ঈদসংখ্যায় কী নিয়ে লিখছি শোনার পর ‘খেলা খায়, খেলা ঘুমায়, খেলারই স্বপ্ন দেখে’ এমন এক বন্ধু অবাক হয়ে বলল, ‘মেসি-রোনালদো! মেসি-রোনালদোকে নিয়ে লেখার কী আছে?’
প্রশ্নটা শুনে আমার অবাক হওয়ার পালা। প্রায় দুই দশক ফুটবল বিশ্ব আক্ষরিক অর্থেই যাঁদের পদানত, যাঁদের দ্বৈরথের মতো কিছু এর আগে কখনো দেখেনি ফুটবল, ক্লাব ফুটবলের প্রাণকেন্দ্র ইউরোপ থেকে ‘স্বেচ্ছানির্বাসনে’ চলে যাওয়ার পরও প্রায় প্রতিদিনই যাঁরা খবরে—তাঁদেরকে নিয়ে লেখার কী আছে! এ কেমন ধারা প্রশ্ন!
আচ্ছা, ওই বন্ধু অন্য কিছু বোঝায়নি তো! হয়তো ‘মেসি না রোনালদো’ চিরন্তন সেই তর্ককে এই লেখার বিষয়বস্তু বলে ভাবছে। এঁদের একজনের পাগল ভক্ত বলে যে তর্ক তাঁর কাছে অনেক আগেই মীমাংসিত। তা শুধু ফুটবলীয় যুক্তিতর্কের ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে নয়। এমনিতে ওর যুক্তিবাদী মন বরং এই প্রসঙ্গে তীব্র আবেগে একেবারেই আচ্ছন্ন। এই তর্কে শুধু হাতাহাতি হতে বাকি—এমন অনেক আড্ডায় থাকার অভিজ্ঞতা কীভাবে ভুলে যাই!
ভক্ত-সমর্থকেরা অবশ্য এমনই হয়। কোথাকার মেসি, কোথাকার রোনালদো—এঁদের নিয়ে ঝগড়ায় গড়ানো তর্কে কত বন্ধুত্ব ভেঙে যেতে দেখেছি। যেন ওই তর্কে জেতা না-জেতার ওপরই নির্ভর করছে এ বছরের ব্যালন ডি’অরটা কে পাবে।
ভুলটা ভাঙিয়ে দেওয়া তাই কর্তব্য বলে মনে হলো। মেসি সেরা, না রোনালদো—এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা লেখার উপজীব্য নয় জানানোর পর উল্টো বরং আমার ভুল ভাঙল। বন্ধু অনুমিতভাবেই ‘ওটা নিয়ে আর কথা বলার কী আছে’ টাইপ একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘আরে না, আমি মোটেই অমন কিছু ভাবিনি। প্রশ্নটা করেছি, কারণ তোর জন্য আমার একটু মায়াই হচ্ছে।’
এ তো দেখি আরেক ধাঁধা। মেসি-রোনালদোকে নিয়ে লিখছি জেনে মায়া হবে কেন? প্রশ্নটা না করে পারলাম না। এতক্ষণ হাসিঠাট্টার মেজাজে থাকা বন্ধু এবার সিরিয়াস, ‘আসলে আমার প্রশ্নটা ছিল, মেসি-রোনালদোকে নিয়ে তুই নতুন কী লিখবি? নতুন কীই-বা লেখার আছে?’
বাহ্, এ তো দেখি আমার সমস্যাটা ঠিক ধরে ফেলেছে। কথা তো ঠিকই, মেসি-রোনালদো নিয়ে আসলেই নতুন কী লেখার আছে!
দুই
আটলান্টিক মহাসাগরের দীনহীন ছোট্ট এক দ্বীপ মাদেইরার হতদরিদ্র এক পরিবার থেকে উঠে এসে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বিশ্ব কাঁপিয়ে দেওয়ার গল্পের প্রতিটি অধ্যায় মুখস্থ, এমন অনেককেই আমি চিনি। আপনারও নিশ্চয়ই এমন অনেকের সঙ্গে পরিচয় আছে। কে জানে, হয়তো আপনি নিজেই তাঁদের একজন। স্পোর্টিং লিসবনের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচে ১৭ বছরের উইঙ্গারকে দেখে অ্যালেক্স ফার্গুসনের পাগল হয়ে যাওয়ার গল্পটা বলতে শুরু করলেই হাই তুলতে শুরু করবেন। সেই কবেই পড়েছেন। এরপরও যে আরও কতবার, নিজেরই তা মনে নেই। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে শুধুই সাইন করতে ওল্ড ট্রাফোর্ডে এসে থেকে যাওয়া দিয়ে শুরু রোনালদোর যাযাবর জীবনের কোন অংশটাই বা তা নয়!
