ডিফেন্ডারদের মূল কাজ গোল আটকানো। গোল করতে পারা বাড়তি যোগ্যতা। তবে ডিফেন্ডার হয়েও তপু বর্মণের গোল করার ক্ষুধাটা একটু বেশিই।
এ মৌসুমটা তপু শুরুই করেছিলেন গোল দিয়ে। চ্যালেঞ্জ কাপের ফাইনালে মোহামেডানের বিপক্ষে বসুন্ধরা কিংসের ৩-১ জয়ে প্রথম গোলটি তাঁর। ফেডারেশন কাপে ব্রাদার্সের বিপক্ষে কিংসের জয়ে একমাত্র গোলটিও।
একই টুর্নামেন্টে পুলিশ এফসির বিপক্ষে কিংসের ৩-১ জয়েও প্রথম গোলটি তপুর। প্রিমিয়ার লিগে ফর্টিস এফসির বিপক্ষেও গোল আছে তাঁর। গোল করেছেন রহমতগঞ্জ, ওয়ান্ডারার্সের বিপক্ষেও।
লিগে ৩, ফেডারেশন কাপে ২, চ্যালেঞ্জ কাপে ১—মৌসুমের মাঝপথেই তপুর গোল ৬টি। স্থানীয়দের মধ্যে পুলিশের আল-আমিন লিগে করেছেন ৭ গোল। ফেড কাপে ২টিসহ ৯ গোল তাঁর। লিগে ৫, ফেড কাপে ৩টিসহ রহমতগঞ্জের নাবিব নেওয়াজের ৮ গোল। তারপরই তপু।
আমি তো আসলে ডিফেন্ডারই। দলের স্বার্থে গোলের চেষ্টা করি। শেষ বাঁশির আগপর্যন্ত হাল ছাড়ি নাতপু বর্মণ, ডিফেন্ডার, বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল ও বসুন্ধরা কিংস
এ মৌসুমে ১৩ ম্যাচে কিংসের ৩৪টি গোলের ৬টি করে করেছেন ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার মিগুয়েল ফেরেইরা ও জোনাথন ফার্নান্দেজও। ৫ গোল ফরোয়ার্ড রাকিব হোসেনের। ফয়সাল আহমেদ ফাহিমের ৩ গোল। রাকিব-ফাহিমদের টপকে এ মৌসুমে কিংসের সেরা গোলদাতার তালিকায় চলে আসা তপুর জন্য বড় অর্জনই। ভক্তদের কাছ থেকে পাওয়া ‘বাংলার রামোস’ খেতাবের মর্যাদা ভালোই রাখছেন!
২০১১ সালে ঢাকা মোহামেডান দিয়ে প্রিমিয়ার লিগে তপুর শুরু। সাদা–কালোয় খেলেন ২০১৪ পর্যন্ত। ২০১৩ সালে ট্রেবলজয়ী শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্র মোহামেডানের কাছে লিগে দুবার হারে; প্রথম লেগে তপুর গোলে।
পেছন ফিরে তপু বলেন, ‘মনে আছে, সেদিন ভলিতে বিপ্লবদাকে (বিপ্লব ভট্টাচার্য) পরাস্ত করেছিলাম। ডিফেন্ডার হলেও গোল করতে পারব, ওই বিশ্বাসটা জন্মে ওই গোলেই।’
এই মৌসুমের আগপর্যন্ত ক্লাব জার্সিতে তাঁর গোল ছিল ১০টি। মোহামেডানের জার্সিতে ৩, সাইফ স্পোর্টিংয়ে ২, আবাহনীর হয়ে ১টি। কিংসের জার্সিতে আগের তিন মৌসুমে ৪টি। সব মিলিয়ে ক্লাবের হয়ে তপুর গোল এখন ১৬টি।
সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ৪টিসহ জাতীয় দলে ৬০ ম্যাচে ৬ গোল। সব মিলিয়ে ক্যারিয়ারে ২২ গোল। বাংলাদেশের অনেক শীর্ষ ফরোয়ার্ডেরও এত গোল নেই। জাতীয় দলের ফুটবলারদের মধ্যে তপুর গোলই এখন সবচেয়ে বেশি। ১৫ ম্যাচে শেখ মোরছালিনের ৫ গোল, নাবিব নেওয়াজের ৩০ ম্যাচে ৫ গোল। রাকিবের ৪১ ম্যাচে ৪ গোল।
