‘নাম্বার নাইন’দের দিন ফিরছে
পৃথিবীতে মাত্র একজন লিওনেল মেসি থাকার যে কত সমস্যা!
মেসির প্রতিপক্ষ হিসেবে যাঁদের খেলতে হয়েছে বা খেলতে হয়, তাঁরা অবশ্য ওপরের কথাটার সঙ্গে একমত হবেন না। স্বাভাবিক। এক ‘মেসি’র যন্ত্রণাতেই টেকা যাচ্ছে না, আবার একাধিক মেসি? নৈব চ, নৈব চ!
গত দেড় দশকের ফুটবলে মেসির প্রভাব যে শুধু ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে, তা নয়। দলগত কৌশলেও বিশাল প্রভাব রেখেছেন মেসি। তাঁকে আটকানোর জন্য প্রতিপক্ষ কোচদের নতুন নতুন কৌশল বের করতে হয়েছে। যার কোনোটা সফল হয়েছে, কোনোটা ব্যর্থ। কীভাবে মেসির সামর্থ্যের সবটুকু কাজে লাগানো যায়, সে নিয়েও কাজ করেছেন অনেক কোচ। এসব কৌশল দিন শেষে ঋদ্ধ করেছে ফুটবলকেই।
এমনই এক কৌশল—‘ফলস নাইন’। মেসি-উপযোগিতার শতভাগ কাজে লাগানোর জন্য পেপ গার্দিওলা যে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। অবশ্য গার্দিওলার আগে বিংশ শতাব্দীতে এই কৌশল ইউরোপে চালু করার কৃতিত্বটা পাবেন ইতালিয়ান ক্লাব রোমার সাবেক কোচ লুসিয়ানো স্পালেত্তি। কিংবদন্তি ফরোয়ার্ড ফ্রান্সেসকো টট্টিকে যিনি ‘ফলস নাইন’ হিসেবে খেলিয়ে দলকে জিতিয়েছিলেন ইতালিয়ান কাপ।
শুধু গার্দিওলা আর ক্লপই নন, অন্য দলের কোচেরাও এখন বুঝতে পারছেন, মেসির মতো ফলস নাইন আর কাউকে পাওয়া যাবে না। তাই গোলের জন্য আসলে এখন সেই প্রথাগত স্ট্রাইকারদের ওপরই ভরসা করতে হবে
কিন্তু এই ‘ফলস নাইন’ কৌশলটা কী? কয়েক দশক আগেও আক্রমণভাগে শারীরিকভাবে শক্তিশালী ও লম্বা স্ট্রাইকার খেলানোর চল ছিল, যাদের বলা হতো ‘নাম্বার নাইন’। যাদের মূল কাজই ছিল প্রতিপক্ষ ডি–বক্সের মধ্যে ঘোরাফেরা করে শারীরিক শক্তি ও গতির মাধ্যমে ডিফেন্ডারদের ছিটকে গোলের সন্ধান করা। গোল বানিয়ে দেওয়া, নিচে খেলা তৈরি করা, মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ করা কিংবা প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের জায়গাচ্যুত করে সতীর্থদের গোল করার জায়গা বানিয়ে দেওয়া—‘নাম্বার নাইন’দের এত কিছু করা লাগত না। ওদের মূল কাজ শুধু গোল করা, প্রথাগতভাবে যাদের ‘স্ট্রাইকার’ বলা হয়। গার্ড মুলার, ইয়ান রাশ থেকে শুরু করে গাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, রোনালদো, রোমারিও, ক্রিশ্চিয়ান ভিয়েরি, রবি ফাওলার, মিরোস্লাভ ক্লোসা, রুড ফন নিস্টলরয়, লুকা টনি, জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচরা পড়েন এই দলে।
বরুসিয়া ডর্টমুন্ড থেকে নরওয়েজিয়ান স্ট্রাইকার আর্লিং হলান্ডকে কিনেছেন গার্দিওলা, বেনফিকার উরুগুইয়ান স্ট্রাইকার দারউইন নুনিয়েজ গেছেন ক্লপের লিভারপুলে
