‘ভবিষ্যতের মেসি’ এখনই কেন বাতিলের খাতায়
যেকোনো দলের ১০ নম্বর জার্সিটা কার গায়ে থাকে?
দলের সবচেয়ে ভালো, আক্রমণভাগের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল আর আস্থাশীল খেলোয়াড়টির গায়েই তো, নাকি? যুগে যুগে ১০ নম্বর জার্সিকে যাঁরা ‘মহিমান্বিত’ করে তুলেছেন, তাঁদের একজন লিওনেল মেসি। ২০২১ সালে আর্জেন্টাইন মহাতারকা বার্সেলোনা ছেড়ে যাওয়ার পর ‘১০ নম্বর’ জার্সিটা কে পেয়েছিলেন জানেন নিশ্চয়ই—আনসু ফাতি। বার্সেলোনা তখন ১৮ বছর বয়সী ফাতির ওপর এত বড় ‘বাজি’ ধরেছিল যে ক্লাবের অর্থ বিভাগ মেসিকে ধরে রাখার টাকা জোগাড় করতে অন্য কয়েকজনসহ ফাতিকে বিক্রি করে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেও সেটি নাকচ করে দিয়েছিলেন সভাপতি হুয়ান লাপোর্তা। বছরের পর বছর ধরে ‘সোনার ডিম পেড়ে আসা’ মেসির চেয়ে ফাতি নামের ‘ভবিষ্যৎ’কেই তখন প্রাধান্য দিয়েছিল বার্সা।
সোয়া তিন বছর পর সেই ফাতিকেই এখন যেকোনো একটা ক্লাবে ‘গছিয়ে’ দিতে চায় বার্সেলোনা। কারণ, এই ফাতি ‘চলে না’। কোচ হান্সি ফ্লিক কখনো তাঁকে স্কোয়াডে রাখেন না, কখনো স্কোয়াডে রাখলেও মাঠে নামান না, কখনো আবার মাঠে নামালেও শুরুর একাদশে খেলান না। এই করে করে ২০২৪-২৫ মৌসুমের প্রথম অর্ধেকে ফাতিকে খেলানো হয়েছে মোটে ১৮৬ মিনিট। কদিন আগে বার্সেলোনা কোচ স্পষ্ট স্বরেই বলেছেন, ফাতিকে তিনি থেকে যাওয়া ও চলে যাওয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, ‘নতুন মেসি’ হিসেবে আবির্ভূত হওয়া ফাতি এখন কেন ব্রাত্য? বার্সেলোনার ‘ভবিষ্যৎ’ হিসেবে বিবেচিত ‘১০ নম্বর’ জার্সির মালিক কেন মাঠে সুযোগ পান না?
না, কোচের সঙ্গে কোনো দূরত্ব নেই। চোটে তিনি পড়েছেন এবং পড়েন বটে, কিন্তু ‘বেপথু’ হওয়ার পেছনে চোট প্রধানতম কারণ নয়। তাহলে ২০২৭ সাল পর্যন্ত বার্সার চুক্তিতে থাকা ফাতির কেন এমন হাল? এই যে এখন, বার্সেলোনোর বেশির ভাগ ম্যাচে লামিনে ইয়ামালকে নতুন নতুন রেকর্ডে নাম লেখাতে দেখা যায়। এই রেকর্ডের অনেকগুলোই ছিল ফাতির দখলে।
২০১৯ সালে ১৬ বছর ২৯৮ দিন বয়সী ফাতির যখন বার্সেলোনার মূল দলে অভিষেক হয়, সেটি ছিল ৭৮ বছরের মধ্যে বার্সায় সবচেয়ে কম বয়সে খেলার রেকর্ড। এরপর ১৬ বছর ৩০৪ দিন বয়সে যে গোলটি করেন, সেটি ছিল বার্সার হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে গোলের রেকর্ড, যা বহাল এই ইয়ামালের যুগেও।