ম্যানচেস্টার থেকে মাদ্রিদ, মাদ্রিদ থেকে তুরিন, তুরিন থেকে আবার ম্যানচেস্টার, তারপর অভাবিতভাবে একদিন সৌদি ফুটবলের মুখ হয়ে যাওয়া—রোনালদো যেখানে গেছেন, সঙ্গে টেনে নিয়ে গেছেন ভক্তকুলকে। শুধু ভক্তকুল কেন, ফুটবলকেও কি নয়! নইলে আল নাসরের খেলা কে দেখত!
১৩ বছরেই রোজারিওর ‘লা পুলগা’র জীবন কীভাবে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারের বার্সেলোনার সঙ্গে বাঁধা হয়ে গেল, সেই গল্পও কারও অজানা আছে বলে মনে হয় না। লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে, ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত গল্প কি এটাই! গল্প বলছি, তা গল্পের মতো শোনায় বলে। কিন্তু ঘটনা তো শতভাগ সত্যি। এই রত্নকে অন্য কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে—এই ভয়ে বার্সেলোনার পরিচালক কার্লোস রেক্সাস হাতের কাছে যা আছে, তাতেই ‘চুক্তি’ সেরে ফেলেছিলেন। হাতের কাছে যা ছিল, তা হলো একটা পেপার ন্যাপকিন। রেক্সাস নিশ্চয়ই কল্পনাও করেননি, ২৪ বছর পর সেই পেপার ন্যাপকিন নিলামে প্রায় ১২ কোটি টাকায় বিক্রি হবে।
‘লা পুলগা’ কথাটার মানে বলতে গিয়েও থমকে যেতে হচ্ছে। স্প্যানিশে যেটি ‘লা পুলগা’, ইংরেজিতে ‘দ্য ফ্লিয়া’, বাংলায় সেটিকে বলতে পারেন ‘মাছি’; ছোট্ট শরীর আর আঁকাবাঁকা পথরেখা এঁকে দিয়ে ডিফেন্ডারদের পেরিয়ে যেতে দেখে কে যে লিওনেল মেসিকে প্রথম এই নামে ডেকেছিল, তা জানাতে পারলে হয়তো আপনি একটু আগ্রহ বোধ করতেন। ‘লা পুলগা’ নিশ্চয়ই সেই আগ্রহ জাগাতে ব্যর্থ। জাগাবে কীভাবে, সেই কবে থেকেই তো আপনি এটি জানেন।
পেপার ন্যাপকিনে চুক্তি করাটা যেমন অনন্য, এর কাছাকাছি একটা জিনিসও তা-ই। বরং অনন্যতার উদাহরণ হিসেবে সেটি আরও বেশি চমকপ্রদ। বার্সেলোনা ছাড়তে বাধ্য হওয়ার ঘোষণা দিতে গিয়ে সংবাদ সম্মেলনে মেসির কেঁদে ফেলার সেই দৃশ্যটা নিশ্চয়ই মনে আছে। চোখ ছলছল করা কান্না নয়; চোখের জল-নাকের জল এক হয়ে যাওয়া বলতে যা বোঝায় তেমন কান্না। এসব সময়ে যা ভদ্রতা, পাশ থেকে কে যেন একটা টিস্যু পেপার এগিয়ে দেন। চোখের জল মুছে, নাক পরিষ্কার করে বিনে ফেলে দেওয়া সেই টিস্যু পেপারটা কেউ একজন তুলে নিয়ে যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। পরে একটা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে তা নিলামে ওঠে। প্রত্যাশিত দাম ছিল এক মিলিয়ন ডলার। শুধুই মেসির নাকের জল-চোখের জল মিশে আছে বলে নয়, ওটা থেকে নাকি মেসির জেনেটিক্যাল কোডও পাওয়া যাবে। যা থেকে তৈরি করা যাবে মেসির ‘ক্লোন’—মানে আরেকটা লিওনেল মেসি। কল্পনাশক্তির কী অপূর্ব প্রকাশ। সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে যে তা ফলাও করে প্রচারিত হবে, এ আর আশ্চর্য কী!
