মৌসুম শেষে লিভারপুলের দায়িত্ব ছাড়ছেন ক্লপ

লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপলিভারপুল ওয়েবসাইট

তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে লম্বা সময় ধরে শিরোপা-খরায় ভুগছিল অ্যানফিল্ডের ক্লাবটি। ট্রফি ক্যাবিনেটেও তখন ধুলার আস্তরণ। লিগ শিরোপা জেতার পেরিয়ে গেছে ২৫ বছর। ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরার বয়সেরও হয়ে গেছে এক দশক। এমনকি এফএ কাপে শিরোপা ছিল না ৯ বছর ধরে। এমন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়ে লিভারপুলের খোলনলচে বদলে দিয়েছিলেন ইয়ুর্গেন ক্লপ। ফিরিয়ে আনেন ইউরোপিয়ান ফুটবলে লিভারপুলের নতুন দিনও।

ক্লপ লিভারপুলকে শুধু শিরোপাই জেতাননি, বরং আলাদা এক ফুটবল–দর্শনও নিয়ে এসেছেন। কিন্তু সব ভালো কিছুরই নাকি কখনো না কখনো শেষ হতে হয়। সেই নিয়ম মেনে এবার শেষ হচ্ছে লিভারপুলে ক্লপ অধ্যায়ও। এই মৌসুম শেষেই লিভারপুল ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন জার্মান এই কোচ। তাঁর চুক্তির মেয়াদ ছিল ২০২৬ পর্যন্ত।

আরও পড়ুন

ক্লাব কর্তৃপক্ষকে গত নভেম্বরেই নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন ৫৬ বছর বয়সী জার্মান এই কোচ। আজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিভারপুলের ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট থেকেও এই খবর নিশ্চিত করা হয়, ‘এই মৌসুম শেষে লিভারপুল কোচের দায়িত্ব ছাড়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন ইয়ুর্গেন ক্লপ। ক্লাব কর্তৃপক্ষকে তিনি নিজের এই সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন।’ নিজের এই সিদ্ধান্তের পেছনে ‘দম ফুরিয়ে যাওয়া’কেই কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন ক্লপ। তিনি বলেছেন, ‘আমি বুঝতে পারছি যে এটা এই মুহূর্তে অনেক মানুষকে ধাক্কা দেবে। বিশেষ করে আপনি যখন প্রথমবারের মতো খবরটি শুনবেন। তবে আমি নিশ্চিতভাবেই এর ব্যাখ্যা দেব বা অন্তত দেওয়ার চেষ্টা করব।’

প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জেতার পর ইয়ুর্গেন ক্লপ
এএফপি

এরপর নিজের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিয়ে ক্লপ আরও বলেছেন, ‘আমি এই ক্লাবের সবকিছু ভালোবাসি। আমি এই শহরের সবকিছু ভালোবাসি। আমি সমর্থকদের সবকিছু ভালোবাসি। আমি দলটিকে ভালোবাসি, স্টাফদের ভালোবাসি। আমি সবকিছুই ভালোবাসি। এরপরও এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বুঝতেই পারছেন, আমি এটা সত্যিই চাই এবং নিজের সিদ্ধান্তকে সঠিক বলেই মনে করছি। ব্যাপারটা হচ্ছে, কীভাবে বলব, আমার আসলে প্রাণশক্তি ফুরিয়ে আসছে। এখন কোনো সমস্যা নেই। তবে আমি জানতাম, একসময় না একসময় আমাকে এই ঘোষণাটা দিতেই হবে। আমি এখন ভালো আছি। কিন্তু এটাও জানি, এই কাজটা আর দিনের পর দিন আমি করে যেতে পারব না।’ পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু না জানালেও, প্রিমিয়ার লিগের কোনো দায়িত্ব পালন না করার কথা নিশ্চিত করেছেন ক্লপ।

