পাইওনিয়ার ফুটবল লিগ
আরও মনোযোগ দরকার, আরও যত্ন
বাংলাদেশের ফুটবলের সূতিকাগার বলা যেতে পারে পাইওনিয়ার ফুটবল লিগকে। কিশোর ফুটবলারদের এই লিগের সর্বশেষ আসর শেষ হয়েছে ৮ জুলাই। অতীতে অনেক খেলোয়াড় বেরিয়ে এসেছে তৃণমূল পর্যায়ের এই ফুটবল প্রতিযোগিতা থেকে। পাইওনিয়ার লিগের অতীত–বর্তমান ও এবারের প্রতিযোগিতার নানা দিক নিয়ে এক পৃষ্ঠার এই বিশেষ আয়োজন
জাতীয় দল ক্রমাগত ডুবছে। ২০০৩ সালের পর আর কোনো বড় ট্রফি আসেনি দেশের ফুটবলে। আগের চারটি সাফ ফুটবলেরই গ্রুপ পর্বে আটকে গেছেন জামাল ভূঁইয়ারা। পেছাতে পেছাতে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ এখন ১৯২, একসময় বাংলাদেশের কাছে নিয়মিত হারা ভুটান যেখানে ১৮৬।
তৃণমূল পর্যায়ের করুণ অবস্থাই এই দুর্দশার বড় কারণ। তৃণমূলে শক্তিশালী কাঠামো গড়ে ওঠেনি আজও, যেটুকু ছিল, সেটাও হয়ে পড়েছে অনেকটা নড়বড়ে। কিশোরদের নিয়ে আয়োজিত পাইওনিয়ার লিগ থেকে একসময় মোনেম মুন্না, আরমান মিয়া, জুয়েল রানাদের মতো ফুটবলার বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু আগের মতো আর খেলোয়াড় উঠে আসছে না এই লিগ থেকে। যার পরিণামে জাতীয় দল ধুঁকছে।
শক্তিশালী জাতীয় দল গড়তে যেতে হবে তৃণমূলেই, যার শিকড় এই পাইওনিয়ার লিগ। ঢাকার আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ১৯৮০ সালের ২৯ এপ্রিল যে লিগের শুরু। প্রথমবার বাছাইপর্বে অংশ নিয়েছিল ১৬০টি দল। যেখান থেকে ৮০টি দল সুযোগ পায় চূড়ান্ত পর্বে। কিন্তু সেবার কোনো চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দল নির্ধারণ না করায় সে টুর্নামেন্ট নথিবদ্ধ হয়নি। পরের বছর আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু পাইওনিয়ার লিগ। প্রথমবার উদ্বোধন করেন তৎকালীন জাতীয় সংসদের স্পিকার শামসুল হুদা চৌধুরী।
এক বছর পরই ১৯৮৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বিরাট চমক, ঢাকা স্টেডিয়ামে তৎকালীন ফিফা সভাপতি জোয়াও হ্যাভেলাঞ্জ উদ্বোধন করেন এই লিগের। স্টেডিয়ামে সেদিন তিল ধারণের জায়গা ছিল না, সে ছিল এক মহা আয়োজন। সারা ঢাকা শহরে সাড়া পড়ে যায়। পরে সরকারপ্রধান বেগম খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনাও উদ্বোধন করেছেন পাইওনিয়ার লিগ। অথচ ফুটবলার তুলে আনার এই আয়োজনের জৌলুশ কমতে কমতে এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে লিগটা কবে কে উদ্বোধন করছেন, সেটার খোঁজই কেউ রাখে না।
বয়স চুরি, বাজে মাঠে খেলা, ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ, অনিয়মিত এবং দায়সারা আয়োজন, বাফুফের খবরদারির অভাবে পাইওনিয়ার লিগ ক্রমশ কার্যকারিতা হারিয়েছে। কখনো কখনো ছিল খামখেয়ালিপনাও। ২০১৭ সালে গ্রুপের খেলা শেষে মাঠ সমস্যাসহ নানা অজুহাতে সেমিফাইনাল–ফাইনাল হয়েছে প্রায় দুই মাস পর! আরেকটা বড় সমস্যা, পাইওনিয়ার লিগটা কখনোই ভালো মাঠে হয়নি। কয়েক বছর আগে পুরান ঢাকায় একবার ইটপাথরে ভরা মাঠে খেলা হচ্ছে দেখে মাঠ থেকেই বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনকে ফোন করার পর তিনি বলেছিলেন, ‘ভালো মাঠ কই পাব! মাঠ তো নেই।’
