মেসির জন্মশহর: অপরাধ–সাম্রাজ্যে যে আশ্চর্য পরিবর্তন
নার্কো ক্যাপিটাল বা মাদক রাজধানী—লিওনেল মেসির জন্মশহর রোজারিওকে অনেকে এই নামেও চিনে থাকেন। মাদকের বিস্তারকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের আধিক্যের কারণে আর্জেন্টিনার সান্তা ফে রাজ্যের শহরটির কুখ্যাতি আছে। তবে মেসি ও আনহেল দি মারিয়ার এলাকার মানুষ হিসেবে গর্বিত রোজারিওবাসীর জন্য স্বস্তির এক খবর বেরিয়েছে সম্প্রতি।
খবরটি হচ্ছে, রোজারিওতে সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধপ্রবণতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এই খবর সামনে আসার পর আর্জেন্টিনা সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেছে। যদিও অপরাধপ্রবণতা হ্রাস পাওয়ার এই খবরের যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন রোজারিওবাসীর অনেকে। একইভাবে সন্দেহ পোষণ করেছেন বিশেষজ্ঞরাও।
ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম ও’গ্লোবোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আর্জেন্টিনা সরকারের প্রতিবেদন অনুসারে রোজারিওতে চলতি বছর হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা আগের তুলনায় অর্ধেকের বেশি কমেছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে এই শহরটি আর্জেন্টিনার সবচেয়ে সহিংসতাপূর্ণ শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০১৪ সালে শহরটিতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল ২৫৪টি। ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল। এ সময়ে প্রতিবছর ২৬০টি করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
তবে চলতি বছর পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। বিশেষ করে অতি উদারনীতিবাদে বিশ্বাসী হ্যাভিয়ার মিলেই দেশটির প্রেসিডেন্ট পদে আসার পর থেকে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দায়িত্ব গ্রহণের পর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন মিলেই। পাশাপাশি সান্তা ফে প্রদেশের নতুন গভর্নর হিসেবে ম্যাক্সিমিলিয়ানো পুলারোও সন্ত্রাস দমনে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। যদিও দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাসের মধ্যে কড়া অবস্থানের কারণে পুলারো বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের কাছ থেকে ৩০টির মতো হুমকি পেয়েছেন।
এর মধ্যে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় গত মার্চে মাদক পাচারকারীরা কারাগার থেকে তাদের সঙ্গীদের সাধারণ মানুষকে গুলি করে মারার নির্দেশ দিলে। এ ঘোষণার পর সে সময় চারজন শ্রমিককে হত্যা করা হয়। তবে এর পর থেকেই আকস্মিকভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা হ্রাস পেতে শুরু করে। সম্প্রতি জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ৬২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এ বিষয় প্যাট্রিসিয়া বুলরিচ নামের এক মন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা রোজারিওতে গত ১৭ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেখেছি।’
পারানা নদীর তীরে অবস্থিত রোজারিও আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেস থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি দেশটির তৃতীয় বৃহত্তম শহরও বটে। পাশাপাশি এটি বিশ্বের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ কৃষি রপ্তানিকারক বন্দরও বটে। এই শহরের পরিচিতিতে জড়িয়ে আছে বেশ কিছু বিখ্যাত নামও। মেসি ও দি মারিয়া তো আছেনই, তাঁদের সঙ্গে আছেন বিশ্বকাপজয়ী কোচ সিজার লুইস মেনত্তি, কিংবদন্তি কোচ মার্সেলো বিয়েলসা এবং বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারাও।
কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে কয়েক বছর ধরে এটি পরিচিত হয়ে ওঠে সহিংসতা, হত্যা, মাদকের ঘটনায়। ২০২৩ সালের মার্চে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক মেসির স্ত্রী আন্তোনেল্লা রোকুজ্জোর পরিবারের সুপারমার্কেটে বন্দুক হামলা চালায় অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীরা। ‘মেসি, আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। (রোজারিওর মেয়র) পাবলো ইয়াভকিন নিজেই মাদক চোরাচালানকারী। সে তোমাকে বাঁচাতে পারবে না’ লেখা কাগজও ফেলে রেখে গিয়েছিল সেই সন্ত্রাসীরা। চলতি বছরের মার্চে বিশ্বকাপজয়ী আরেক তারকা দি মারিয়াকেও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান স্বস্তি পাওয়ার মতো হলেও নগরবাসীর অনেকে অবশ্য ভিন্ন তথ্য দিচ্ছেন। ৪৬ বছর বয়সী ক্যানটিন পরিচালক সান্দ্রা আর্চে বলেন, ‘আমরা অনেক বেশি পুলিশ দেখছি কিন্তু বাকি সব আগের মতোই আছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রিপোর্ট করা হয় না। কিন্তু সেসব এখনো ঘটছে। রাস্তায় পরিস্থিতি এখনো আগের মতো। তারা ডাকাতি করে, আপনাকে আক্রমণ করে এবং আপনার ওপর গুলি চালাচ্ছে।’
সান্তা ফের সাবেক নিরাপত্তামন্ত্রী এবং সমাজ বিশ্লেষক মার্সেলো সাইনও অপরাধের এই দ্রুত পতনের হারকে বিশ্বাস করছেন না। তাঁর মতে, রাষ্ট্র ও অপরাধজগতের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে। যে কারণে হত্যাকাণ্ড বন্ধ আছে। নিজের বক্তব্যের পক্ষে তিনি আরও বলেন, ‘এর বাইরে আর কোনো ব্যাখ্যা নেই। কারণ, বিশ্বে এমন কোনো নীতি নেই, যা এত দ্রুত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমিয়ে আনতে পারে।’ ইউনিভার্সিটি অব বুয়েনস এইরেসের ক্রিমিনাল পলিসি অভজারভেটরি বিভাগের পরিচালক অ্যারিয়েল লারাউডের কাছেও সহিংসার এমন আশ্চর্য পতন ‘বিস্ময়কর’ বলে মনে হয়েছে।