স্কালোনির আর্জেন্টিনার সামনের দিনে যে চ্যালেঞ্জ
গত রোববার বিশ্বকাপ জয়ের ছয় মাস পূর্তি উদ্যাপন করেছে আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপের পর এরই মধ্যে চারটি প্রীতি ম্যাচও খেলে ফেলেছে লিওনেল মেসিরা, জিতেছেন প্রতিটিতেই। বলা যায়, জয়রথ ধরে রেখেই দারুণভাবে ছুটছে ‘আলবিসেলেস্তে’রা। তবে বিশ্বকাপ জয়ের উৎসবের ঘোর সম্ভবত কাটিয়ে ওঠার সময় এসেছে এখন। অতীতের সুখস্মৃতিকেই সঙ্গে নিয়েই প্রস্তুত হতে হবে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়।
৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ পুনরুদ্ধার করে আর্জেন্টিনা প্রথম প্রীতি ম্যাচ খেলে পানামার বিপক্ষে। সেই ম্যাচ ২–০ গোলে জেতেন মেসিরা। পরের ম্যাচে কুরাসাওয়ের বিপক্ষে আর্জেন্টিনা জিতেছে ৭–০ গোলে। এরপর সম্প্রতি এশিয়া সফরে অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনার জয়ের ব্যবধান ২–০।
তবে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা দলের সঙ্গে করা এই পারফরম্যান্সে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার সুযোগ নেই। কাতার বিশ্বকাপের সাফল্য ধরে রাখতে কার্যকর পরিকল্পনা নিয়েই সামনে এগোতে হবে স্কালোনিকে। এরই মধ্যে কাতার বিশ্বকাপ দিয়ে একটি চক্র পূরণ করেছেন আর্জেন্টাইন এই কোচ। সেই সাফল্যের পুনরাবৃত্তির লক্ষ্য নিয়ে এখন দ্বিতীয় চক্রের পরিকল্পনা সাজাতে হবে স্কালোনিকে।
নতুন চক্রে স্কালোনির সামনে চূড়ান্ত লক্ষ্য বিশ্বকাপ হলেও এর আগে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধাপ পার করতে হবে তাঁকে। যেখানে স্কালোনির দলের জন্য প্রথম ধাপ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডায় হতে যাওয়া ২০২৬ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব। আর্জেন্টিনার এই চ্যালেঞ্জ শুরু হবে সেপ্টেম্বরে ইকুয়েডরের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। আগামী বিশ্বকাপে বদলে যাচ্ছে ফরম্যাট।
নতুন ফরম্যাটে ৩২ দলের পরিবর্তে ৪৮টি দল বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পাবে। ফলে বিশ্বকাপে লাতিন আমেরিকা থেকে সরাসরি অংশ নেওয়া দলের সংখ্যাও বাড়বে। ২০২৬ বিশ্বকাপে কনমেবল থেকে সরাসরি খেলার সুযোগ পাবে ৬ দল। আর একটি দল সুযোগ পাবে আন্তমহাদেশীয় প্লে অফ খেলার। তাই বিশ্বকাপের দল বিবেচনায় অন্য সময়ের চেয়ে এবার কোয়ালিফাইয়ের পরীক্ষাটা কিছু সহজই হবে। তবে নিজের দল নিয়েই বেশ কিছু পরীক্ষা অপেক্ষা করছে স্কালোনির জন্য। আর স্কালোনির জন্য দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে, আগামী বছরের কোপা আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত এই টুর্নামেন্ট দিয়েই মূলত আর্জেন্টিনা দলের বিশ্বকাপ প্রস্তুতির একটা ধারণা পাওয়া যাবে।
আর্জেন্টিনা দলে বর্তমানে বেশ কিছু নতুন খেলোয়াড় আসতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে এশিয়ান সফরে অভিষেক হয়েছে আলেসান্দ্রো গারনাচো ও ফাকুন্দো বুয়োনানোত্তের মতো দুই তরুণের। যাঁদের দুজনেরই বয়স এখনো মাত্র ১৮–এর ঘরে। কাতার বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে খেলা ফাকুন্দো মেদিনাকেও আবার দলে ডেকেছেন স্কালোনি। এ ছাড়া নতুন–পুরোনো মিলিয়ে আরও কয়েকজন খেলোয়াড়কে দলে ডেকেছেন আর্জেন্টিনা কোচ। সামনের দিনগুলোতে আরও বেশ কয়েকজন নতুন তারকার আবির্ভাব ঘটতে পারে আর্জেন্টাইন শিবিরে।