মাঠের সমস্যা আছে, এটা ঠিক। তারপরও মাঠের ব্যাপারে বাফুফের আন্তরিকতার অভাব ছিল সব সময়ই। তারা অন্য সব লিগ ভালো মাঠে আয়োজন করলেও পাইওনিয়ারের বেলায় ‘একটা মাঠ হলেই হলো’ মানসিকতা নিয়ে এগিয়েছে। যে কারণে এবড়োখেবড়ো মাঠেও খেলা হয়েছে। এবার বিজি প্রেস মাঠ বা মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজ মাঠ পাওয়া যায়নি। অগত্যা ব্রাদার্সের ঘাসবিহীন মাঠেও খেলা হয়েছে। পাইওনিয়ারের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক কোচ বললেন, ‘মাঠের সমস্যা দুই রকম। ঘাস থাকলে
ঠিকমতো পানি দেওয়া হয় না। ঘাস বড় বড়, বল চলে না। এদিকে গর্ত, ওদিকে ইট। আবার কোথাও মাঠ ন্যাড়া। এমনটাই দেখে এসেছি আমরা। অযত্ন আর অবহেলায় বেড়ে উঠেছে দেশের ফুটবলে আগামী প্রজন্ম, যা খুবই দুঃখজনক।’ তবে কোয়ার্টার ফাইনাল–সেমিফাইনাল হয়েছে কমলাপুরের টার্ফে, উদ্বোধনী ও ফাইনাল বসুন্ধরা কিংস অ্যারোনায় হওয়ায় ভালো মাঠে খেলার সৌভাগ্য হয়েছে কয়েকটি দলের।
সমস্যা হলো, লিগটার দিকে অতীতে নজর সেভাবে ছিল না সংগঠকদের। বাফুফের পক্ষ থেকে যাঁরা এই লিগ আয়োজনের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের অনেকের অদক্ষতা আর অনিয়ম চোখে পড়েছে। এবারও কিছু অভিযোগ–অনুযোগ আছে। পাইওনিয়ার কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান বাফুফের সদস্য মহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে এক ক্লাব কর্মকর্তা বললেন, ‘উনি তো লিগ শুরুর সময় ইন্দোনেশিয়া চলে যান জাতীয় দলের পর্যবেক্ষক হিসেবে।’ তবে মহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এগুলো বাজে কথা।
ইন্দোনেশিয়ায় আমি তিন দিন ছিলাম। তা ছাড়া সার্বক্ষণিক খোঁজ রেখেছি। সব মাঠে গিয়েছি। কোনো অনিয়মকে প্রশ্রয় দিইনি। আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছি এবং আগের চেয়ে তুলনামূলক ভালো একটা পাইনিওয়ার লিগ করেছি।’
এবার নিয়ম করা হয়, কোনো ক্লাবের আপত্তি থাকলে খেলা শেষ হওয়ার তিন ঘণ্টার মধ্যে পাঁচ হাজার টাকা বাফুফের কাছে জমা দিয়ে অভিযোগ করতে হবে। এ নিয়ে পাইওনিয়ারের একটি দলের কর্মকর্তা সাবেক ফুটবলার বেলাল আহমেদের ক্ষোভ, ‘মিরপুরে ম্যাচ খেলে যানজট পেরিয়ে বাফুফে ভবনে কীভাবে যাব তিন ঘণ্টার মধ্যে। তা ছাড়া পাইওনিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর জন্য পাঁচ হাজার টাকা অনেক। ফলে অনিয়ম দেখেও আমরা অভিযোগ করতে পারিনি। আমরা চাই, পাইওনিয়ার লিগে কোনো অনিয়ম হবে না।’
তবে অন্যবারের তুলনায় এ বছর তুলনামূলক ভালো ব্যবস্থাপনা রাখার চেষ্টা করেছেন ঢাকা মহানগরী লিগ কমিটির নতুন চেয়ারম্যান, বসুন্ধরা কিংসের সভাপতি ও বাফুফের সহসভাপতি ইমরুল হাসান। তাঁর উদ্যোগে এবার পাইওনিয়ার লিগের প্রতিটি মাঠে ডাক্তার, অ্যাম্বুলেন্স রাখা হয়েছে, যা আগে ছিল না। মাঠে খেলার মানও ভালো হয়েছে।
নজর কেড়েছে অনেক নবীন। পাইওনিয়ারের সঙ্গে যুক্ত সবাই বলছেন, নতুন চেয়ারম্যান ভালো কিছু করার ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন। তিনি নিজেও অর্থ খরচ করেন। আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল না। এবার যে ব্যবস্থাপনা ছিল, এটা ধরে রেখে সামনে এগোলে এবং ভবিষ্যতে বাফুফে এদিকে আরও নজর দিলে পাইওনিয়ার লিগের আয়োজনে উন্নতি আসবে।
এই আশাবাদ সত্যি হলেই ভালো। সব সংকট দূর করে অবহেলিত পাইওনিয়ার লিগটা আরও দীর্ঘ মেয়াদে এবং কার্যকর পরিকল্পনা নিয়ে আয়োজন করলে দেশের ফুটবল হয়তো পাবে মেধাবী একটি নতুন প্রজন্ম। যারা জাতীয় দলের ভার বইতে পারবে এবং টেনে তুলবে দেশের ফুটবলকে।