বিশ্বকাপের সময় সবচেয়ে বেশি গালমন্দের শিকার ফ্রান্স, বেশি পোস্ট ইউরোপ থেকে
ইউরোপিয়ান ফুটবলের মৌসুমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমনিতেই সরব থাকেন ফুটবলপ্রেমীরা। বিশ্বকাপ এলে তো কথাই নেই। হাজারো পোস্টে ছেয়ে যায় ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ও ইউটিউব।
কাতার বিশ্বকাপেই তো ঝড় বয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তবে সব পোস্ট ইতিবাচক ছিল না। কটুকাটব্য ও বর্নবাদী মন্তব্যও হয়েছে প্রচুর। বিশ্বকাপজুড়ে এ নিয়ে নজরদারি করেছিল ফিফার ‘সোশ্যাল মিডিয়া প্রটেকশন সার্ভিস’ (এসএমপিএস)।
বিশ্বকাপ শেষের ছয় মাস পর এ নিয়ে তারা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাতার বিশ্বকাপে খেলোয়াড়, কোচ ও অফিশিয়ালদের উদ্দেশ্য করে প্রায় ২০ হাজার আপত্তিকর পোস্ট করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
ফিফা ও ফুটবলারদের সংগঠন ফিফপ্রোর তত্ত্বাবধানে বানানো একটি বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিশ্বকাপে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায় ২ কোটি পোস্ট বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২ লাখ ৮৬ হাজার ৮৯৫টি পোস্ট আপত্তিকর বা আপত্তিকর সম্ভাবনাময় বিবেচনায় আড়াল (হিডেন) করে দেওয়া হয়।
২০ হাজার আপত্তিকর পোস্টের মধ্যে ২৬ দশমিক ২৪ শতাংশ ছিল নেতিবাচক সাধারণ কথা। ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ পোস্ট ছিল বর্ণবৈষম্যমূলক আর হুমকি ও হিংসাত্মক পোস্ট ছিল ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। এর বাইরে যৌনতা ও পারিবারিকভাবে সম্মানহানিকর বিষয়বস্তু নিয়েও প্রচুর পোস্ট করা হয়।
ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ও ইউটিউবে প্রায় ২ কোটি পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর মধ্যে ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৬৯৬টি পোস্টে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা পুরোপুরি আপত্তিকর। এগুলো ‘ফ্লাগড’ পোস্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এরপর এই তথ্য একটি বিশেষজ্ঞ দল ‘ডাবল হিউম্যান ট্রায়াজ’ প্রক্রিয়ায় বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ১৯ হাজার ৬৩৬টি পোস্টের ভাষা ও বিষয়বস্তু আপত্তিকর মানহানিকর, বৈষম্যপূর্ণ ও হুমকিমূলক। টুইটারে এমন নেতিবাচক পোস্ট হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ফিফার অভিযোগের পর এ ধরনের ২৩ শতাংশ পোস্ট মুছে ফেলেছে টুইটার কর্তৃপক্ষ।
মোট ১৯ হাজার ৬৩৬টি আপত্তিকর পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন জায়গায় করা হয়েছে। ফিফা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে এসব পোস্ট নিয়ে রিপোর্টও করেছে। টুইটারে এমন ১৩ হাজার ১০৫টি পোস্ট রিপোর্ট করেছে ফিফা। ফেসবুকে ৯৭৯টি পোস্ট, ইনস্টাগ্রামে ৫,৩৭০টি, টিকটকে ৬৯টি এবং ইউটিউবে ১১৩টি পোস্ট রিপোর্ট করেছে ফুটবলের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
ফিফার সোশ্যাল মিডিয়া প্রটেকশন সার্ভিসের এই ‘থ্রেট ম্যাট্রিক্স’ প্রতিবেদনে কোন মহাদেশ থেকে আপত্তিকর পোস্ট বেশি করা হয়েছে, সেসবও উঠে এসেছে। আপত্তিকর পোস্টের ৩৮ শতাংশই করা হয় ইউরোপ থেকে। ৩৬ শতাংশ আপত্তিকর পোস্ট করা হয়েছে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। এশিয়া থেকে ১০ শতাংশ আর উত্তর আমেরিকা ও আফ্রিকা থেকে ৮ শতাংশ করে আপত্তিকর পোস্ট করা হয়।
