আর্জেন্টাইনরা ভালোবাসার প্রতিদানে ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে জানে বটে!
লিওনেল মেসি ভালোবেসেছেন আর্জেন্টিনার জার্সিকে। চার-চারটি বিশ্বকাপে অপেক্ষার পর আরাধ্য ট্রফিটির দেখা পেয়েছেন গত ডিসেম্বরে কাতারে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে মেসি বলেছিলেন, এই মুকুট পরে মাঠে নামার আনন্দ কী, তা মর্মে মর্মে অনুভব করতে আরও কিছুদিন জাতীয় দলে খেলা চালিয়ে যেতে চান। তখন থেকেই গোটা আর্জেন্টিনায় সুর উঠেছিল, তথাস্তু।
তোমাকে প্রাপ্য অভিবাদনই দেওয়া হবে প্রিয়!
মেসিরা আর্জেন্টাইনদের সেই অভিবাদন পেলেন আজ শুক্রবার বাংলাদেশ সময় ভোরে বুয়েনস এইরেসের এস্তাদিও মনুমেন্তাল স্টেডিয়ামে পানামার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর এটাই প্রথম ম্যাচ আর্জেন্টিনার। তাতে ২-০ গোলের জয় যেন স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা, তিনবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বীকৃতিস্বরুপ তিন তারকা জার্সি পরে মাঠে নামার সুখটাই মুখ্য ছিল মেসি-দি মারিয়াদের জন্য। আর আর্জেন্টাইনরা?
মনুমেন্তালে উপস্থিত প্রায় ৮৪ হাজার দর্শকের মধ্যে যে কারও মুখ দেখে মনে হয়েছে, এই ম্যাচের ফল তাঁদের কাছে কোনো বিষয়ই নয়। এই ম্যাচ দেশের জাতীয় বীরদের অভিবাদন জানানোর মঞ্চ। আর তাই ম্যাচ শুরুর প্রায় পাঁচ ঘণ্টা আগে খুলে দেওয়া হয়েছিল মনুমেন্তালের ফটক। ম্যাচের আগে কয়েক পর্ব উৎসব ছিল, মেসিরা তার মধ্যমণি আর পানামা যেন সেই উৎসবের 'কেক', বুয়েনস এইরেসের রাস্তায় জনতার ঢল নামাটা তাই অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।
কিন্তু মাঠে গিয়ে মেসিদের নিশ্চয়ই কিছুটা অস্বাভাবিক লেগেছে। আবহটা যে আর দশটা ম্যাচের মতো নয়! ডিজে ফের প্যালাসিও সুরে সুরে মাতিয়ে রেখেছেন দর্শকদের। দেখানো হয় কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দলের পারফরম্যান্সের ভিডিওচিত্র। পপ ব্যান্ড লস তোতোরা ও লা তাই লা এম ব্যান্ডও যোগ দেয় প্যালাসিওর সঙ্গে। ছিলেন ফার্নান্দো রোমেরো, কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা যে গানটা গেয়েছেন, সেই 'মুচাচোস' গানের গীতিকার। আর ছিলেন তুলা, ফিফা 'বেস্ট' অনুষ্ঠানে সেরা সমর্থকের পুরস্কারজয়ী আর্জেন্টিনা সমর্থকদের প্রতিনিধি হিসেবে থাকা সেই বৃদ্ধ। গলায় সেই চিরাচরিত ব্যান্ড। তুমুল বাজাচ্ছিলেন।
মেসি-মার্তিনেজরা স্টেডিয়ামের টানেল দিয়ে মাঠে ঢুকতেই কোলাহলে ফেটে পড়ে মনুমেন্তালের গ্যালারি। তিন সন্তান নিয়ে মার্তিনেজের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন মেসি। ডাগআউটে কোচ লিওনেল স্কালোনির সঙ্গেও পরিবারের সদস্য, অন্য খেলোয়াড়দের পরিবারের দু-একজন সদস্যও উপস্থিত ছিলেন। আর্জেন্টিনার ট্যাঙ্গো গায়ক আরিয়ে আর্দিত জাতীয় সঙ্গীতের সুর তুলতেই গলা মেলাতে শুরু করে গোটা স্টেডিয়াম। জ্বলে ওঠে আতশবাজির রোশনাই। সাদা ধোঁয়ার ভেলা, দর্শকের চোখে আনন্দাশ্রু, কেউ চোখ মুছছেন, মেসিদের হৃদয় এর মধ্যে শান্ত থাকে কীভাবে!
