উজ্জীবিত ও আক্রমণাত্মক বাংলাদেশ দলে মুগ্ধ চুন্নু–আলফাজরা

এই বাংলাদেশ দল মুগ্ধ করেছে সবাইকেছবি: বাফুফে

এই দল দিয়ে কিছু হবে না—প্রকাশ্যেই অনেকে বলতেন এমন কথা। কিন্তু সেটিকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ ফুটবল দল। বাংলাদেশের এই দলই সাফে গ্রুপ পর্ব পেরোতে না পারা গেরোটা খুলেছে। ১৪ বছর পর উঠেছে আঞ্চলিক টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে। ফাইনালেও যেতে পারত আরেকটু হলে। কিন্তু কুয়েতের কাছে কাল দারুণ লড়ে অতিরিক্ত সময়ের গোলে হেরেছে বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টজুড়ে ভালো খেলা বাংলাদেশ দল প্রশংসা পাচ্ছে সাবেক ফুটবলার, কোচদের...

বাংলাদেশকে দারুণ

উজ্জীবিত লেগেছে

গোলাম সারোয়ার টিপু, সাবেক ফুটবলার ও জাতীয় দলের সাবেক কোচ

গত সাত-আট বছরের মধ্যে এই দলকে একটু আলাদা মনে হয়েছে আমার। ছেলেরা উজ্জীবিত ছিল টুর্নামেন্টের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। দলটাকে আগের তুলনায় অনেক বেশি গোছানো লেগেছে। বাংলাদেশ দল মালদ্বীপ ও নেপাল ম্যাচে পিছিয়ে থেকেও দারুণভাবে ফিরে ৩-১ গোলে জিতেছে। সেটাও কোনো প্রথাগত স্ট্রাইকার ছাড়াই। এতেই বোঝা যাচ্ছে, দল হিসেবে যে মানের আমরা, তাতে কিছু বদল এসেছে।

ফুটবলারদের মধ্যে লড়াকু মানসিকতা দেখেছি। সবচেয়ে বড় কথা, কিছু অর্জনের জন্য দলটাকে আমার অনুপ্রাণিত মনে হয়েছে। কৃতিত্ব অবশ্যই দিতে হবে ফুটবলারদের। তবে কোচ হাভিয়ের কাবরেরার কথা আলাদাভাবে বলব। আমার মনে হয়, সে খেলোয়াড়দের সঙ্গে অনেক বেশি মেশে। খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সেরাটা বের করতে একজন কোচকে অনেক কাজ করতে হয়। কাবরেরা সেটা করেছে বলেই দল ভালো খেলছে।

আরও পড়ুন
গোলাম সারোয়ার টিপু।
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশ দলের সবই যে ভালো তা বলব না। কিছু ভুলও আছে। তবে সেটা তুলনামূলক কম হয়েছে এবার। খেলোয়াড়দের মেধার সীমাবদ্ধতা আছে। টেকনিক্যালি খুব ভালো খেলোয়াড়ের সংখ্যা বাংলাদেশ দলে বড়জোর দু–তিনজন। এই জায়গায় ঘাটতি পূরণ করতে পারলে বাংলাদেশ দল সামনে আরও ভালো করবে। মেধাসম্পন্ন খেলোয়াড় কীভাবে দলে নিয়ে আসা যায়, সেটা এখনই ভাবতে হবে। এই জায়গায় জোর দেব বেশি।

আরও পড়ুন

কাবরেরাকে আরও ৫

বছর রাখা উচিত

আশরাফউদ্দিন আহমেদ, জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার

মানুষ যেমন দেখতে চায়, তেমনটাই এই টুর্নামেন্টে খেলেছে বাংলাদেশ দল। ইতিবাচক ফুটবল, আস্থার ফুটবল, আক্রমণাত্মক ফুটবল...যা–ই বলুন না কেন! প্রত্যেক ফুটবলারের মধ্যে দলের প্রতি অঙ্গীকার দেখেছি। ওরা আস্থা ফিরে পেয়েছে। কৃতিত্ব দেব কোচ হাভিয়ের কাবরেরাকে। যতটা বুঝেছি, কোচ চায় স্প্যানিশ ফুটবলের চর্চা বাংলাদেশ দলে করতে। গোলকিপারের কাছ থেকে এখন আর লম্বা শট হয় না। গোলকিপার বল ছোড়ে কখনো লেফটব্যাক, কখনো রাইটব্যাককে। নিচ থেকে বিল্ডআপ করে আস্তে আস্তে আক্রমণে যাওয়া। তেমন খেলাই এবার সাফে বাংলাদেশ খেলেছে।

আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু।
ছবি: প্রথম আলো

সাফ দেখার পর আমি বলব, কাবরেরাকে আগামী পাঁচ বছর রেখে দেওয়া উচিত। মোরছালিন, ফাহিমের মতো তরুণদের দলে নিয়ে সে খেলিয়েছে। এর জন্য তাকে বাহবা দেব। ১৮ বছরের বাচ্চা ছেলে মোরছালিন সুযোগের পুরোপুরি ব্যবহার করেছে। তবে আমি খুব ব্যথিত সেমিফাইনালে কুয়েতের বিপক্ষে ওর মিসটা দেখে। একটু পরিপক্বতা কম বলে এভাবে মেরে দিয়েছে। যা হোক, কুয়েত ম্যাচে সেরা বলব গোলকিপার জিকোকে (আনিসুর রহমান)। পাশাপাশি সব ফুটবলার, কোচিং স্টাফের প্রশংসা করব। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের এই অর্জন ধরে রাখতে অবশ্যই আমাদের তৃণমূল থেকে ভালো ফুটবলার তুলে আনতে হবে।

আরও পড়ুন

দলীয় রসায়ন খুব

ভালো হয়েছে

সাইফুল বারী, জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার ও কোচ

বাংলাদেশকে সাম্প্রতিক সময় ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলতে দেখিনি। একটা ম্যাচ ভালো খেলে পরেরটা হয়তো খারাপ খেলেছে। কিন্তু সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে দলীয় রসায়নটা খুব ভালো মনে হয়েছে। টিমের মধ্যে একতা ছিল। সবচেয়ে ভালো লেগেছে, কোচের ট্যাকটিক্যাল পরিকল্পনা অনুযায়ী ফুটবলাররা বেশির ভাগ সময় খেলতে পেরেছে। এ মুহূর্তে এই দলকে খুব ভালো ও ভারসাম্যপূর্ণ মনে হয়েছে।

সাইফুল বারী টিটু।
ছবি: ফেসবুক

কাবরেরার দলের খেলোয়াড়েরা বলের সঙ্গে সাবলীল। কোচ নাম্বার নাইন ছাড়া খেলিয়েছে সাফে। দুই উইঙ্গারকে ফরোয়ার্ডে খেলিয়েছে। এটা বেশ ভালো কাজে এসেছে। মাঝমাঠ জমাট ছিল। মাঝখান দিয়ে অন্য দলগুলো বাংলাদেশের বিপক্ষে বেশি খেলতে পারেনি।

লিগে পারফর্ম করাদের মধ্য থেকেই কোচ খেলোয়াড় বেছে নিয়েছে। কাবরেরাকে দেখেছি, অনেক গভীরে গিয়ে কাজ করে। লিগে নতুন কাউকে নিতে গিয়ে ওই খেলোয়াড়ের অনেক ম্যাচ দেখেছে। সবারই তথ্য আছে তার কাছে। কে বাঁ পায়ে ভালো, কে ডান পায়ে সবই জানে। কার পাস কয়টা, কয়টা ক্রস আছে—সবই নোট করেছে। আমি এটা আগে থেকে দেখেছি। এভাবেই পরিকল্পিতভাবে সঠিক ভারসাম্যপূর্ণ একটা দল কাবরেরা তৈরি করতে পেরেছে। যার ফল এসেছে মাঠে। এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন। দলটাকে সঠিক রাস্তায় রাখতে সামনে অনেক কাজ করতে হবে।

আরও পড়ুন

জামাল ভূঁইয়াকে নিয়ে

ভাবতে হবে

আলফাজ আহমেদ, জাতীয় দলের সাবেক স্ট্রাইকার ও কোচ

একজন প্রথাগত স্ট্রাইকারের দরকার ছিল সাফের দলে, যে গোল করতে পারে। এই জায়গায় বড়সড় ঘাটতি ছিল। আমরা সাফে ভালো খেলেছি বলে আনন্দিত সবাই। কিন্তু দেখুন, আমাদের স্ট্রাইকাররা বেঞ্চে বসে ছিল। কোচ তাদের ওপর ভরসা পায়নি। প্রথাগত ভালো স্টাইকার নেই বলে কোচ ফরমেশন বদলে দল নামায়। এটা সাময়িক সমাধান, দীর্ঘস্থায়ী নয়। স্ট্রাইকার যেহেতু নেই, মোরছালিনকে নাম্বার নাইনে খেলাতে পারে কোচ। তবে দীর্ঘ মেয়াদে সমাধানের জন্য স্ট্রাইকার খুঁজে তৈরি করতে হবে। এর বিকল্প দেখছি না। বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হবে।