সমস্যা একটাই—সেই টিস্যু পেপার নিলামে ওঠার খবরটা প্রচারিত হলো ঠিকই, কিন্তু তা বিক্রি হলো কি হলো না, হলে কত টাকায়, সেই খবর আর পাওয়া গেল না। কারণ, খবরটা ছিল সম্ভবত ভুয়া। তারপরও এই প্রসঙ্গটা তোলা একটি কারণেই। একজন ফুটবলারকে নিয়ে উন্মাদনা কোন পর্যায়ে গেলে ব্যবহার করে বিনে ছুড়ে ফেলে দেওয়া টিস্যু পেপার নিলামে এক মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হবে বলে খবর হয় এবং সেটি সবাই বিশ্বাসও করেন।
মেসি-রোনালদো তো আসলে এমন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সীমারেখা ঘুচিয়ে দেওয়া এক প্রপঞ্চই। সেই কবে শুরু এই গল্পে যোগ হয়েছে একের পর এক অধ্যায়, এখনো হয়েই চলেছে।
একটা কারণ তো অবশ্যই যে শেষের দিগন্তরেখা ক্রমশই আরও দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দুজনই। কাতার বিশ্বকাপে কার মনে হয়নি, বিশ্বমঞ্চে এই শেষবারের মতো দেখছি তাঁদের। এখন তো মনে হচ্ছে, তা ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ’-এর আরেকটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। পরের বিশ্বকাপ তো এখন হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যায়। যেটির সঙ্গে দূরত্ব আর সোয়া বছরও নয়। মেসির গায়ে এখনো আর্জেন্টিনার জার্সি উঠছে, রোনালদোর গায়ে পর্তুগালের। তাহলে কি আরেকটি বিশ্বকাপেও পড়তে যাচ্ছে তাঁদের পায়ের চিহ্ন!
বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ডটি এখনো লিওনেল মেসির। রোনালদোর পর্তুগাল কখনো সেমিফাইনালের বেশি যেতে পারেনি বলে তাঁর তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী এই রেকর্ডে চার ম্যাচ পেছনে। যাঁর আবার হয়তো এর চেয়েও গৌরবের একটি রেকর্ড আছে। টানা পাঁচটি বিশ্বকাপে গোল করার কীর্তি তো শুধু রোনালদোর একারই। ২০২৬ সালে তিন দেশ মিলে আয়োজিতব্য প্রথম বিশ্বকাপেও খেলে ফেললে অবিশ্বাস্য এক রেকর্ডের যুগল অংশীদার হয়ে যাবেন তাঁরা দুজন। দুজনই ৫টি বিশ্বকাপে খেলেছেন, তা খেলেছেন আরও দুজন ফুটবলার। সংখ্যাটা যে কোনো দিন ‘৬’ হতে পারে—কারও কল্পনাও কখনো তা ছুঁতে পারেনি। তা মেসি-রোনালদো তো এত বছর ধরে কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাওয়া সব কাণ্ডকারখানাই করে যাচ্ছেন।
আবার সেই আগের কথাতেই ফিরে যেতে হয়। এখানেও কি আপনার অজানা কিছু বলতে পারলাম!
তিন
মেসি না রোনালদোকে ছাপিয়েও ফুটবলের সবচেয়ে বড় তর্ক সম্ভবত পেলে না ম্যারাডোনা। এই দুই তর্কের মধ্যে বড় একটা পার্থক্য অবশ্য আছে। জ্যামিতির ভাষায় বলতে গেলে তাঁদের দুজনের ক্যারিয়ার কখনো পরস্পরকে ছেদ করেনি। ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবল যখন শেষবারের মতো দেখেছে পেলেকে, ম্যারাডোনা তখন ১১ বছরের কিশোর। পেশাদার ফুটবলজীবন শুরু আরও বছর পাঁচেক পর। পেলের খেলোয়াড়ি জীবনে পেলের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কখনো প্রশ্ন ওঠেনি। জর্জ বেস্টকে নিয়ে রোমান্টিকতা ছিল, কিন্তু পেলে না বেস্ট—এই তর্ক করার সাহস কারও হয়নি। ম্যারাডোনার সময়ে ম্যারাডোনাও একই রকম ফুটবল বিশ্বের প্রবল প্রতাপান্বিত সম্রাট। জিকো-প্লাতিনিদের নাম উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেছে।
