বাইসাইকেল ও একজন রোনালদো
বাইসাইকেল কিক দেখতে সুন্দর। তবে কাজটা খুব কঠিন। বলের গতিবিধি বুঝে শূন্যে লাফ দিতে হয়। শূন্যে থাকতেই কিকটাও নিতে হয় ঠিকমতো এবং নিশানাও যথাসম্ভব নিখুঁত রাখতে হয় লাফ দেওয়ার সময়ই। বয়স এ কিকে সব সময়ই একটি ব্যাপার। কারণ, ফিটনেস ঠিক না থাকলে কিক নিতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়া কিংবা চোটের শঙ্কাও থাকে; পাশাপাশি একদম সময়মতো পা ছোঁয়ানোর কৌশলগত ব্যাপারগুলো তো আছেই। এবার একটি প্রশ্ন, আগামী তিন মাস পরই ফেব্রুয়ারিতে ৪০ বছর পূর্ণ করতে যাওয়া কোনো ফুটবলারের জন্য এই কিক কতটা কঠিন?
প্রথম শর্ত হলো ভেতরে অ্যাথলেটিসিজম থাকতে হবে। কিন্তু চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বেশির ভাগ ফুটবলারের জন্য ব্যাপারটা হয়তো নিকট অতীত, শুধু একজন বাদে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো! নেশনস লিগে কাল রাতে পোর্তোর দ্রাগাও স্টেডিয়ামে পোল্যান্ডের বিপক্ষে পর্তুগালের ৫–১ গোলের জয়ে দুটি গোল রোনালদোর। প্রথমটি পেনাল্টিতে ‘পানেনকা’ শটে, পরেরটি বাইসাইকেল কিকে। একবার ভাবুন তো, এ বয়সে এসেও রোনালদো এভাবে গোল করছেন। লোকে যে বয়সে ধীরে ধীরে নিজেকে খেলার ভুবন গুটিয়ে নেয়, রোনালদো সে বয়সেই যেন নতুন রং ছড়াচ্ছেন!
খেয়াল করার বিষয় হলো, রোনালদো কিকটি নেওয়ার পর বলের গতিপথ। ওই অবস্থায় বলে ঠিকমতো পা লাগানোই যেখানে চ্যালেঞ্জ, সেখানে সাধারণ কোনো খেলোয়াড় হলে হয়তো কিকটি নিতে পেরেই সন্তুষ্ট থাকতেন—বল যেখানে যায় যাক—কিংবা বাঁ পাশের পোস্টেই মারতেন, যেটা তুলনামূলক সহজ। রোনালদো কিন্তু সেটি করেননি।
পানেনকা কিংবা বাইসাইকেল কিকের মতো সেসব ‘রং’ আসলে তরুণদের কাছে লোভনীয়। ভুল হলে কথা হবে কম, কারণ বয়স অল্প। লোকে বলবে, অভিজ্ঞতা কম আর নতুন কিছু চেষ্টা করার সময়ও তো এখনই! কিন্তু গোল করলে হইচই পড়ে যায়। এতটুকু পড়ার পর কি মনে হচ্ছে, ৩৯ বছর বয়সী রোনালদোর ভেতরে আসলে একটি কিশোর বসবাস করে, ফুটবল মাঠে নিত্যনতুন রোমাঞ্চের স্বাদ সন্ধান করাই যার খেলার হেতু। হ্যাঁ, ১০০০ গোল করার লক্ষ্য তো আছেই। তবে সে চূড়া স্পর্শ করতে না পারলেও তেমন একটা খেদ হয়তো থাকবে না। কিছুদিন আগেই বলেছেন, ‘যদি আমি হাজার গোলে পৌঁছাতে পারি, সেটা ভালো। যদি না পারি, তবে এরপরও আমিই ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা।’
সে তো ভালো কথা! কিন্তু ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার পরও কেন ওসব চেষ্টা করতে হবে? কেন ফেলে আসা দিনগুলো বারবার ফেরানোর চেষ্টা করতে হবে? কারণ সম্ভবত একটাই—নিজের সামর্থ্যের শেষটা দেখার ইচ্ছা। অন্যভাবে বললে নিজেই নিজেকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া—তরুণেরা যা অনায়াসে পারে, তা আমিও পারি কি না! এই বয়সেও যদি পারি, তাহলে আমি ‘স্পেশাল’!