এরপর তো দিনে দিনে শুধু একের পর এক রেকর্ডই জমা হয়েছে—ক্লাবের হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলা (১৬ বছর ৩২১ দিন), চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে গোল করা (১৭ বছর ৪০ দিন), স্প্যানিশ লা লিগায় সবচেয়ে কম বয়সে জোড়া গোল, চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে একাধিক গোল করা। এ ছাড়া ক্লাবে, লিগে, এল ক্লাসিকোয়, মহাদেশীয় প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বকনিষ্ঠের রেকর্ড তো আছেই।
অপরাজেয় সেই যাত্রায় প্রথম হোঁচট হয়ে আসে চোট। ২০২০ সালের নভেম্বরে হাঁটুর চোটে পড়েন ফাতি, ছিটকে যান ৯ মাসের জন্য। তবে পরের মৌসুমে মাঠে ফেরেন বেশ ঝরঝরে হয়ে। বার্সেলোনাও মেসির রেখে যাওয়া ১০ নম্বর জার্সি তুলে দেয় তাঁর গায়ে। তবে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে হ্যামস্ট্রিং চোট এসে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেয় তিন মাসের জন্য। পরে মাঠে ফিরলেও হারিয়ে ফেলেন চনমনে ছন্দ। ক্রমাবনতির দিকে যেতে থাকে গতি, দম আর ক্ষিপ্রতা। সেই সঙ্গে আস্থা উঠে যেতে থাকে কোচের।
২০২২-২৩ মৌসুম শেষে দেখা যায়, কোচ জাভি হার্নান্দেজ তাঁকে সারা বছরে লিগে পুরো ৯০ মিনিট খেলিয়েছেন মাত্র এক ম্যাচে। ২৪টিতেই করেন বদলি। ‘ভবিষ্যতের মেসি’ জাভির আস্থা এতটাই হারিয়ে বসেন যে কোচ স্পষ্টতই বলে দেন, ‘ওর নিয়মিত সুযোগ পাওয়ার নিশ্চয়তা আমি দিতে পারছি না। এটা বার্সেলোনা, এনজিও নয়।’
এরপর যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে। ফাতিকে ধারে পাঠানো হয় ইংলিশ ক্লাব ব্রাইটনে। কিন্তু ফাতি আর ফাতিতে ফিরতে পারেননি। প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবটিতে ২৭ ম্যাচে ৪ গোলের মৌসুম কাটিয়ে এ মৌসুমের শুরুতে আবার বার্সায় ফিরেছেন। কিন্তু বার্সেলোনার নতুন কোচ ফ্লিকও জাভির মতো আস্থা রাখতে পারছেন না। রাখার মতো পরিস্থিতিই–বা ফাতি তৈরি করতে পারছেন কই?
লা লিগায় ৪ আর চ্যাম্পিয়নস লিগে ৩টিসহ মোট ৮ ম্যাচে মাঠে নেমেছেন। কিন্তু উইঙ্গার হলেও গোল তো নেই–ই, গোলে সহায়তাও নেই। চ্যাম্পিয়নস লিগে সর্বশেষ বেনফিকার বিপক্ষে ম্যাচে তাঁকে দলে রেখেছিলেন ফ্লিক। কিন্তু দানি ওলমো না থাকার সুবাদে স্কোয়াডে থাকলেও নিজেকে মাঠে নামার পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেননি ফাতি।
সর্বশেষ যা খবর, তাতে বার্সেলোনা এখন ফাতির জন্য নতুন ঠিকানা খুঁজছে। স্রেফ ধারে পাঠানোর জন্যই নয়, সম্ভব হলে পাকাপাকি ট্রান্সফার হিসেবেই। কিন্তু চলমান শীতকালীন দলবদলে কেউ তাঁর জন্য গরম কোনো হাঁক চড়াবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। চার বছর আগে যে ফাতির ট্রান্সফারমার্কেটে দর ছিল ৮ কোটি, সেই একই খেলোয়াড় এখন ১ কোটিতে বিকোয় কি না, সন্দেহ। অথচ বয়সটা মাত্রই ২২!