একজনের ছায়া তাড়া করেছে আরেকজনকে। আগের দিন হয়তো রিয়ালের হয়ে হ্যাটট্রিক করেছেন রোনালদো, পরদিনই মাঠে নামার সময় মেসির মধ্যে তার জবাব দেওয়ার তাড়না।
ফুটবলের সর্বকালের সেরাদের আলোচনায় আরও যেসব নাম আসে—সেই আলফ্রেড ডি স্টেফানো, ফেরেঙ্ক পুসকাস, ইয়োহান ক্রুইফ, ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারদের সময়ও কখনো তাঁদেরকে এমন ‘একের বিপক্ষে এক’ মুখোমুখি লড়াইয়ে নামিয়ে দেয়নি। এঁদের পরের সময়ে যদি রোনালদো নাজারিও, জিনেদিন জিদানে আসি—তাঁদেরকেও নয়। মেসি বনাম রোনালদো এখানেই ফুটবল ইতিহাসে অভূতপূর্ব, অশ্রুতপূর্ব এক দ্বৈরথের নাম।
অন্য খেলায় যেটির অনেক উদাহরণ পাবেন। বক্সিংয়ে মোহাম্মদ আলী বনাম জো ফ্রেজিয়ার, বাস্কেটবলে ম্যাজিক জনসন বনাম ল্যারি বার্ড, ফরমুলা ওয়ান রেসিংয়ে অ্যালান প্রস্ট বনাম আয়ার্টন সেনা, মটোজিপিতে ভ্যালেন্টিনো রসি বনাম মার্ক মার্কেজ, অ্যাথলেটিকসে কার্ল লু্ইস বনাম বেন জনসন, ক্রিকেটে শচীন টেন্ডুলকার বনাম ব্রায়ান লারা...বলতে থাকলে এমন আরও কতই বলা যায়। তবে এখানে টেনিসকে একটু না টানলে চলছে না। যেটিতে জোড়ায় জোড়ায় এমন অনেক আগুনে লড়াই। ছেলেদের টেনিসে যখন চরিত্রে দুই মেরুর দুজনের লড়াইয়ে বিওন বোর্গ বনাম জন ম্যাকেনরো ঝড়, মেয়েদের টেনিসে ঝাঁজে না হলেও স্থায়িত্বের বিচারে সেটিকে অনেক পেছনে ফেলা মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা বনাম ক্রিস এভার্ট। এরপর তো সেই আশ্চর্য এক সময় অতীতের সবকিছু ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠা রজার ফেদেরার বনাম রাফায়েল নাদাল। কিছুদিনের মধ্যেই নোভাক জোকোভিচের আগমনে যা পরিণত ত্রিমুখী লড়াইয়ে। নাদাল বনাম জোকোভিচ সম্ভবত সব খেলা মিলিয়েই তীব্রতম দ্বৈরথের গল্প। সেই লড়াইয়ের এমনই ঝাঁজ যে মাঝখানে পিট সাম্প্রাস বনাম আন্দ্রে আগাসি বলতে গেলে অদৃশ্যই হয়ে গেছে।
টেনিস ব্যক্তিগত খেলা। আক্ষরিক অর্থে যা শুধুই দুজনের লড়াই। তোমার বিপক্ষে আমি। আমার বিপক্ষে তুমি। ফুটবল তো তা নয়। তারপরও মেসি বনাম রোনালদো প্রতিদ্বন্দ্বিতা সেটিকেও যেন ‘মক ফাইট’ বানিয়ে ফেলে।
এতটা মোটেই হতো না, যদি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ না দিতেন। মেসি বার্সেলোনায় না থাকলেও এমন হতো না, এটা বলা একটু হাস্যকরই হবে। কারণ, বার্সেলোনা তো মেসির ভবিতব্যই ছিল। লা মেসিয়ায় বড় হয়ে বার্সার জার্সি গায়ে মাঠ মাতাবেন—এটা তো সেই পেপার ন্যাপকিনে লেখা বিখ্যাত চুক্তিপত্রই ঠিক করে দিয়েছিল।
