ইউনাইটেডের ‘বাতিলরা’ মাঠ মাতাচ্ছেন অন্য ক্লাবের হয়ে
স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের সময়ে বলা হতো, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জিততে জিততে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সেই ইউনাইটেড ফার্গুসন-পরবর্তী সময়ে লিগ শিরোপা জিততে ভুলে গেছে।
এফএ কাপ, লিগ কাপের (কারাবাও কাপ নামে পরিচিত) ট্রফিও নিয়মিত ছুঁয়ে দেখা হয় না। চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের ধারেকাছে যাওয়া দূরে থাক, মাঝেমধ্যে এই প্রতিযোগিতায় খেলার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারে না।
২০১৩ সালে ফার্গুসনের অবসরের পর ১০ জন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের স্থায়ী অথবা অস্থায়ী কোচ হিসেবে ডাগআউটে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু স্বপ্নের রঙ্গমঞ্চ ওল্ড ট্রাফোর্ডে কেউ সুদিন ফেরাতে পারেননি। উল্টো কয়েকজন কোচ খেলোয়াড়দেরই বলির পাঁঠা বানিয়েছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোর কথা বললে সবার আগে আসবে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর নাম। এরিক টেন হাগ কোচ থাকাকালে ইউনাইটেডে ব্রাত্য হয়ে পড়েছিলেন রোনালদো। পর্তুগিজ মহাতারকাকে ম্যাচের পর ম্যাচ বদলি নামিয়েছেন টেন হাগ, কখনো কখনো বসিয়েও রেখেছেন। স্বাভাবিকভাবেই দুজনের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। তাই ইউনাইটেডের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেন রোনালদো।
রাশফোর্ড, আন্তনি, মার্শিয়াল, ম্যাসনউডদের বৃহস্পতি যখন তুঙ্গে, তখনো শনির দশা কাটিয়ে উঠতে পারেনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
টেন হাগের চোখে ‘বুড়িয়ে ও ফুরিয়ে যাওয়া’ রোনালদোই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছাড়ার পর নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছেন। সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসরের হয়ে ৯৮ ম্যাচে করে ফেলেছেন ৮৮ গোল, গোলে সহায়তা করেছেন ১৯টি। যদিও ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মানের সঙ্গে সৌদি লিগের তুলনা চলে না। তবে ৪০ বছর বয়সী রোনালদো দেখিয়েছেন, তিনি আসলে ফুরিয়ে যাননি। এখনো যেকোনো পর্যায়ে ধারাবাহিক পারফর্ম করার মতো ফিট তিনি।
২০২৪–২৫ মৌসুমেও যেসব ফুটবলার ধারে বা একেবারে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছেড়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই সাফল্য পাচ্ছেন; বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ইউনাটেডের সংস্কৃতি, খেলার ধরন ও কোচের কৌশলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারলেও তাঁরা ফুরিয়ে যাননি। নতুন ঠিকানায় গিয়ে ঠিকই নিজেদের ফিরে পেয়েছেন। অ্যান্থনি মার্শিয়াল, ম্যাসন গ্রিনউড, টিরেল মালাসিয়া, স্কট ম্যাকটমিনে, আন্তনিরা সেটারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
নিজেকে প্রমাণের বাকি ছিল শুধু মার্কাস রাশফোর্ডের। পরশু রাতে চেলসির বিপক্ষে অ্যাস্টন ভিলার ২–১ গোলের জয়ে দুটিতেই বলের জোগান দিয়ে তা করে দেখিয়েছেন তিনি।
ইউনাইটেডের বর্তমান কোচ রুবেন আমোরিমকে সন্তুষ্ট করতে না পারায় একাদশে জায়গা হারান রাশফোর্ড। তখনই গুঞ্জন ওঠে, শীতকালীন দলবদলে ওল্ড ট্রাফোর্ড ছাড়তে পারেন এই ইংলিশ ফরোয়ার্ড।
সৌদি প্রো লিগের পক্ষ থেকে রাশফোর্ডকে সপ্তাহে ১০ কোটি ২২ লাখ টাকা বেতনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি এখনই ইউরোপ ছাড়তে চাননি। তবে ইউনাইটেড ছেড়ে এমন কোথাও যেতে চেয়েছেন, যে ক্লাব এবার চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলছে।