আলফাজ আহমেদ
ছবি : শামসুল হক

ভাবতে হবে জামাল ভূঁইয়াকে নিয়েও। ৯০ মিনিট সে খেলতে পারছে না। জামাল নাম্বার সিক্সের খেলোয়াড়। অথচ কোচ তাকে পাঠাচ্ছে নাম্বার নাইনে। যেখানে সে সাবলীল নয়। জীবনে সে কখনো পুরোপুরি আক্রমণাত্মক ভূমিকায় খেলেনি। এখন খেলছে কোচের চাওয়া মেনে। জামালের খেলা দেখে অন্যরা উজ্জীবিত হবে, এটাই হওয়া উচিত। হচ্ছে কী? প্রশ্ন আছে।

আরও পড়ুন

আরেকটা ব্যাপার লক্ষণীয়, কোচ প্রতি ম্যাচে জামালকে অধিনায়কত্ব দিয়ে মাঠে নামাবে, আর ৬০ মিনিটের আশপাশে তুলে নেবে, এটা ভালো দেখায় না। আমি কাবরেরার জায়গায় থাকলে জামালকে একাদশে দিতাম না।

মোরছালিনের সংযোজন

বিরাট প্রভাব ফেলেছে

জাহিদ হাসান এমিলি, জাতীয় দলের সাবেক স্ট্রাইকার

লেবানন ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আর পেছন ফিরতে হয়নি। মালদ্বীপ, ভুটান, কুয়েত...প্রতিটি ম্যাচেই বাংলাদেশ বেশ ভালো খেলেছে। আমরা এটা প্রত্যাশা করিনি। কোচ কাছ থেকে দলটাকে দেখেছে, কাজ করেছে। সেটারই ফল বাংলাদেশ সেমিফাইনাল পর্যন্ত আসতে পেরেছে।

সেমিফাইনাল খেলার পেছনে দু–তিনটি বিষয় প্রভাব রেখেছে। লেবানন ম্যাচে মোরছালিনকে বদলি হিসেবে নামানোর পর থেকে সেই যে মোমেন্টাম ধরেছে বাংলাদেশ, কুয়েত ম্যাচ পর্যন্ত তা আর হারায়নি। মোরছালিন এসে বাংলাদেশের খেলার ধরন বদলে দিয়েছে। অবশ্য মোরছালিনকে একা কৃতিত্ব দেব না। রাকিব, জিকো সবাই ভালো পারফর্ম করেছে।

জাহিদ হাসান এমিলি

বাংলাদেশ যে ভালো খেলতে পারে, আক্রমণ গড়তে পারে; সেটা বোঝা গেছে এবারের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে। গোল খাওয়ার পর গোল শোধ করে জিততেও পারে এই দল। আমি বলব, মোরছালিনের অন্তর্ভুক্তির ফল এটা। কুয়েত ম্যাচটা এমন হাড্ডাহাড্ডি হবে ভাবিনি। বাংলাদেশ ২-৩ গোলে হারবে ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা হয়নি। তারিক কাজী চোট কাটিয়ে ফিরিয়ে সেরাটা দিয়েছে। প্রত্যেক খেলোয়াড়ই সেরাটা দিয়েছে। এর আগে গত মার্চে সেশেলসের বিপক্ষে ফিফা প্রীতি ম্যাচে বাংলাদেশ দলে প্রাণ ছিল না। যেটি ছিল সাফে।

সেমিফাইনালটা ১২০ মিনিট পর্যন্ত নিয়ে গেছে বাংলাদেশ। অনেকগুলো সুযোগ তৈরি করেছে, এটা দারুণ ব্যাপার। মোরছালিন দ্বিতীয় মিনিটে মিসটা না করলে বা রাকিবের ওই শটটা বারে না লাগলে ম্যাচটা আমরা জিততেও পারতাম। সব মিলিয়ে বলব, এবারের সাফটা অসাধারণ কেটেছে আমাদের।