সেই দিনটির কথা গতকাল খুব মনে পড়েছে কাজী সালাহউদ্দিনের। ১৯৮৪ সালের ১৯ অক্টোবর, সালাহউদ্দিন যেদিন ফুটবল থেকে অবসরে গিয়েছিলেন, সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে ছিল মানুষের ঢল। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডানের সঙ্গে আবাহনীর সেই ম্যাচে তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তাঁকে সবচেয়ে আপ্লুত করেছিলেন মোহামেডান সমর্থকেরা। মোহামেডানের গ্যালারির সামনে যখন গিয়েছিলেন, তখন ‘চিরশত্রু’ দলের সমর্থকেরা ১৫ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে তাঁকে করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
গতকাল সিটি গ্রুপ-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার অনুষ্ঠানে সালাহউদ্দিনের হাতে তুলে দেওয়া হয় ২০২৩ সালের আজীবন সম্মাননা। প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের বলরুমে উপস্থিত অতিথিরা দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানান তাঁকে। আজীবন সম্মাননা পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় সালাহউদ্দিন বলেন, ‘অবসর নেওয়ার সেই দিনটির কথা মনে পড়ে গেল। সেদিনও দর্শকেরা আমাকে করতালি দিয়ে অভিনন্দিত করেছিলেন। আজ (গতকাল) এত বছর পর প্রথম আলো আমাকে দিল আজীবন সম্মাননা। মনে হচ্ছে, ফুটবল খেলে কিছু অর্জন করতে পেরেছি। আমি শেখ কামাল লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি, স্বাধীনতা পদক পেয়েছি। আজ (গতকাল) প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার পেলাম। মনে হচ্ছে, আমার যাত্রা আজ পরিপূর্ণ হলো।’
দেশের ক্রীড়া ইতিহাসের অন্যতম সুপারস্টার সালাহউদ্দিন বাফুফে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন ১৫ বছর ধরে। খেলোয়াড়ি জীবনে ছুঁয়েছেন ঢাকা লিগে প্রথম ১০০ গোলের মাইলফলক। একাধিকবার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন, জাতীয় দলে খেলেছেন, অধিনায়কত্বও করেছেন। খেলেছেন প্রথম বাংলাদেশি ফুটবলার হিসেবে বিদেশের পেশাদার ফুটবল লিগে। জাতীয় ফুটবল দলের কোচ ছিলেন একাধিকবার।
এত কিছুর পরও সালাহউদ্দিনের সবচেয়ে বড় গর্ব তিনি মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মাত্র ১৭ বছর বয়সে সবচেয়ে কম বয়সী সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে। দেশের ফুটবল ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় তারকা, কোচ, ফুটবল সংগঠকের পরিচয় ছাপিয়েও দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে তাঁর অংশগ্রহণ তাঁকে অনন্য করে তুলেছে। সেটিই যেন তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় গর্বের মুকুট, ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে খেলার সৌভাগ্য তো সবার হয়নি। আমার হয়েছে। আমার জীবনে এর চেয়ে গর্ব আর নেই। দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছি। খুব অল্প বয়সেই সেটি পেরেছি।’
হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ায় গত ২৮ ডিসেম্বর বাইপাস সার্জারি হয় কাজী সালাহউদ্দিনের। মোটামুটি সুস্থ হয়ে এখন আবার ফিরেছেন কাজকর্মে। আজীবন সম্মাননা নিয়ে বলরুম ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ৭০ বছর বয়সী এই সাবেক তারকা ফুটবলারের পিছু নিলেন অনেকেই। কেউ সেলফি তুলতে চান, কেউবা জানালেন অভিনন্দন। খেলা ছাড়ার ৪০ বছর পরও কাজী সালাহউদ্দিনের তারকাদ্যুতি যে এতটুকুও কমেনি, দৃশ্যটা যেন সেটিই জানিয়ে দিল আরও একবার।
গাড়িতে ওঠার সময় সবাইকে বিদায় জানাতে গিয়ে সালাহউদ্দিনের কণ্ঠও যেন একটু কেঁপে উঠল। আবেগ ছুঁয়ে যাচ্ছিল তাঁকে। চোখে কি ঝিলিক দিয়ে উঠল একটু আনন্দাশ্রুও!