রিয়াল মাদ্রিদ বনাম বার্সেলোনা ক্লাব ফুটবলে তিক্ততম প্রতিদ্বন্দ্বিতার গল্প। অন্য সব ক্লাব-রাইভালরির মতো কখনোই যা একই দেশের দুই বড় ক্লাবের ফুটবলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকেনি। রিয়াল-বার্সা শত্রুতার শিকড় আরও অনেক গভীরে। তাতে রাজনীতি আছে, শ্রেণিসংগ্রাম আছে, আছে ইতিহাসের আরও অনেক অনুষঙ্গ। সেই দুই ক্লাবের হয়ে নিয়মিত মাঠে মুখোমুখি হচ্ছেন বিশ্বের সেরা ফুটবলারের মুকুট নিয়ে লড়াইয়ে নামা দুই কালজয়ী প্রতিভা। রিয়াল-বার্সেলোনা প্রতিটি ম্যাচ যেন ‘কে বেশি ভালো’—এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মঞ্চ। আগুনের ফুলকি তো ছুটবেই।
এমনকি যখন তাঁরা মাঠে সরাসরি প্রতিপক্ষ নন, তখনো তো রোনালদো মেসির বিপক্ষে খেলেছেন, মেসি রোনালদোর বিপক্ষে। একজনের ছায়া তাড়া করেছে আরেকজনকে। আগের দিন হয়তো রিয়ালের হয়ে হ্যাটট্রিক করেছেন রোনালদো, পরদিনই মাঠে নামার সময় মেসির মধ্যে তার জবাব দেওয়ার তাড়না। মেসি আগের রাতে দুই গোল করেছেন বলে রোনালদো মাঠে নেমেছেন কল্পচোখে তৃতীয় গোলটা দেখতে দেখতে। রোনালদো মেসিকে আরও ভালো মেসি বানিয়েছেন, মেসি রোনালদোকে আরও ভালো রোনালদো।
রিয়াল-বার্সেলোনা ‘এল ক্লাসিকো’ বা ‘দ্য ক্লাসিক’ তো সেই কবে থেকেই। ক্লাব ফুটবলে সবচেয়ে গ্ল্যামারাস, সবচেয়ে ঝাঁজালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বীও। অথচ একটা সময় তা যেন শুধু নামেই রিয়াল বনাম বার্সেলোনা, আসলে মেসি বনাম রোনালদো। লা লিগার সেই দিনগুলো ফুটবল ইতিহাসেরই সোনালি এক অধ্যায়। কে রিয়ালের সমর্থক, কে বার্সার; কে রোনালদো-ভক্ত, কে মেসির-এই ভেদাভেদ মুছে দিয়ে বিশ্বের সব ফুটবলপ্রেমীদের জন্যই শিহরণ জাগানো এক অভিজ্ঞতা। যে স্মৃতি মনে করে দীর্ঘশ্বাসটাও হয়তো সর্বজনীন—আহা, কী সব দিনই না ছিল!
চার
লিওনেল মেসি কোনো দিন বার্সেলোনা ছাড়বেন—এটা কেউ কখনো ভেবেছিলেন বলে মনে হয় না। মাঝেমধ্যে রসিকতার মতো প্রসঙ্গটা উঠত, অমুক দল যদি মেসিকে নিতে চায়, তাহলে কত টাকা লাগবে। শুধু অঙ্কটার কারণেই তা রসিকতার মতো শোনাত না, বার্সেলোনার সঙ্গে মেসির বন্ধনটা অচ্ছেদ্য ভাবাও ছিল আরেকটা কারণ। মেসির বার্সেলোনা ছাড়তে হওয়ার চেয়েও অবিশ্বাস্য, প্যারিস সেন্ট জার্মেইয়ের তাঁকে ফ্রি-ফ্রি পেয়ে যাওয়া। পিএসজি থেকে ইন্টার মায়ামিতে যাওয়াটা অবিশ্বাসের স্কেলে প্রায় কাছাকাছিই থাকবে। বেতন-বোনাসের বাইরে আরও অনেক প্রাপ্তি মিলিয়ে মেসির মায়ামি-যাত্রাকে বলতে পারেন মেসির ‘রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান’-এর অংশ।
দুজনের এমনই মহিমা যে বলতে গেলে প্রায় প্রতি ম্যাচেই সেই কষ্টটা পুষিয়ে দিয়েছেন। কখনোই এমন মনে হতে দেননি—ধুর, অকারণে রাত জাগলাম। এই অনুভূতি আমার ধারণা সর্বজনীন।
মেসির মতো রোনালদোকে কেউই কখনো ‘ওয়ান ক্লাব প্লেয়ার’ বলে ভাবেনি। সেটি না হওয়াতে মেসি-রোনালদো তর্কে রোনালদোর পক্ষে কিছু বাড়তি পয়েন্টও যোগ হতো। পর্তুগাল থেকে ইংল্যান্ড, ইংল্যান্ড থেকে স্পেন, স্পেন থেকে ইতালি, ইতালি থেকে আবার ইংল্যান্ড—রোনালদো নিজেকে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন অনেকবার। ক্লাব বদলানো মানে তো শুধু দেশ বদলানো নয়, আরও অনেক কিছু বদলে যাওয়া। ফুটবল সংস্কৃতি, ভাষা, আবহাওয়া, খাবার…টিমমেট বদলে যাওয়ার কথা আর না-ই বললাম। রোনালদোকে তাই বারবার মানিয়ে নিতে হয়েছে নতুন অনেক কিছুর সঙ্গে। যেখানে মেসি ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা এমন এক দলে খেলেছেন, যা প্রায় আক্ষরিক অর্থেই তাঁর পরিবারের মতো। যাঁদের সঙ্গে খেলেছেন, তাঁদের বেশির ভাগেই তাঁর কৈশোরের খেলার সাথি।
