ফুটবলের সবচেয়ে প্রভাবশালী মা

কিলিয়ান এমবাপ্পের মা ফাইজা লামারিছবি: টুইটার

‘তোমার বুট জোড়া তোমাকেই পরিষ্কার করতে হবে’—কিলিয়ান এমবাপ্পেকে সোজা বলে দিয়েছিলেন তাঁর মা ফাইজা লামারি।

এমবাপ্পে তত দিনে মোনাকোর মূল দলের হয়ে অনুশীলন শুরু করেছেন। প্রতিদিন অনুশীলনের পর দেখতেন তাঁর সতীর্থরা বুট জোড়া পরিষ্কার করার জন্য পাঠাচ্ছেন। এমবাপ্পেও ভেবেছিলেন, যেহেতু তিনি এখন মূল দলের খেলোয়াড় হয়ে গেছেন, আর নিজের বুট নিজেকে পরিষ্কার করতে হবে না। কিন্তু মা লামারি সেটা হতে দিলেন না।

আরও পড়ুন

ছেলে ছোট থাকতেই তাঁর ব্যাপারে এমন কঠোর ছিলেন লামারি। সেই ছেলে এখন বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ফুটবলার, সবচেয়ে বেশি বেতন পাওয়াদের একজন, সবচেয়ে দামিও হয়তো। এবং এখনো এমবাপ্পের ক্যারিয়ার নিয়ে লামারির মতটাই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ফুটবলে সাম্প্রতিককালে বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠা এজেন্টদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে প্রভাবশালীদের একজন লামারি।

তবে সত্যিটা হচ্ছে, লামারি আনুষ্ঠানিকভাবে ফুটবল এজেন্ট নন। তিনি আইনজীবী নন, নন হিসাবরক্ষকও। তাঁর ভাষায়, ‘আমি এমবাপ্পের জন্য কাজ করি, সে আমার বস।’

এমবাপ্পের ক্যারিয়ার নিয়ে নানা সময়ে নেওয়া লামারির সিদ্ধান্ত দেখলে অবশ্য উল্টোটাই মনে হবে। এমনিতে লামারি এমবাপ্পের বাণিজ্যিক চুক্তিগুলো দেখভাল করেন, ফুটবলীয় বিষয়গুলো দেখভাল করেন এমবাপ্পের বাবা উইলফ্রাইড। এ ছাড়াই আইনি পরামর্শের জন্য তাঁরা ২০১৫ সাল থেকে তাঁর ডেলফাইন ভারহেইডেন নামে একজন ফরাসি আইনজীবী রেখেছেন। তবে বাইরে থেকে যা বোঝা যায়, তাতে মনে হয় আপাতত তাঁর মা লামারিই এমবাপ্পের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন

শুধু যে ছেলের ক্যারিয়ারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তা না। লামারি সময়ে সময়ে হয়ে উঠছেন এমবাপ্পের মুখপাত্রও। তাঁর জন্য কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ সেটা তো বলছেনই, এমবাপ্পের হয়ে অন্যদের সমালোচনার জবাব দিচ্ছেন, মাঝেমধ্যে ঝগড়াও করছেন। ২০২১ সালে তো একবার এমবাপ্পের জাতীয় দলের সতীর্থ ফরাসি মিডফিল্ডার আদ্রিয়া রাবিওঁর মা ভেরোনিকা রাবিওঁর সঙ্গে ভালোই লেগে গিয়েছিল লামারির। ইউরোতে সুইজারল্যান্ডের ফ্রান্সের হারের পর এমবাপ্পের ঔদ্ধত্যের সমালোচনা করেছিলেন ভেরোনিকা। সেটার জবাব দিতে দেরি করেননি লামারি। কয়েকবার তো এমবাপ্পের ক্লাব পিএসজিরও প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন।

এমবাপ্পের ক্যারিয়ারে বাণিজ্যিক বিষয়গুলো সামলান ফাইজা লামারি
ছবি: দ্য টাইমসের সৌজন্যে

