাসে।
তহুরার এলাকা থেকেই উঠে এসেছেন জাতীয় দলের দুই শামসুন্নাহার। তাঁরা ভালো বন্ধু। স্কুলে যাওয়ার সময় চারজন জাম পাড়তে পাড়তে যেতেন। আসার সময়ও জাম পাড়তেন। তহুরা ডুব দেন সেই সময়ে, ‘মানুষ দেখলে আমাদের দৌড়ানি দিত। মানুষের টিনের চালে ঢিল মারতাম। আমি আর ছোট শামসুন্নাহার পুকুরের পাড় থেকে গাছে ঢিল মেরে বরই পাড়তাম। শামসুন্নাহার, সাবিনা দেখত। সেই দিনগুলো ছিল অনেক আনন্দের।’
তহুরা দিনে দিনে নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ভোলেননি নিজের গ্রাম, পুকুর, বিল, মাছ ধরা আর অবশ্যই অকালপ্রয়াত বন্ধু সাবিনাকে।