কে না জানে রোনালদো তাঁকে নিয়ে ‘স্পেশাল’ কথাটা শুনতে ভালোবাসেন। হাজারো খেলোয়াড়ের ভিড়ে রোনালদো সব সময়ই নিজেকে আলাদা করে চেনাতে চেয়েছেন। ২২ বছরের ক্যারিয়ারে ‘স্পেশাল’ তিনি সব সময়ই ছিলেন, কিন্তু এই বয়সেও এমন কিছু করতে পারার অর্থ হলো, রোনালদোর ভেতর থেকে তারুণ্য এখনো ফুরিয়ে যায়নি। খেলার মজাটাও অটুট। শুধু একটাই আক্ষেপ জাগতে পারে, বয়স তো তাঁকে বেশিদিন এভাবে থাকতে দেবে না!
ডিয়েগো ম্যারাডোনা তাঁর পুরো ক্যারিয়ারে ৯১ ম্যাচে করেছিলেন ৩৪ গোল। রোনালদো বয়স ৩৫ বছর পেরোনোর পর থেকে এ পর্যন্ত দেশের হয়ে করেছেন ৩৬ গোল।
সেই সিদ্ধান্ত সময় ও রোনালদোর হাতে ছেড়ে দিয়ে আসুন কাল রাতের গোলটি একবার ফিরে দেখা যাক। ভিতিনিয়া ডান প্রান্ত থেকে যখন ক্রসটা দিলেন, রোনালদো বাঁ প্রান্তের পোস্টের কাছাকাছি। কিন্তু সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন না। মানে বাইসাইকেল কিক মারতে যে পজিশনে দাঁড়াতে হতো, সেটি তখনো ছিলেন না। বলটি বাতাসে ভেসে ভেসে আসতেই পজিশন পাল্টে ফেলেন রোনালদো। একটু সরে গিয়ে ভিতিনিয়ার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে তারপর করেন কিক।
খেয়াল করার বিষয় হলো, রোনালদো কিকটি নেওয়ার পর বলের গতিপথ। ওই অবস্থায় বলে ঠিকমতো পা লাগানোই যেখানে চ্যালেঞ্জ, সেখানে সাধারণ কোনো খেলোয়াড় হলে হয়তো কিকটি নিতে পেরেই সন্তুষ্ট থাকতেন—বল যেখানে যায় যাক—কিংবা বাঁ পাশের পোস্টেই মারতেন, যেটা তুলনামূলক সহজ। রোনালদো কিন্তু সেটি করেননি। যখনই দেখেছেন পোলিশ গোলকিপারসহ এক ডিফেন্ডারও তাঁর কাছের পোস্টের সামনে চলে এসেছেন, রোনালদো বল মেরেছেন দূরের পোস্টে। ছবিটি চাইলে বাঁধিয়ে রাখতে পারেন, কারণ সাধারণ খেলোয়াড় এবং কিংবদন্তির মাঝে পার্থক্য তো এটাই! এক্সের টাইমলাইনে অবশ্য রেখেছেনও।
ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যম ‘বোয়াভিআইপি’ জানিয়েছে, রোনালদোর ক্যারিয়ারে বাইসাইকেল কিকে করা দ্বিতীয় গোল এটি। প্রথমটি আরও বিখ্যাত। ২০১৮ চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টার ফাইনাল প্রথম লেগে জুভেন্টাসের বিপক্ষে সেই গোল, যা দেখে গ্যালারিতে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কিংবদন্তিকে সম্মান দেখিয়েছিলেন ‘তুরিনের বুড়ি’র সমর্থকেরা। তাঁর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিওনেল মেসির ক্যারিয়ারে বাইসাইকেল কিক থেকে গোল করেছেন একটি। ২০২২ সালে লিগ আঁ–তে ক্লেঁয়ারমের বিপক্ষে মৌসুমের প্রথম দিনে বাইসাইকেল কিকে গোল করেছিলেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি।
আর্জেন্টিনার কথা যেহেতু উঠল, তাঁদের এক কিংবদন্তিকে এ প্রসঙ্গে টানতে হয়। ডিয়েগো ম্যারাডোনা তাঁর পুরো ক্যারিয়ারে ৯১ ম্যাচে করেছিলেন ৩৪ গোল। রোনালদো বয়স ৩৫ বছর পেরোনোর পর থেকে এ পর্যন্ত দেশের হয়ে করেছেন ৩৬ গোল। তথ্যটি মোটেও ম্যারাডোনাকে ছোট করতে নয়। এই বয়সে লোকে বুট তুলে রাখে কিংবা অবসরের ভাবনা ভাবে। রোনালদোর ম্যাজিকটা ঠিক এখানেই। এই বয়সেও তাঁর গোলক্ষুধা এবং গোল করতে বয়সের ভারকে পাত্তা না দিয়ে শূন্যে উড়াল দেওয়াকে কি বলবেন?
কিংবদন্তি তাঁকে আগেই বলা হয়েছে। এখন হয়তো নতুন নাম খুঁজতে হবে!