টেন হাগকে এখনই কেন ছাঁটাই করতে পারবে না ইউনাইটেড

হতাশ টেন হাগএএফপি

‘মাসসেরা কোচ হওয়ার সপ্তাহান্তে কেউ কি কখনো চাকরি হারিয়েছেন?’—বোর্নমাউথের বিপক্ষে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচে ৩-০ গোলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বিধ্বস্ত হওয়ার পর এমন প্রশ্ন তুলেছিলেন কিংবদন্তি ইংলিশ ফুটবলার গ্যারি লিনেকার। সে সময় কেউ কেউ লিনেকারের পক্ষ নিলেও অনেকে বিরোধিতাও করেছেন। বিরোধিতা অবশ্য একেবারে অযৌক্তিকও ছিল না।

নভেম্বর মাসে দারুণ খেলেছে টেন হাগের দল। সে মাসে টানা তিনটি প্রিমিয়ার লিগ ম্যাচে জয়ও পায় ইউনাইটেড। যার স্বীকৃতিস্বরূপ মাসসেরা কোচের পুরস্কার পান এই ডাচ কোচ। কিন্তু গতকাল রাতে চ্যাম্পিয়নস লিগে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে হেরে ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ার পর নতুন করে সামনে এসেছে টেন হাগের ছাঁটাইয়ের প্রসঙ্গ। চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে নাস্তানাবুদ হয়ে বিদায় এবং প্রিমিয়ার লিগে শীর্ষে থাকা লিভারপুলের চেয়ে ১০ পয়েন্টে পিছিয়ে থাকার পর সমর্থকদের পাশে পাওয়ার সম্ভাবনাও সামান্য।

আরও পড়ুন

শুধু অবশ্য এটুকুই নয়, ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে সব মিলিয়ে মাত্র তিনটি দল ইউনাইটেডের চেয়ে (১২ ম্যাচ হেরেছে ইউনাইটেড) বেশি ম্যাচ হেরেছে। সে দলগুলো হলো বার্নলি, ইউনিয়ন বার্লিন ও আলমেরিয়া। প্রশ্ন হচ্ছে চাপের সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে থাকা টেন হাগকে কি ইউনাইটেড শেষ পর্যন্ত ছাঁটাই করবে? তবে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ ও ইউনাইটেডের বর্তমান অবস্থা বলছে, এমন চাপে থাকার পরও ইউনাইটেড এ মুহূর্তে টেন হাগকে ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটবে না। এর পেছনে কিছু ব্যাখ্যাও আছে।

টেন হাগকে ছাঁটাই করা কেন জটিল
গত বছরের নভেম্বরে ইউনাইটেডের আমেরিকান মালিক দ্য গ্লেজার ফ্যামিলি একটি কৌশলগত পর্যালোচনা করে ঘোষণা দেয় যে ক্লাবটি একটি ধারাবাহিক পরিবর্তনে ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সে সময় পেট্রকেমিক্যাল জায়ান্ট আইএনইওএসের প্রতিষ্ঠাতা স্যার জিম র‍্যাটক্লিফের ক্লাবের ২৫ শতাংশ মালিকানা কিনে নেওয়ার কথাও সামনে আসে। এর মধ্য দিয়ে ক্লাবের ফুটবল পরিচালনার দায়িত্বও তাঁর কাঁধে বর্তাবে বলে ধারণা করা হয়। তবে এখনো র‍্যাটক্লিফের ক্লাবের মালিকানায় আসার চূড়ান্ত ঘোষণা আসেনি।

হতাশায় মুখ ঢাকলেন ইউনাইটেডের এক সমর্থক। কাল রাতে বায়ার্নের কাছে হেরে ইউরোপ থেকে বিদায় নিয়েছে ইউনাইটেড
এএফপি


স্বাভাবিক সময়ে ক্লাবের কোচের চাকরিবিষয়ক সিদ্ধান্ত নেন নির্বাহী সহসভাপতি জোয়েল গ্লেজার। কিন্তু এখনো র‍্যাটক্লিফ ও তাঁর আইএনইওএস দল যোগ না দেওয়ায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ও ক্ষমতার বণ্টনে একধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে ক্লাবে ক্লাবের প্রধান নির্বাহীর পদে রিচার্ড আরনল্ডের জায়গায় অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন ইউনাইটেডের প্রধান আইনি অফিসার প্যাট্রিব স্টুয়ার্ট। প্রশ্ন হচ্ছে একজন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান নির্বাহী কি দায়িত্ব নেওয়ার এক মাসের মধ্যে ক্লাবের কোচকে ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? এটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তাই কোচ ছাঁটাইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি এখন বেশ জটিলতায় রূপ নিয়েছে।