ক্যামেরা ধরতেই বোঝা গেল, মেসি কাঁদছেন। পাশে এমিলিয়ানো মার্তিনেজেরও ভেজা চোখ। ডাগআউটে স্কালোনিও চোখ মুছছেন। এই অশ্রু ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনাকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বানানোর আনন্দাশ্রু! পানামা তাতে স্রেফ উপলক্ষ। অন্য সময় হলে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ৬১তম দলের বিপক্ষে দ্বিতীয় দলের মাত্র দুই গোলের জয় নিয়ে আর্জেন্টিনায় নিশ্চয়ই কথা শুরু হতো। কিন্তু এ লগ্ন তেমন নয়। আর তাই লিওনেল মেসি ফ্রি–কিক থেকে দুবার পানামার পোস্ট কাঁপালেও লোকে হয়তো ভুলে যাবে। আবার আরেকটি ফ্রি–কিক থেকে করা তাঁর দুর্দান্ত গোলটি ঠিকই মনে রাখবে।
৭৮ মিনিটে মেসির বাঁকানো ফ্রি–কিক পানামার পোস্টে লেগে ফিরলে লিয়ান্দ্রো পারেদেস ভলি করতে গিয়ে পারেননি। পাশেই দাঁড়ানো থিয়াগো আলমাদা বাঁ পায়ের শটে গোল করেন। প্রথমার্ধের ১৮ মিনিটেও ফ্রি–কিক থেকে বল পোস্টে মারেন মেসি। তাঁর কিছুক্ষণ আগেই আঘাত পান ডান পায়ে। পানামার কেভিন গ্যালভিনের ট্যাকলে মেসির হাঁটু ছিলে যায়। রক্ত ঝরছিল।
প্রথমার্ধে মেসি ও দি মারিয়াকে নিয়ে ডান পাশ দিয়ে বেশির ভাগ আক্রমণ করেছে আর্জেন্টিনা। ৪৪ মিনিটে দুরপাল্লার শটে পানামার গোলকিপার গুয়েরার পরীক্ষা নেন এনজো ফার্নান্দেজ। ৫২ মিনিটে মেসির আরেকটি ফ্রি–কিক দারুণভাবে ঠেকান গুয়েরা। কিন্তু ৮৯ মিনিটে গিয়ে পারেননি। এবার মেসির বাঁকানো শট ঠিকই ঢুকে পড়ে জালে। আর্জেন্টিনার জার্সিতে মেসির ৯৯তম গোল আর ক্লাব ও জাতীয় দল মিলিয়ে ৮০০তম! বার্সেলোনার জার্সিতে ৬৭২ গোল তাঁর। পিএসজির হয়ে ২৯।
কাতার বিশ্বকাপ ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে নামানো একাদশই এ ম্যাচে খেলান স্কালোনি। সমর্থকদের যেন সেই ম্যাচের নির্যাস পাইয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পানামা বেরসিক দল। ফ্রান্সের মতো প্রাণপণ লড়াই করতে না পারুক, আর্জেন্টিনার পোস্টে একটি শটও রাখতে না পারাটা বেরসিক খেলা ছাড়া আর কী! মেসিরা ৭৪ শতাংশ সময় বল দখলে রেখে ৯টি শট নিয়ে সব কটি পোস্টে রেখেছেন। বিরতির পর গোলের সুযোগ বেশি পেয়েছে আর্জেন্টিনা। উৎসবের মেজাজে থাকায় হয়তো রুচি হয়নি। ফার্নান্দেজ, দি মারিয়ারা তাই দু-একটি সুযোগ মিস করছেন, বলাই যায়!
বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার এই উৎসবে পানামা-কেকটা দুই পোঁচে কেটে অনুষ্ঠানের শেষ অংশে চলে যায় আর্জেন্টাইনরা। আরাধ্য সেই বিশ্বকাপ ট্রফির রেপ্লিকা ম্যাচ শুরুর আগেই মাঠে রাখা হয়েছিল। জয়ের পর আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্লদিও তাপিয়ার উপস্থিতিতে ট্রফিটা মাঠে নিয়ে আসা হয়। দি পল-ম্যাক অ্যালিস্টাররা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বিশ্বকাপ ও সর্বকালের অন্যতম সেরা তারকা মেসিকে মাঝে রেখে অভিবাদন জানান।
মেসিও তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা অর্জনের পাশে দাঁড়িয়ে ধন্যবাদ জানান সমর্থকদের, ‘এই তুমুল সমর্থনের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। (বিশ্বকাপ ট্রফি দেখিয়ে) আমরা এটার জন্য যা যা করা সম্ভব, সবই করেছি।’
আর্জেন্টাইনদের চেয়ে তা ভালো জানে কে! মনুমেন্তাল যেন মেসির কথায় সায় দিতেই আরেকবার গর্জে উঠল!