মেসি-রোনালদোর শ্রেষ্ঠত্বের বিতর্ক কেন এখনো শেষ হয়নি
সূর্য-ডোবা শেষ হলো কেননা সূর্যের যাত্রা বহুদূর—উৎপলকুমার বসু কবিতার এই লাইন নিশ্চয় লিওনেল মেসি কিংবা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে ভেবে লেখেননি। কিন্তু কবিতাকে তো নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করাই যায়। মেসি ও রোনালদোর ক্যারিয়ারের সঙ্গে মিলিয়েও চাইলে এই কবিতার পাঠ নেওয়া যায়। নিশ্চিতভাবেই এই দুজন নিজেদের সেরা সময় পেছনে ফেলে এসেছেন। যে বয়সের কোটায় তাঁরা এখন আছেন, একই বয়সে অনেকে ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন অন্য কোনো কাজে।
মেসি-রোনালদোর সমসাময়িক কেউ কেউ এখন কোচের দায়িত্ব পালন করছেন, কেউ ধারাভাষ্য দিচ্ছেন আবার কেউ পরিবারের সঙ্গে পার করছেন একান্ত সময়। কিন্তু এই দুজনের কথা তো আলাদা, তাঁরা সেরাদের সেরা। ফলে সেরা সময় পেছনে ফেলে এসেও তাঁরা এখনো অমলিন ও সক্রিয়। শ্রেষ্ঠত্বের সূর্য ডোবার পরও এখনো যেন আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
এমনকি তাঁদের মধ্যে কে সেরা, তা নিয়েও বিতর্কের জেরও থামতে দেননি তাঁরা। পাশাপাশি দুজন দুই মহাদেশে গিয়েও পিছু ছাড়েননি একে অপরকে। এখনো প্রায় প্রতিটি ম্যাচ শেষে রেকর্ডের টালি খাতা সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন তাঁরা। মাঠে নামলে এখনো চ্যালেঞ্জ নিচ্ছেন ভিন্ন কিছু করার। নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখার এই জেদই মূলত ফুটবলমঞ্চে সুদৃঢ় করে রেখেছে এই দুজনের অবস্থান।
৩৭ পেরোনো মেসির সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের কথাই ধরা যাক। মেসি অনেকটা একক কৃতিত্বে বদলে দিয়েছেন ইন্টার মায়ামির মতো সাদামাটা একটি দলকে। কখনো শিরোপা না জেতা দলটি মেসির হাত ধরে পুরোপুরি বদলে গিয়ে এখন পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কদিন আগেই রেকর্ড পয়েন্ট নিয়ে শেষ করেছে এমএলএসের রেগুলার মৌসুম। এর পেছনে মেসির অবদান ছিল অনবদ্য।
১৯ ম্যাচে ২০ গোল করার পাশাপাশি অ্যাসিস্ট করেছেন আরও ১০টি। জাতীয় দলেও চিত্রটা একই রকম। শেষ ম্যাচে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে পারফরম্যান্স বাদ দিলে এর আগে মেসি ছিলেন অনন্য। এই তো গত মাসেই বলিভিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ৬-০ গোলের জয়ে দুর্দান্ত এক হ্যাটট্রিক করেছিলেন মেসি। চোটের কারণে বারবার বিপাকে পড়তে না হলে মেসির এই পরিসংখ্যা নিশ্চিতভাবে আরও সমৃদ্ধ হতো।
মেসির চেয়ে কম যান না রোনালদোও! নেশনস লিগে সর্বশেষ পোল্যান্ডের বিপক্ষে জোড়া গোল করেছেন ‘সিআর সেভেন’। এর মধ্যে একটি গোল ছিল অবিশ্বাস্য বাইসাইকেল কিকে। যেভাবে হাওয়াই উল্টো ভেসে কাঁচির ফলার মতো পাটাকে চালিয়ে কিকটি করেছেন, কে বলবে কদিন পর এই লোকটি ৪০ স্পর্শ করবে!