মেসিকে পেয়ে গার্দিওলা এই গৎবাঁধা কৌশলে বদল আনলেন। অন্য কোনো প্রথাগত স্ট্রাইকার না খেলিয়ে মেসিকেই বার্সেলোনার মূল স্ট্রাইকার হিসেবে খেলানো শুরু করলেন। যিনি গোল তো করবেনই, সঙ্গে যেগুলোকে প্রথাগত স্ট্রাইকারদের কাজ মনে করা হয় না, সেগুলোও করবেন। আর এই ভূমিকারই নাম হলো ‘ফলস নাইন’—যিনি স্ট্রাইকার হয়েও ঠিক স্ট্রাইকার নন।
ম্যাচে ‘ফলস নাইন’ ভূমিকায় থাকা মেসি কখন বক্সে থাকবেন, কখন নিচে নেমে যাবেন, বক্সে না থাকলে সে সময় কে বক্সে উঠে আসবেন—এ নিয়ে পুরো ৯০ মিনিট ধরে ধন্দে থাকতেন প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডাররা। আর এই দোনোমনার সুযোগ নিয়েই মেসি একের পর এক গোল করেছেন, করিয়ে গেছেন, নিজেকে গড়েছেন ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার হিসেবে। ‘ফলস নাইন’ পজিশনে মেসির সাফল্য অন্যান্য দল ও ম্যানেজারদের উদ্বুদ্ধ করেছে এই কৌশলের প্রতি। গত এক দশকে যে কারণে প্রথাগত স্ট্রাইকারদের গুরুত্ব দিনকে দিন কমেই যাচ্ছিল।
লিভারপুলের কথাই ধরুন। ইয়ুর্গেন ক্লপের অধীন দলটা দীর্ঘ ট্রফি–খরা কাটিয়েছে যেসব কৌশলে চড়ে, তার মধ্যে ‘ফলস নাইন’ও ছিল। আক্রমণভাগের দুপাশে সাদিও মানে ও মোহাম্মদ সালাহকে রেখে মেসির মতো না হলেও বেশ কার্যকরীভাবে ‘ফলস নাইন’-এর ভূমিকাটা পালন করেছেন রবার্তো ফিরমিনো। যে কারণে দলে জায়গা হারিয়েছেন ক্রিস্টিয়ান বেনটেকে ও ড্যানিয়েল স্টারিজের মতো প্রথাগত স্ট্রাইকাররা।
ম্যানচেস্টার সিটির ব্যাপারটাও একই। দুই বছর ধরে প্রথাগত স্ট্রাইকার ছাড়াই খেলছে গার্দিওলার দল। কখনো রহিম স্টার্লিং, কখনো রিয়াদ মাহরেজ, কখনো ফিল ফোডেন বা কখনো কেভিন ডি ব্রুইনাকে ফলস নাইনে খেলিয়েই সাফল্যের খোঁজ করেছেন গার্দিওলা। এভাবেই সর্বশেষ পাঁচ মৌসুমে চারবার দলকে প্রিমিয়ার লিগ জিতিয়েছেন। যে কারণে ধীরে ধীরে তাঁর দলে ব্রাত্য হয়ে গেছেন সের্হিও আগুয়েরো ও গাব্রিয়েল জেসুসের মতো স্ট্রাইকাররা।
কাই হাভার্টজের মতো আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারকে ‘ফলস নাইন’ হিসেবে খেলিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে চমক দেখিয়েছেন চেলসির কোচ টমাস টুখেল। সুযোগ পাননি রোমেলু লুকাকুর মতো স্ট্রাইকার। জুভেন্টাসের পাওলো দিবালা, নাপোলির দ্রিস মের্তেনসদের গল্পটাও অনেকটা একই, যাঁদের জায়গা করে দিতে গিয়ে আস্তে আস্তে আড়ালে চলে গিয়েছেন গনজালো হিগুয়েইন, মারিও মানজুকিচদের মতো প্রথাগত স্ট্রাইকাররা। আয়াক্সের যে দলটা চমক জাগিয়েছিল কয়েক মৌসুম আগেও, সে দলে ‘ফলস নাইন’ হিসেবে খেলতেন সার্বিয়ার দুসান তাদিচ।
কিন্তু ওই যে, প্রতিটি কৌশলেরই একটা নির্দিষ্ট জীবনকাল থাকে। যে কৌশল ব্যবহার করে মেসির কাছ থেকে সর্বোচ্চ উপযোগিতা পাওয়া গিয়েছিল, বাকি ‘ফলস নাইন’দের ক্ষেত্রেও সেই কৌশলটা একই রকম ফলদায়ক হবে, সেটা ভাবা বোকামি। সবাই তো আর মেসি নন!