ম্যাচের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি আপত্তিকর পোস্ট হয়েছে কোয়ার্টার ফাইনালের ফ্রান্স-ইংল্যান্ড ম্যাচ নিয়ে। ম্যাচটিতে পেনাল্টি মিস করেছিলেন ইংল্যান্ড স্ট্রাইকার হ্যারি কেইন। এই ম্যাচ নিয়ে ১২ হাজারের বেশি পোস্ট ও মন্তব্য রিপোর্ট করেছে ফিফা। ফ্রান্স-আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ফাইনাল নিয়ে করা আপত্তিকর পোস্ট ও মন্তব্যের সংখ্যা এই তালিকায় দুইয়ে—১২ হাজারে কাছাকাছি। মরক্কো ও পর্তুগালের মধ্যকার কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ রয়েছে এরপরই—প্রায় ১১ হাজার আপত্তিকর পোস্ট ও নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়।
গ্রুপ পর্বে অন্য দলের তুলনায় মেক্সিকোর খেলোয়াড়দের নিয়ে প্রায় দ্বিগুণসংখ্যক আপত্তিকর পোস্ট করা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তবে টুর্নামেন্ট এগিয়ে চলার সঙ্গে ব্রাজিল, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের খেলোয়াড়দের নিয়ে করা আপত্তিকর পোস্টের সংখ্যা মেক্সিকোকেও ছাপিয়ে যায়। পুরো বিশ্বকাপে খেলোয়াড়, জাতীয় দল এবং ফেডারেশনের অফিশিয়াল অ্যাকাউন্টের উদ্দেশে দেওয়া আপত্তিকর বার্তার শিকার হওয়ায় অন্যদের ছাপিয়ে গেছে ফ্রান্স। বিশ্বকাপ রানার্সআপদের নিয়ে এমন প্রায় ৬ হাজার বার্তা চিহ্নিত করেছে ফিফার সোশ্যাল মিডিয়া প্রটেকশন সার্ভিস।
আপত্তিকর পোস্টের আরেক লক্ষ্য ছিল ব্রাজিল। ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়া দলটিকে উদ্দেশ্য করে ৩ হাজারের বেশি আপত্তিকর বার্তা পোস্ট করা হয়। এই তালিকায় তৃতীয় স্থানে ইংল্যান্ড। ইংলিশ খেলোয়াড়, জাতীয় দল ও ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এফএ) অ্যাকাউন্ট উদ্দেশ্য করে প্রায় ৩ হাজার বার্তা রিপোর্ট করা হয়েছে।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া আর্জেন্টিনা এই তালিকায় চতুর্থ—মেসিদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে দেড় হাজারের মতো আপত্তিকর বার্তা রিপোর্ট করেছে ফিফা। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল এমন বার্তা হজম করেছে ১ হাজারের একটু বেশি।
ফিফার সোশ্যাল মিডিয়া প্রটেকশন সার্ভিস কাতার বিশ্বকাপে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবে খেলোয়াড়, কোচ ও দলের অ্যাকাউন্ট লক্ষ্য করে ২ লাখ ৮৬ হাজার ৮৯৫টি মন্তব্য আড়াল (হাইড) করেছে। এর মধ্যে শুধু ফেসবুকেই ১ লাখ ৬৭ হাজার ১০৮টি মন্তব্য ‘মডারেট’ করেছে ফিফার সোশ্যাল মিডিয়া প্রটেকশন সার্ভিস। ইনস্টাগ্রামে সংখ্যাটা ১ লাখ ১৮ হাজার ৪১৩ আর ইউটিউবে ১ হাজার ৩৭৪ মন্তব্য মডারেট করা হয়।
গতকাল রোববার প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, কাতার বিশ্বকাপে খেলোয়াড়, জাতীয় দল ও ফেডারেশন নিয়ে আপত্তিকর পোস্ট করেছেন—এমন তিন শতাধিক মানুষকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের পরিচয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হবে এবং ‘বাস্তব দুনিয়ার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।
আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট চলাকালে খেলোয়াড়, কোচ ও অফিশিয়ালদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হেনস্তা হওয়া থেকে রক্ষা করতে গত বছর ফুটবলারদের সংগঠন ফিফপ্রোকে সঙ্গে নিয়ে একটি পরিকল্পনা করেছিল ফিফা। তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে তারা একটি প্যাকেজ বানায়, যার নাম সোশ্যাল মিডিয়া প্রটেকশন সার্ভিস। কাতার বিশ্বকাপে এই সার্ভিস ব্যবহার করেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কড়া নজরদারি করেছিল ফিফা।