নতুনদের এই উত্থানের কারণে সামনের দিনগুলোতে আর্জেন্টিনা দলের সমন্বয়ে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। এ পরিস্থিতিতে স্কালোনির নতুন চ্যালেঞ্জ হবে বিশ্বকাপের সাফল্যের চক্র ভেঙে তরুণ এবং প্রতিভাবানদের জন্য দলে জায়গা তৈরি করা। সামনের দিনে স্কালোনি এই কাজ কতটা দক্ষতার সঙ্গে করতে পারেন তার ওপর নির্ভর করছে আর্জেন্টিনার সাফল্য–ব্যর্থতার অনেকটাই
বিশ্বকাপের পর আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়ী তারকাদের চাহিদাও এখন তুঙ্গে। দলবদলে তাঁরা এখন দারুণ গুরুত্ব পাচ্ছেন। কেউ কেউ এরই মধ্যে দলবদল সেরেও ফেলেছেন। এনজো ফার্নান্দেজ যেমন বিশ্বকাপের পর বেনফিকা থেকে ইংলিশ ক্লাব চেলসিতে গেছেন। ব্রাইটন ছেড়ে অ্যালেক্সিস ম্যাক আলিস্টার গেছেন লিভারপুলে। থিয়াগো আলমাডাকে নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে এসি মিলান ও নাপোলি, যিনি বর্তমানে মেজর লিগ সকারের (এমএলএস) ক্লাব আটলান্টায় খেলেন।
অন্য দিকে হেলাস ভেরোনা থেকে ধারে আনা জিওভানি সিমিওনেকে পাকাপাকিভাবে রাখতে চায় নাপোলি। আর বেনফিকাও নাকি এখন চুক্তি নবায়ন করতে চায় নিকোলাস ওতামেন্দির সঙ্গে। এ ছাড়া অন্যদের মধ্যে ক্লাব বদলে পিএসজি থেকে মেসি চলে গেছেন ইন্টার মায়ামিতে। জুভেন্টাস ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে দি মারিয়া এখন নতুন ক্লাবের অপেক্ষায় আছেন। সামনের দিনে দলবদলে গন্তব্য বদলাতে পারে আরও কয়েকজনের। খেলোয়াড়দের এই ক্লাব বদলানোর প্রত্যক্ষ–পরোক্ষ প্রভাব পড়বে জাতীয় দলেও। খেলার ধরন, পরিবেশ ও গুরুত্ব সবকিছু বদলে যাবে। স্কালোনি সেসবের সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে নেন তার ওপরও নির্ভর করছে অনেক কিছু।
তবে স্কালোনির সামনে যে নামটি সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে, সেটি আর কারও নয়, স্বয়ং মেসির। ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম নায়ক এশিয়া সফরে এসে কথা বলেছেন নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে। যেখানে ২০২৬ সালে বিশ্বকাপ খেলার সম্ভাবনায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন তুলে দিয়েছেন আর্জেন্টাইন মহাতারকা। এখন অনেক ‘যদি’, ‘কিন্তু’ ওপর নির্ভর করছে মেসির ভবিষ্যৎ। মেসি অবশ্য, নীতিগতভাবে পরের বিশ্বকাপ না খেলার কথা বলেছেন। এ পরিস্থিতিতে স্কালাোনিকে বিকল্প মাথায় রেখেই পরের বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবতে হবে।
যেহেতু মেসি সরাসরি না বলে দেননি, তাই আর্জেন্টাইন কোচকে এখন দুটি পথই খোলা রেখে সামনে এগোতে হবে। মেসি থাকলে দলকে সাজাতে হবে একভাবে। আর মেসি যদি শেষ পর্যন্ত আর দলে না থাকেন, তাহলে স্কালোনিকে বেশ সূক্ষ্মভাবে সব কিছু নিয়ে ভাবতে হবে। এই মুহূর্তের বাস্তবতা হচ্ছে, মেসির বিকল্প পাওয়া সম্ভব নয়। তাই অন্তত যাঁকে ঘিরে দল খেলবে, এমন কাউকে বেছে নিতে হবে স্কালোনিকে। এ ছাড়া দি মারিয়াসহ অন্য যেসব খেলোয়াড়ের জাতীয় দলে দীর্ঘ ভবিষ্যৎ নেই, তাঁদের স্থায়ী বিকল্পও খুঁজে নিতে হবে আর্জেন্টাইন কোচকে।
স্কালোনির জন্য আরেকটি বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে—সাফল্যের ক্লান্তি। দীর্ঘ সময় শিরোপা খরায় থেকে ক্ষুধার্ত ছিল আর্জেন্টিনা। গত কয়েক বছর কোপা আমেরিকা, ফিনালিসিমা এবং সর্বোপরি বিশ্বকাপ জিতে চক্র পূরণ করেছে তারা। ফলে দলটির মাঝে এখন ভর করতে পারে সব কিছু পেয়ে যাওয়ার ক্লান্তি বা ক্ষুধাহীনতা। সব মিলিয়ে সামনে অপেক্ষমাণ এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্কালোনি কী উদ্যোগ নেন, সেটিই এখন দেখার অপেক্ষা।