‘ফলস নাইন’ কৌশলের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনাটা সম্প্রতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন খোদ গার্দিওলা-ক্লপই। গত এক দশকে যে দুজনকে সবচেয়ে বেশি ‘ফলস নাইন’ কৌশলের শরণ নিতে দেখা গেছে, তাঁরাই এবার দলবদলের বাজার থেকে যাঁর যাঁর দলের জন্য কিনেছেন একেবারে প্রথাগত স্ট্রাইকার বা ‘নাম্বার নাইন’
রবার্তো ফিরমিনো নিচে নেমে সালাহ-মানেদের গোল করার জায়গা বানিয়ে দিলেও নিজে কখনোই মেসির মতো ভূরি ভূরি গোল করতে পারতেন না। ফোডেন, স্টার্লিং, মাহরেজ, হাভার্টজ, দিবালাদের গোল করার হারটাও ঠিক স্ট্রাইকারসুলভ নয়। যে কারণে এই সময়ে এসে ‘ফলস নাইন’ কৌশল কতটুকু কার্যকরী, সে প্রশ্নও উঠছে। এখন বলুন, পৃথিবীতে মাত্র একজন মেসি থাকা অনেক বড় ‘সমস্যা’ নয় কি?
‘ফলস নাইন’ কৌশলের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনাটা সম্প্রতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন খোদ গার্দিওলা-ক্লপই। গত এক দশকে যে দুজনকে সবচেয়ে বেশি ‘ফলস নাইন’ কৌশলের শরণ নিতে দেখা গেছে, তাঁরাই এবার দলবদলের বাজার থেকে যাঁর যাঁর দলের জন্য কিনেছেন একেবারে প্রথাগত স্ট্রাইকার বা ‘নাম্বার নাইন’। বরুসিয়া ডর্টমুন্ড থেকে নরওয়েজিয়ান স্ট্রাইকার আর্লিং হলান্ডকে কিনেছেন গার্দিওলা, বেনফিকার উরুগুইয়ান স্ট্রাইকার দারউইন নুনিয়েজ গেছেন ক্লপের লিভারপুলে। তাহলে কি ‘ফলস নাইন’ কৌশল থেকে সরে ‘নাম্বার নাইন’–এর শরণ নিতে প্রস্তুত দুজনই?
শুধু গার্দিওলা আর ক্লপই নন, অন্য দলের কোচেরাও এখন বুঝতে পারছেন, মেসির মতো ফলস নাইন আর কাউকে পাওয়া যাবে না। তাই গোলের জন্য আসলে এখন সেই প্রথাগত স্ট্রাইকারদের ওপরই ভরসা করতে হবে। গোল করানোর পাশপাশি যদি অন্যান্য গুণ থাকে কোনো স্ট্রাইকারের, সেটা হবে বাড়তি পাওনা। যে কারণে দিবালাকে ছেড়ে দুসান ভ্লাহোভিচকে নিয়েছে জুভেন্টাস, মেসিহীন বার্সেলোনা খুঁজছে লেভানডফস্কিকে। ট্যামি আব্রাহামকে নিশ্চিন্তে খেলানোর জন্য নিকোলো জানিওলোর মতো কুশলী ফরোয়ার্ডকে ছেড়ে দিতেও ভাবছেন না রোমার কোচ জোসে মরিনিও, এই বয়সেও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মূল স্ট্রাইকার হিসেবে কোচের আস্থার জায়গা হয়ে আছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। মেসি-পরবর্তী যুগে এমবাপ্পের সঙ্গে খেলানোর জন্য জিয়ানলুকা স্কামাক্কাকে চাইছে পিএজসি, সাশা কালায়জিচ-আরমান্দো ব্রোজার মতো স্ট্রাইকারদের নিয়ে এবারের দলবদল বাজারে কাড়াকাড়ি পড়েছে ওই একই কারণে। করিম বেনজেমার উত্তরসূরি হিসেবে যে ম্যাথিউস নাসিমেন্তোকে পছন্দ করে রেখেছে রিয়াল মাদ্রিদ, সেই তরুণ ব্রাজিলিয়ানও পাক্কা ‘নাম্বার নাইন’।
প্রিমিয়ার লিগে হলান্ড-নুনিয়েজকে দেখার অপেক্ষায় থাকা ফুটবলপ্রেমীরাও তাই এখন কিছুটা স্মৃতিকাতর। অঁরি-নিস্টলরয়, রুনি-তোরেস-দ্রগবা কিংবা সুয়ারেজ-আগুয়েরো-ফন পার্সিদের কল্যাণে এক নিয়মিতই স্ট্রাইকারদের মধ্যে গোলের লড়াই দেখা যেত প্রিমিয়ার লিগে। হলান্ড-নুনিয়েজরা কি ফেরাবেন প্রথাগত নাম্বার নাইনদের সেই লড়াইয়ের দিনগুলো?