শেষ পর্যন্ত এ মাসের শুরুর দিকে ইউনাইটেড ছেড়ে ধারে অ্যাস্টন ভিলায় যোগ দেন রাশফোর্ড। ভিলার হয়ে প্রথম তিন ম্যাচে তেমন কিছু করতে না পারলেও পরশু রাতের ম্যাচে দ্বিতীয়ার্ধে বদলি নেমে দুটি গোলই বানিয়ে দিয়েছেন।
শীতকালীন দলবদলেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে ধারে রিয়াল বেতিসে যোগ দিয়েছেন আরেক ফরোয়ার্ড আন্তনি। স্প্যানিশ ক্লাবটির জার্সিতে এই ব্রাজিলিয়ান পাঁচ ম্যাচে করেছেন ৩ গোল, সতীর্থকে দিয়ে করিয়েছেন ১টি, পেনাল্টি আদায়ও করে দিয়েছেন ১টি। ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছেন তিনবার। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে যেখানে ৬২ ম্যাচে করেছিলেন মাত্র ৫ গোল, সেখানে লা লিগায় ৩ ম্যাচেই ২টি গোল তাঁর।
সম্প্রতি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছেড়েছেন টিরেল মালাসিয়াও। নেদারল্যান্ডসের এই লেফটব্যাক ধারে যোগ দিয়েছেন স্বদেশি ক্লাব পিএসভি আইন্দহফেনে। ক্লাবটির হয়ে খেলেছেন দুটি ম্যাচ। এর একটিতে পিএসভি ড্র করেছে, অন্যটিতে ইতালিয়ান পরাশক্তি জুভেন্টাসকে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে ছিটকে দিয়েছে। নেদারল্যান্ডসের শীর্ষ লিগেও (ডাচ এরেডিভিজি) দারুণ খেলছে পিএসভি। বর্তমানে পয়েন্ট তালিকার দুইয়ে আছে মালাসিয়ার নতুন দল।
এ মৌসুমের শুরুতে ইউনাইটেডকে বিদায় বলে দেওয়া আরেক ফুটবলার স্কট ম্যাকটমিনে। স্কটিশ এই মিডফিল্ডার নাম লিখিয়েছেন ইতালিয়ান ক্লাব নাপোলিতে। ২০২৩–২৪ মৌসুমে ম্যাকটমিনেকে অনেক ম্যাচে শুরুর একাদশে রাখেননি টেন হাগ।
কিন্তু নাপোলি কোচ আন্তনিও কন্তে শুরু থেকেই তাঁর ওপর আস্থা রাখছেন। ম্যাকটমিনেও আস্থার প্রতিদান দিচ্ছেন মাঝমাঠ দারুণভাবে সামলে। ক্লাবটির হয়ে তিনি এখন পর্যন্ত করেছেন ৭ গোল, সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন ৪টি।
নাপোলিও সিরি ‘আ’–এর ট্রফি (স্কুদেত্তো নামে পরিচিত) জেতার লড়াইয়ে ভালোভাবে টিকে আছে। ৫৬ পয়েন্ট নিয়ে দুইয়ে আছে তারা। শীর্ষে থাকা ইন্টার মিলানের পয়েন্ট ১ বেশি। আগামী শনিবার ইন্টার মিলানেরই মুখোমুখি হবে নাপোলি। সেই ম্যাচ জিততে পারলে চূড়ায় উঠে আসবে ম্যাকটমিনের দল।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা আরেক ফুটবলার অ্যান্থনি মার্শিয়াল। ফরাসি এই ফরোয়ার্ড এ মৌসুমে যোগ দিয়েছেন গ্রিসের ক্লাব এইকে এথেন্সে। তিনিও ক্লাবটির সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে নিয়েছেন। এ মৌসুমে এখন পর্যন্ত করেছেন ৯ গোল, গোলে সহায়তা করেছেন ২টি। গ্রিক সুপার লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় আছেন শীর্ষ পাঁচে। এথেন্স আছে পয়েন্ট তালিকার দুইয়ে।
ইউনাইটেড একাডেমি থেকে উঠে আসা ম্যাসন গ্রিনউডও ২০২৪–২৫ মৌসুমে ওল্ড ট্রাফোর্ড ছেড়েছেন। ইংল্যান্ডের এই ফরোয়ার্ডের বর্তমান ঠিকানা ফরাসি ক্লাব অলিম্পিক মার্শেই। ক্লাবটির হয়ে ২৬ ম্যাচে ১৫ গোল করেছেন ম্যাসনউড, অ্যাসিস্ট আছে ৪টি। লিগ আঁ–তে শীর্ষ গোলদাতাদের তালিকায় তাঁর অবস্থান দুইয়ে। ২০২৩–২৪ মৌসুমে পয়েন্ট তালিকার আটে থেকে লিগ শেষ করা মার্শেইও এবার আছে দুইয়ে।
রাশফোর্ড, আন্তনি, মার্শিয়াল, ম্যাসনউডদের বৃহস্পতি যখন তুঙ্গে, তখনো শনির দশা কাটিয়ে উঠতে পারেনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। পরশু এভারটনের সঙ্গে ২–২ গোলে ড্রয়ের পর পয়েন্ট তালিকার ১৫ নম্বরেই পড়ে আছে আমোরিমের দল। সামনে বেশ কয়েকটি বড় ম্যাচ থাকায় অবনমন অঞ্চলে ঢুকে পড়ার শঙ্কাও আছে।
এমন পরিস্থিতি থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় ক্লাব কর্তৃপক্ষকেই খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু রাশফোর্ড, আন্তনি, ম্যাসনউডরা ছন্দ ফিরে পাওয়ার একটা উপায় ঠিকই খুঁজে বের করছেন। ইউনাইটেড ছাড়লেই তো সাফল্য নিশ্চিত!