এই গোলকে যে কেউ চমক বা গিমিক বলে উড়িয়ে দেবেন, সে সুযোগও নেই। কারণ, তাঁর সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স। মাঝে ইউরোর পারফরম্যান্স সরিয়ে রাখলে, অবিশ্বাস্য দেখিয়েছেন রোনালদো। সৌদি প্রো লিগে এখন পর্যন্ত ১৫ ম্যাচে খেলে ১০ গোল করেছেন রোনালদো। একইভাবে জাতীয় দলে রোনালদোর ভূমিকা অনন্য। সর্বশেষ ৫ ম্যাচে ৫ গোল করার পাশাপাশি আছে একটি অ্যাসিস্টও।
এ তো গেল দুজনের আলাদা আলাদা পারফরম্যান্সের কথা। একসঙ্গে মিলিয়ে দেখলেও এখনো একে অপরকে তাড়া করছেন তাঁরা দুজন। পোল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অ্যাসিস্টের (গোলে সহায়তা) দিক থেকে মেসিকে ছাড়িয়ে এককভাবে শীর্ষে উঠেছেন রোনালদো। সেদিন পেদ্রো নেতোর গোলে সহায়তা করার পর রোনালদোর অ্যাসিস্ট সংখ্যা হয়েছে ১৭১।
এর আগপর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ১৭০ অ্যাসিস্ট নিয়ে সমতায় ছিলেন এই দুজন। এর আগে গত মাসে দেশের হয়ে হ্যাটট্রিকের রেকর্ড রোনালদোকে ছুঁয়েছিলেন মেসি। জাতীয় দলের হয়ে দুজনেরই হ্যাটট্রিক সংখ্যা এখন সমান ১০। আন্তর্জাতিক বিরতিতে পরের ম্যাচে রোনালদো না থাকায় মেসির সুযোগ পর্তুগিজ অধিনায়ককে ছাড়িয়ে যাওয়ার।
পরিসংখ্যান ও মাঠের লড়াইয়ের বাইরেও দুজনকে নিয়ে আছে নানামুখী আলোচনা। বিভিন্ন সময় সাবেক-বর্তমান ফুটবলাররা এই দুজনের মধ্যে বেছে নিয়েছেন একজনকে। তবে দুজনের মধ্যে তুলনার বাস্তবতা সবচেয়ে ভালো ধরা যাবে ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার মার্সেলোর কথায়, ‘আমি বলতে পারেন না কে সেরা, আমি ক্রিস্টিয়ানোর (রোনালদো) সঙ্গে ১০ বছর খেলেছি। যে অনুপ্রেরণা সে মাঠে দেয়, সেটা অভিনব। আর মেসি দাঁড়িয়ে থাকে, বল নেয় এবং কোনো পূর্বানুমান ছাড়াই গোল করে বসে। তাই কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কে সেরা, সেটা আমাদের বিরক্ত করে। আমরা বরং বলতে পারি, আমরা কাকে বেশি পছন্দ করি, এটা বলতে পারি না যে কে বেশি ভালো।’
হ্যাঁ, মার্সেলোর এই কথার মতোই মেসি-রোনালদোর শ্রেষ্ঠত্ব এখনো ব্যক্তির পছন্দের সীমায় আটকে আছে। একেকজনের কাছে একেকজন সেরা। কেউ কেউ অবশ্য বিশ্বকাপ জয়কে মানদণ্ড ধরে মেসিকেই সবার ওপরে রাখতে চান; কিন্তু তাতে নিশ্চিতভাবেই রোনালদো ভক্তদের আপত্তি থাকে।
পরিসংখ্যান ও অর্জনের সাক্ষ্যপ্রমাণ তো তাঁদের কাছেও আছে। তাই এই বিপরীতমুখী এই বিতর্কের বাইনারিতে না ঢুকে দূর থেকে তাঁদের পারফরম্যান্স উপভোগ করাই তো বোধ হয় বুদ্ধিমানের কাজ, নাকি?