আলিসিয়া ও তাঁর পরিবারের রিয়াল মাদ্রিদ–প্রেমের গল্প
সমর্থক তো অনেক রকমই হয়। কেউ দলকে ভালোবাসেন প্রাণ দিয়ে। আবার কেউ আসেন সাফল্যের ঘ্রাণ শুঁকে, যাঁদের বলা হয় ‘গ্লোরি হান্টার’ বা সুসময়ের বন্ধু। টানা ব্যর্থতার কারণে কেউ কেউ আবার মুহূর্তের মধ্যে দল বদলে ফেলতে দুবার ভাবেন না। কিন্তু এমন ভক্তও অনেকে আছেন, যাঁরা বছরের পর বছর ধরে সমস্ত সাফল্য ও ব্যর্থতায় দল অন্তঃপ্রাণ হয়ে থেকে যান। দলের মতোই হয়ে যান চিরন্তন। দলের অবস্থান যেমনই হোক, তাঁরা কখনো দলকে একা ফেলে যান না।
ওই যে বলা হয় না, ‘তুমি নারী, গাড়ি, বাড়ি—সব বদলাতে পারো, কিন্তু দল বদলাতে পারো না।’ দল বদলে ফেলাদের অনেক সময় ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবেও দেখা হয়। আলিসিয়া আলফনসো ও তাঁর পরিবারের গল্পটা মূলত একনিষ্ঠ রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থক হয়ে ওঠার গল্প। অবশ্য সাধারণ কোনো বিশেষণে ক্লাবটির প্রতি তাঁদের ভালোবাসাকে ধরা মুশকিল। তাঁর রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থক হয়ে ওঠার গল্প যে বুঝ হওয়ার আগে থেকেই। আর এল ক্লাসিকোতে রিয়াল–বার্সেলোনার গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ের আগে সামনে এসেছে রিয়াল–ভক্ত আলিসিয়ার কিংবদন্তি হয়ে ওঠার গল্পটি।
আলিসিয়ার জন্ম এমন এক পরিবারে, যাদের নিশ্বাসেই লেগে থাকত মাদ্রিদের ঘ্রাণ। তাঁর দাদার সঙ্গে রিয়ালের তৎকালীন সহসভাপতি ফ্রান্সিসকো মুনোজ লুসারেত্তার ছিল দারুণ বন্ধুত্ব। এমনকি রিয়ালের প্রবাদপ্রতীম সভাপতি সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর সঙ্গে বসে দাবা খেলার অভিজ্ঞতাও আছে আলিসিয়ার। মূলত দাদার কাছ থেকে রিয়াল–ভক্ত হওয়ার হাতেখড়ি পেয়েছিলেন আলিসিয়া।
রিয়ালের আনুষ্ঠানিক সদস্য হওয়া নিয়ে আলিসিয়া বলেছেন, ‘আমার দাদা আমাকে সদস্য করে নেন যখন আমার বয়স মাত্র চার বছর। রোববারে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে আমি ও আমার ভাই তাঁকে সঙ্গ দিতাম।’ আলিসিয়ার কার্ড নম্বর ২ হাজার ২৭৫। দুই বছরের জন্য ইংল্যান্ডে পড়তে না গেলে সেটি হাজারের নিচে থাকত বলে বিশ্বাস তাঁর।
শুধু দাদাই নয়, তাঁর বাবা ফ্রান্সিসকো আলফনসো ক্যালদেরনও ছিলেন একনিষ্ঠ রিয়াল ভক্ত, যিনি ক্লাবের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। নিজের বাবা সম্পর্কে আলিসিয়া বলেন, ‘আমার বাবা ২০ নম্বর সদস্যপদ নিয়েই মারা যান।’ ক্যালদেরন নাকি যতটা নিজের পরিবারের জন্য বাঁচতেন, ঠিক ততটাই রিয়ালের জন্যও।
একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে আলিসিয়ার বাবার রিয়ালপ্রীতির পরিচয় পাওয়া যাবে। সে সময় আন্তর্জাতিকভাবে ম্যাচ সম্প্রচারের ব্যবস্থা না থাকায় স্পেনের বাইরে থাকা আলিসিয়ার ভাই নাকি খেলা দেখতে পারতেন না। যে কারণে ক্যালদেরন সব ম্যাচ রেকর্ড করে সেই টেপ স্যুটকেসে করে আলিসিয়ার ভাইয়ের কাছে পাঠাতেন। যেন কোনো ম্যাচ তাঁকে মিস করতে না হয়।
আলিসিয়ার দাবি অবশ্য তিনি তাঁর ভাইয়ের চেয়ে অনেক বড় রিয়াল–ভক্ত। আলিসিয়ার সময়ের জন্য এটা বেশ অভিনবও বটে। কারণ, সে সময় মেয়ে বা নারীদের খুব বেশি ফুটবল নিয়ে আগ্রহ দেখা যেত না। তখন গ্যালারিতে উপস্থিত দর্শকদের মাত্র ১ শতাংশ থাকতেন শুধু নারী। আলিসিয়া বলেছেন, ‘আমার সহপাঠীরা বিস্মিত হয়ে যেত, যখন আমি তাদের বলতাম যে রোববার ম্যাচ দেখতে যাওয়ার কারণে আমি আসতে পারব না।’
পুরুষতন্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত সমাজে একজন নারী ফুটবল–ভক্ত হওয়ার কারণে অস্বস্তি বোধ করেছেন কি না। ‘অস্বস্তি’ শব্দটা শুনে আলিসিয়া যেন একটু অবাকই হলেন, ‘ব্যাপারটা আসলে উল্টো। লোকেরা আমার সঙ্গে অনেক ভদ্র এবং মার্জিত আচরণ করত।’ পাশাপাশি বর্তমানে গ্যালারিতে উপস্থিত পুরুষ দর্শক নারী দর্শকের প্রায় সমান হওয়ায় উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেছেন আলিসিয়া। বলেছেন, ‘আমার সময়ের সঙ্গে এই সময়ের কোনো তুলনায় হয় না।’
আলিসিয়ার পরিবার এতটাই রিয়াল–ভক্ত ছিল যে তাঁর ছোট বোন ফুটবলপ্রেমী না হওয়া সত্ত্বেও রিয়ালের জয় কিংবা হারের প্রভাব এড়াতে পারতেন না। যেমন রিয়ালের হারে ঘরের বেশির ভাগ সদস্য যখন মন খারাপ করে রাখতেন, তখন অন্যজনের মন খারাপ করে রাখা ছাড়া আর কী করার থাকে!
রিয়ালের সমর্থক হিসেবে আনন্দের মুহূর্ত নিয়ে জানতে চাইলে আলিসিয়ার কাছ থেকে অনুমেয় উত্তরই পাওয়া যায়, মাদ্রিদপ্রেমী হিসেবে সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত হচ্ছে বার্সেলোনা ও আতলেতিকো মাদ্রিদের সঙ্গে জেতা। তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের জন্য এই দুটি ম্যাচ জেতা শিরোপা জেতারই সমার্থক।
লা লিগায় প্রথম লেগে বার্সার বিপক্ষে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুয়ে ৩–১ গোলের জয় এবং আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে তাদের মাঠে ২–১ গোলের জয় দারুণ আনন্দ দিয়েছে আলিসিয়াকে। এখন পরের দুটি ম্যাচ জিতলে সেই আনন্দ পূর্ণতা পাবে। আজ রাতে তাই রেফারি যখন এল ক্লাসিকো শুরুর বাঁশি বাজাবেন, তখন আলিসিয়া ও তাঁর পরিবার রিয়ালের সমর্থনে চিরকালীন সমর্থক হিসেবে গলা ফাটাবেন। তবে শুধু এ ম্যাচেই নয়, রিয়ালের সঙ্গে চিরন্তন হয়ে যাওয়া আলফনসো পরিবারের এই সম্পর্ক চলতে থাকবে অনন্তকাল পর্যন্ত।