মেসির মায়ামিতে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্তে যেমন ফুটবলের চেয়ে অন্য কিছুর ভূমিকা বেশি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সৌদি আরবে যাওয়ার সিদ্ধান্তেও তা-ই। তবে মেসির তুলনায় রোনালদোর সিদ্ধান্তটা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং বলে অনুমান করাটা একটুও কঠিন কিছু নয়। ইউরোপীয় জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত কারও ঠিকানা হিসেবে মায়ামি না রিয়াদ, কোনটা বেশি এগিয়ে—মনে হয় না তা নিয়ে কোনো আলোচনার দরকার আছে।
রোনালদো খেলেন বলেই কখনো কখনো আল নাসরের খেলা দেখা হয়। মেসিকে দেখা যাবে বলে ইন্টার মায়ামির। দেখতে দেখতে আমি লা লিগার সেই দিনগুলো খুব মিস করি। দর্শক হিসেবে যেমন, তেমনি সাংবাদিক হিসেবেও। সেই সব রাতগুলোর কথা মনে পড়ে, যখন ঘুমে জড়িয়ে আসা চোখ আর ক্লান্তিতে ভেঙে আসা শরীরকে ধমক দিয়ে ভোররাত পর্যন্ত টেলিভিশনের সামনে বসিয়ে রেখেছি। ঘুমিয়ে পড়লেই যদি অতীন্দ্রিয় কিছু মিস হয়ে যায়। পরদিন রেকর্ডেড পুরো খেলাই দেখেন বা হাইলাইটস-লাইভ দেখার রোমাঞ্চ আর তাতে থাকে নাকি!
ওই দুজনের এমনই মহিমা যে বলতে গেলে প্রায় প্রতি ম্যাচেই সেই কষ্টটা পুষিয়ে দিয়েছেন। কখনোই এমন মনে হতে দেননি—ধুর, অকারণে রাত জাগলাম। এই অনুভূতি আমার ধারণা সর্বজনীন। তবে ক্রীড়া সম্পাদকের ভূমিকায় আমার যে অভিজ্ঞতা, সেটি তো আর তা নয়। একসময় আবাহনী-মোহামেডান নিয়ে দুই ভাগ হয়ে যেত বাংলাদেশ। সেই উন্মাদনার প্রত্যক্ষদর্শী, কিন্তু তা তো ছিল দুই ক্লাবের বৈরিতা। সাংবাদিক হিসেবে তখনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে কখনো কখনো। পত্রিকা পড়ে আবাহনীর সমর্থকেরা মনে করেছে, আমি মোহামেডান। মোহামেডানের সমর্থকেরা আবাহনী। মেসি বনাম রোনালদো নিয়ে অভিজ্ঞতা মনে হয় সেটিকেও ছাড়িয়ে। কার ছবি বড় গেছে, কার ছোট; মেসির হ্যাটট্রিকে বার্সেলোনা জেতার পর তিনটি স্টোরি করা হলে রোনালদোর হ্যাটট্রিক রিয়ালকে জেতানোর পর কেন দুটি—এসব প্রশ্ন তুলে গায়ে কোনো এক দলের সমর্থকের ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনা তো অহরহই ঘটত। এসব মতামতের প্রকাশ বেশির ভাগ সময়ই যে শোভন ভাষায় হতো না, তা বোধ হয় না বললেও চলছে।
কখনো কখনো বিরক্তও লাগত। আর এখন সেই দিনগুলোকে খুব মিস করি। মেসি বনাম রোনালদো এখন নস্টালজিয়ার নাম। ‘আহা, কী একটা সময়ই ছিল’ ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলার উপলক্ষও।
এমন কিছু ফুটবল আগে কখনো দেখেনি, ভবিষ্যতেও আর দেখবে বলে মনে হয় না।