জার্মান ক্লাব মেইঞ্জ দিয়ে শুরু করলেও কোচ হিসেবে ক্লপের উত্থানটা মূলত বরুসিয়া ডর্টমুন্ডে। জার্মান ফুটবলে বায়ার্ন মিউনিখের রাজত্বে ধস নামিয়ে পরপর দুই মৌসুমে (২০১০–১১ ও ২০১১–১২) ডর্টমুন্ডকে এনে দেন লিগ শিরোপা। এমনকি ২০১২–১৩ মৌসুমে জার্মান ক্লাবটিকে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালেও নিয়ে যান ক্লপ। যদিও ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে হেরে যায় ডর্টমুন্ড। ডর্টমুন্ড অভিযান সম্পন্ন করে ২০১৫ সালের অক্টোবরে ক্লপ দায়িত্ব নেন লিভারপুলের। একসময়ের ফুটবল পরাশক্তিরা তখন কেবলই ঐতিহ্যের কঙ্কাল।

সেই দম ফুরিয়ে যাওয়া লিভারপুল ক্লপের হাত ধরে শুরু করে নতুন এক যাত্রা। মধ্যম সারিতে নেমে যাওয়া ক্লাবটিই ক্লপের হাত ধরে শুরু করে ওপরে ওঠার অভিযান। নিজের  ফুটবল–দর্শনে আস্থা রেখে অখ্যাত প্রতিভাবানদের দিয়ে পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে শুরু করেন ক্লপ। তাঁর হাত ধরেই মোহাম্মদ সালাহ, সাদিও মানে, রবার্তো ফিরমিনো, ভার্জিল ফন ডাইক ও আলিসন বেকাররা উঠে আসেন বিশ্বসেরার তালিকায়।

আরও পড়ুন

তাঁদের নিয়েই ২০১৫–২৪ এই ৯ বছরে লিভারপুলকে সম্ভাব্য সব কটি শিরোপা জিতেয়েছেন ক্লপ। এর মধ্যে তিনবার লিভারপুলকে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে তুলে একবার শিরোপা (২০১৮–১৯) জেতান ক্লপ। ২০১৯–২০ মৌসুমে ৩০ বছর পর এনে দেন প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা। এ ছাড়া একটি লিগ কাপ, একটি এফএ কাপ, একটি সুপার কাপ ও একটি ক্লাব বিশ্বকাপও এনে দেন ক্লপ। এর মধ্যে ব্যক্তিগত অর্জনের খাতাটাও সাফল্যের রঙে সাজিয়েছেন ক্লপ। ২০১৯ ও ২০২০ সালে জিতেছেন ফিফা বর্ষসেরা কোচের পুরস্কার। দুবার জিতেছেন প্রিমিয়ার লিগের মৌসুম সেরা কোচের পুরস্কারও।

এ সময়ে ক্লপ শুধু ট্রফিই জেতেননি। তিনি তাঁর ‘হেভিমেটাল’ ফুটবলকেও ইউরোপে বৈপ্লবিক এক ফুটবল–কৌশল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর ‘গেগেনপ্রেসিং’ ফুটবলের সামনে ইউরোপের অনেক নামজাদা ক্লাব এ সময় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। বলা যায়, প্রেসিংকে রীতিমতো শিল্পে রূপ দিয়েছিলেন ক্লপ।

সালাহর সঙ্গে লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ
রয়টার্স

এর মধ্যে গত মৌসুমে লিভারপুলের ব্যর্থতার পর ক্লপের ফুরিয়ে যাওয়ার রবও উঠেছিল। কিন্তু চলতি মৌসুমে ক্লপ বুঝিয়ে দিয়েছেন খুব সহজে হাল ছাড়ার পাত্র তিনি নন। চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেও অর্ধ মৌসুম পেরিয়ে বর্তমানে প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষে আছে লিভারপুল। আরেকটি লিগ শিরোপা জেতার সম্ভাবনাও বেশ উজ্জ্বল। কিন্তু এর মধ্যেই ক্লপের ক্লাব ছাড়ার ঘোষণা দলের মনোযোগে বড় প্রভাব ফেলবে কি না, সে প্রশ্নও সামনে এসেছে। অবশ্য মৌসুম শেষে অর্জন যা–ই থাকুক, লিভারপুল ইতিহাসে ক্লপের নামটা সোনার হরফেই লেখা থাকবে।