আরও পড়ুন

কোচ বদলানোর ক্ষেত্রে অর্থ কি বড় বাধা?
টেন হাগের সঙ্গে ইউনাইটেডের ৩ বছরের চুক্তির এখনো ১৮ মাস বাকি আছে। এখন যদি ইউনাইটেড ছাঁটাই করে তবে তাঁকে প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষতিপূরণ দিয়ে টেন হাগকে ছাঁটাই করার সামর্থ্য ক্লাবটির এ মুহূর্তে আছে কি না? বলা হচ্ছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ‘রেড ডেভিল’দের ক্যাশ রিজার্ভ নেমে এসেছে ৭৬ মিলিয়ন পাউন্ডে। যেখানে তাদের বিভিন্ন খাতে ব্যবহার করার মতো অর্থ আছে ৪০ মিলিয়ন পাউন্ড।

ইউনাইটেডে চুক্তি অনুযায়ী প্রতিবছর ৯ মিলিয়ন পাউন্ড করে পান টেন হাগ। এখন চুক্তি শেষ করলে তাঁকে সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ মিলিয়ন পাউন্ডের মতো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পাশাপাশি তাঁর সঙ্গে যেসব স্টাফ ক্লাব ছাড়বেন, তাঁদেরও টাকা দিতে হবে ক্লাবটিকে। উদাহরণ হিসেবে সহকারী কোচ মিচেল ফন ডার গ্যাগ ও স্টিভ ম্যাকলারেনের নাম বলা যায়। এর আগে জোসে মরিনিওকে ছাঁটাইয়ের সময় পর্তুগিজ কোচ ও তাঁর সঙ্গীদের ১৯.৬ মিলিয়ন পাউন্ড দিতে হয়েছিল ইউনাইটেডকে। এরপর নতুন কোচের পেছনে খরচের বিষয়টিও আছে। একই সঙ্গে আগের বছরগুলোয় বিপুল পরিমাণে খরচ করায় ফিন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লের নীতির বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে তাদের।

দুঃসময়ের বৃত্তে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড
এএফপি

ড্রেসিংরুমে কেমন প্রতিক্রিয়া হতে পারে?
নভেম্বরের শুরুতে কারাবাও কাপে নিউক্যাসলের কাছে হেরে কারাবাও কাপ থেকে বিদায় নেয় ইউনাইটেড। সেই সময় অ্যাথলেটিক জানায়, এই হারের পর ইউনাইটেডের ভেতর অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। কিছু খেলোয়াড় টেন হাগের ওপর থেকে আস্থাও হারিয়ে ফেলেছেন। বিশ্বকাপজয়ী ডিফেন্ডার রাফায়েল ভারানে ও ইংলিশ ফরোয়ার্ড জেডন সাঞ্চোকে উপেক্ষা করা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অনেকে। বিশেষ করে সাঞ্চোর বিষয়টি আরও ভালোভাবে সামলানো যেত বলেও মনে করেন কোনো কোনো খেলোয়াড়।

এর মধ্যে অক্টোবরে ব্রেন্টফোর্ডের বিপক্ষে ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার কাসেমিরোকে প্রথমার্ধ শেষে বদলি করা নিয়ে টেন হাগ বলেন তিনি খেলোয়াড়দের ‘আরও বেশি ফুটবল’ খেলতে দেখতে চান। তাঁর এ মন্তব্য ভালোভাবে নিতে পারেনি অনেক খেলোয়াড়। তবে এখন পর্যন্ত বিষয়গুলোকে বিচ্ছিন্ন কিছু সমস্যা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। কোচের বিরুদ্ধে খেলোয়াড়েরা বিদ্রোহ করতে পারেন এমন কোনো আশঙ্কাও এ মুহূর্তে নেই। এর মধ্যে বায়ার্ন ম্যাচের আগে মিডফিল্ডার স্কট ম্যাকটমেনিও কোচের পাশে থাকার কথা বলেছেন। সব মিলিয়ে খেলোয়াড়দের মধ্যে কোচকে ছাঁটাই নিয়ে বড় কোনো চাপ নেই। যা টেন হাগকে কিছুটা স্বস্তি দিতেই পারে।