জাতীয় দলে তপুর প্রথম গোল ২০১৫ কেরালা সাফে ভুটানের সঙ্গে, বাংলাদেশ ৩-০ জয়ে যেটি প্রথম গোল। ২০১৮ ঢাকা সাফে ভুটানের বিপক্ষে বাংলাদেশের ২-০ গোলের জয়ে পেনাল্টিতে প্রথম গোলটি তাঁর। পরের ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮৫ মিনিটে তপুর একমাত্র গোলেই জেতে বাংলাদেশ।
জাতীয় দলের জার্সিতে বাকি ৩ গোল ২০২১ সালে। মালদ্বীপ সাফে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ৫৬ মিনিটে পেনাল্টিতে গোল করে জেতান দলকে। ওই বছরই শ্রীলঙ্কায় চার জাতি টুর্নামেন্টে মালদ্বীপের বিপক্ষে ২-১ গোলের জয়ে পেনাল্টিতে ৮৬ মিনিটে জয়সূচক গোল করেন। অন্য গোলটি কাতারে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে ৮৪ মিনিটে। সেই গোলে ম্যাচ ১-১ ড্র হয়।
আফগানিস্তান ম্যাচটিই বেশি স্মরণীয় হয়ে আছে তপুর কাছে, ‘আফগানিস্তানের সঙ্গে সেই গোল করে অনেক প্রশংসা পাই। পাকিস্তানের সঙ্গে গোলটাও স্মরণীয়। এই দুটির কথাই আগে বলব।’
গোল নিয়ে আছে তিক্ত অভিজ্ঞতাও। ঘরোয়া ফুটবলে আবাহনীর বিপক্ষে তাঁর আত্মঘাতী গোলে পিছিয়ে পড়ে কিংস। পরে নিজেই গোল করে ম্যাচটা ড্র করেন, শাপমোচনও হয়।
ডিফেন্ডার হয়েও গোল করার সূত্রটা সাফজয়ী অধিনায়ক রজনী কান্ত বর্মণকে দেখেই নাকি রপ্ত করেছেন, ‘মোহামেডানে শুরুর সময় রজনীদাকে দেখেছি, সুইমিংপুলে জাম্পিং হেড করতেন। তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি, শিখেছি।’
ছয় ফুট উচ্চতা তপুর বাড়তি সুবিধাই। বেশির ভাগ গোলও করেছেন হেডে। কেউ যদি এখন আপনাকে স্ট্রাইকার বলে ডাকেন? তপু হেসে বলেন, ‘না না, আমি তো আসলে ডিফেন্ডারই। দলের স্বার্থে গোলের চেষ্টা করি। শেষ বাঁশির আগপর্যন্ত হাল ছাড়ি না।’
নারায়ণগঞ্জের কোচ জাকির হোসেনের কিনে দেওয়া বুট পরে ফুটবলজীবনের শুরু। বর্তমানে ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের কোচ জাকির বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে তপুকে ঢাকা আনেন সেন্টার–ব্যাক পজিশনে। আর পেছনে তাকাতে হয়নি। তবে ভোলেননি স্কুলজীবনের সেই দিনটা।
২০০৮ সালে তপু টাঙ্গাইলে খেলতে যান আন্তস্কুল ফাইনালে। নারায়ণগঞ্জের লক্ষ্মী নারায়ণ কটন মিলের হয়ে টাইব্রেকারে জেতেন। হেরে সেদিন স্থানীয়রা তপুদের ওপর চড়াও হয়। পুলিশের আশ্রয়ে গিয়েও রক্ষা মেলেনি। নারায়ণগঞ্জের দয়াল বর্মণের ছেলে তপু হাসতে হাসতে বলে যান সেই গল্প।