তবে শুধু ঝগড়াঝাঁটি করা বা ছেলের হয়ে অন্যদের জবাব দেওয়ার কাজই করেন না। ছেলের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যাতে সব সময় ফুলেফেঁপে থাকে, তাঁর ভাবমূর্তি যাতে উজ্জ্বল থাকে, সে বিষয়েও খুব সচেতন লামারি। তিনি তাঁর ছেলেকে দেখতে চান মাইকেল জর্ডানের মতো বৈশ্বিক আইকন হিসেবে। গত বছর যখন রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে এমবাপ্পের দলবদল নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, লামারি ও ভারহেইডেনের প্রধান শর্তই ছিল, এমবাপ্পের ভাবমূর্তি–স্বত্বের পুরো নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতেই থাকতে হবে।

আরও পড়ুন

লামারির এই যে এমন দর–কষাকষি কিংবা আলোচনার সামর্থ্য, এটা এমনি এমনই হয়নি। ফ্রান্সের বঁদিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা হলেও লামারি আসলে আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত। উত্তর আলজেরিয়ার কাবিলিয়ায় থাকতেন তাঁর পূর্বপুরুষেরা। লামারি নিজেই বলেছেন, তাঁর এই জেদি মনোভাব ও চারিত্রিক দৃঢ়তা এসেছে পারিবারিকভাবে। খেলাধুলার জগতের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় অনেক আগে থেকেই। নিজে একসময়ে আলজেরিয়ার জাতীয় হ্যান্ডবল দলের হয়ে খেলেছেন, খেলেছেন বঁদি দলের হয়েও। যে দলে তাঁর কোচ জ্যাঁ লুইস কিমো বলছেন, মাঠে লামারি ছিল যোদ্ধা, তবে বদমেজাজিও।

সেই রগচটা স্বভাব এখনো প্রকাশ পায়। এমবাপ্পের জাতীয় দলের সতীর্থ ও রিয়াল মাদ্রিদ ডিফেন্ডার ফারলাঁ মেন্দি তো গত বছর বলেছেনই, লামারির কারণেই এমবাপ্পের রিয়ালে যাওয়া হয়নি তখন। এমবাপ্পের ক্যারিয়ারে তাঁর বাবা-মার এত প্রভাব নিয়ে গত বছর ইব্রাহিমোভিচও বলেছিলেন, ‘ওর বাবা-মা একই সঙ্গে আইনজীবী-এজেন্ট ও কোচের ভূমিকা নিচ্ছে। এরা আসলে নিজেদের কী ভাবে? চুপ থাকো এবং ছেলের হাতে সব ছেড়ে দাও।’

আরও পড়ুন

তবে লামারি এসব পাত্তাটাত্তা দেন বলে মনে হয় না। ছেলের ওপর সেই ছোটবেলা থেকে তাঁর যতটুকু নিয়ন্ত্রণ ছিল, এখনো সেটাই রাখতে চান। এটাকেই নিজের দায়িত্ব বলে মনে করেন। তাই তো এখনো ছেলের জন্য অনুপযুক্ত কোনো বিজ্ঞাপনী প্রস্তাব এলে তিনি যেমন পত্রপাঠ না বলে দেন, তেমনি আবার নির্দ্বিধায় ছেলের সঙ্গে তাঁর বান্ধবীদের সম্পর্কে গল্প করেন, একসঙ্গে গান শোনেন।

এমবাপ্পে একবার বলেছিলেন, যখন তাঁদের বয়স কম ছিল, প্রিয় গায়ক ছিলেন আশির দশকের বিখ্যাত ফরাসি গায়ক দানিয়েল বালাওয়ান। সেই গায়কের গাওয়া তাঁদের পছন্দের গানের নামটা হয়তো কাকতালীয়ই—‘আমার ছেলে, আমার লড়াই।’