আরও পড়ুন

ফলের প্রভাব কেমন?
টেন হাগ জানেন এবং অতীতে বলেছেনও, ফুটবল হচ্ছে ফলনির্ভর বিষয়। এখানে সবকিছু নির্ধারিত হয় ফল দিয়ে। এ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে ১৬ ম্যাচের ৭টিতেই হেরেছে তাঁর দল। ইউরোপ থেকেও বিদায় হয়ে গেছে তাঁদের। বিদায়ঘণ্টা বেজেছে কারাবাও কাপ থেকেও। এর আগে উলে গুনার সুলশার যখন ছাঁটাই হন, তার আগের দিন ৪-১ গোলে ওয়াটফোর্ডের কাছে হারে ওল্ড ট্রাফোর্ডের ক্লাবটি। সেবার প্রথম ১২ ম্যাচের ৫টিতে হেরেছিল ইউনাইটেড এবং শীর্ষে থাকা চেলসির চেয়ে ১২ পয়েন্টে পিছিয়ে ছিল তারা। সেবারও ওয়েস্ট হামের কাছে হেরে কারাবাও কাপ থেকে বিদায় নিয়েছিল দলটি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরেও সেরা চার থেকে ১১ এবং প্রিমিয়ার লিগে শীর্ষে থাকা লিভারপুলের চেয়ে ১৯ পয়েন্টে পিছিয়ে ছিল তারা। এরপর মরিনিওর ছাঁটাই হওয়াটা অনেকটা অবধারিতই ছিল।

আরও পড়ুন

টেন হাগের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। মাত্র কয়েক দিন আগে প্রিমিয়ার লিগের মাসসেরা কোচের পুরস্কার জিতেছেন তিনি। টানা তিন ম্যাচে ফুলহাম, লুটন টাউন ও এভারটনকে হারায় তারা। এমনকি বোর্নমাউথের বিপক্ষে ইউনাইটেড যখন ৩-০ গোলে পিছিয়ে ছিল, তখনো সমর্থকদের একাংশকে তাঁর নাম ধরে ইতিবাচক স্লোগান দিতে দেখা যায়। খেলোয়াড়দের দুয়োর বিপরীতে টেন হাগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অনেক সমর্থক। এসবের পরও হতাশার বিষয়টি আড়াল করার সুযোগ নেই এবং ফল বদলাতে না পারলে তা আরও বাড়বে। তবে নিজেদের পরের ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ও বর্তমানে শীর্ষে থাকা লিভারপুলকে হারাতে পারলে কিছু সময়ের জন্য হলেও দল, খেলোয়াড় ও সমর্থকদের মানসিক অবস্থাকেও বদলে দিতে পারবেন টেন হাগ।

ইউনাইটেড কি অন্য কোচ খুঁজছে?

এটা সত্য যে ইউনাইটেডের দায়িত্ব নেওয়ার মতো অনেক কোচের এ মুহূর্তে অভাব নেই। জিনেদিন জিদান, আন্তোনিও কন্তে, হান্সি ফ্লিকের মতো হাই-প্রোফাইল কোচরা ফাঁকা আছেন। তাঁদের যে কেউ দায়িত্ব নিয়ে দলের রূপ বদলে দিতে পারেন। এ ছাড়া গ্রাহাম পটার ও হুলেন লোপেতেগির মতো প্রিমিয়ার লিগে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোচও আছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ইউনাইটেডের নতুন কোচের সন্ধানের নামার কোনো খবর নেই।

আরও পড়ুন

সাধারণত বদলি হিসেবে আনা যায় এমন কোচের নাম ক্লাবের ভাবনায় থাকে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। বদলি হিসেবে আনা যেতে পারে এমন কোনো নাম নাকি ইউনাইটেডে নেতৃস্থানীয়দের ভাবনায় এ মুহূর্তে নেই। এর পেছনেও মূলত ভূমিকা আছে আইএনইওএসের চুক্তিটি ঝুলে থাকার বিষয়টির। তাই সব মিলিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত চুক্তিটি সম্পন্ন হচ্ছে না, তত দিন পর্যন্ত টেন হাগ চাইলে নিজেকে নিরাপদ ভাবতেই পারেন।