এই ‘ব্রাজিল’ নিয়ে কী করবে ব্রাজিল
৭০ হাজার দর্শকে পরিপূর্ণ ব্রাসিলিয়ার মানে গারিঞ্চা স্টেডিয়াম তখন খানিকটা বেদনাহত। আরও একটি ব্যর্থ লড়াই দেখে ভাঙা মন নিয়ে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় দর্শকেরা। সবাই ততক্ষণে ভেবেও নিয়েছেন, এ ম্যাচ শেষে ব্রাজিলের নিম্নগামী ফুটবল আরেকটু নিম্নগামী হবে। অপেক্ষা ছিল শুধু শেষ বাঁশি বাজার। কিন্তু এমন মন খারাপের আয়োজন যেন পছন্দ হলো না ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের।
ব্রাজিলের প্রথম গোলে পেনাল্টি আদায়ের নেপথ্য নায়ক জ্বলে উঠলেন শেষ মুহূর্তে। বক্সের বেশ বাইরে থেকে বুলেট গতিতে নিলেন শট। বল জালে জড়াতেই সব বদলে গেল ভোজবাজির মতো। ১-১ গোলের সমতায় শেষ হতে যাওয়া ম্যাচটি শেষ হলো ব্রাজিলের ২-১ গোলের জয়ে।
এটুকু বর্ণনায় অবশ্য পুরো ম্যাচের চিত্র স্পষ্ট বোঝা যায় না। বাস্তবতা হচ্ছে, ম্যাচের প্রথম কয়েক মিনিট ও শেষ কয়েক মিনিট বাদ দিলে এই ব্রাজিল দল নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো রসদ আছে সামান্যই। হ্যাঁ, ব্যক্তিগত ঝলকের কিছু মুহূর্ত হয়তো কুড়িয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখার ভিত নেই।
ব্রাজিলের এমন স্বপ্নহীন ফুটবলের শুরুটা অবশ্য আজকে নয়। কাতার বিশ্বকাপের পর থেকেই অদ্ভুত এক দুর্বিপাকের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে ব্রাজিলের ফুটবল। এর মধ্যে নানাভাবে নিজেদের চাঙা করার চেষ্টা করছে তারা। যদিও তেমন কোনো ইতিবাচক ফল এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। ব্রাজিলের সেই ধারাবাহিক নখদন্তহীন ফুটবলে আজকের ম্যাচটি স্রেফ বাড়তি সংযোজন।
আজ কলম্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের শুরুটা বেশ ভালোভাবেই করেছিল ব্রাজিল। প্রথম মিনিট থেকেই ওয়ান টাচ পাসে মুগ্ধতাও ছড়ান ভিনিসিয়ুস-রাফিনিয়ারা। সঙ্গে গতিময়তাও ছিল চোখে পড়ার। অনেক দিন পর তাৎক্ষিণভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোও ছিল বেশ ইতিবাচক। কলম্বিয়ান রক্ষণে বেশ জায়গা বের করে নিজেদের খেলাটা বানানোর চেষ্টা করেছে দরিভাল জুনিয়রের দল।
সেই ধারাতেই ৪ মিনিটের মাথায় কলম্বিয়ান বক্সে ঢুকে ফাউলের শিকার হয়ে পেনাল্টি আদায় করে নেন ভিনিসিয়ুস। স্পট কিকে গোল করেন রাফিনিয়া। এ গোলের পর আরও কয়েক মিনিট ব্রাজিলের ফুটবলে নান্দনিতকার ছাপ ছিল। মনে হচ্ছিল, অনেক দিন পর বুঝি ‘জিঙ্গা’র ছন্দে ডানা মেলতে যাচ্ছে ব্রাজিলের ফুটবল। কিন্তু কিসের কী! ধীরে ধীরে ম্যাচ যত গড়িয়েছে, বেরিয়ে পড়েছে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল-ঐতিহ্যের কঙ্কালসার দেহ।
সমন্বয়হীনতা ব্রাজিলের সাম্প্রতিক ফুটবলে বেশ বড় সাধারণ সমস্যা। আজকের ম্যাচেও সেটি ছিল স্পষ্ট। বিশেষ করে ম্যাচের ২০ মিনিট পর কলম্বিয়া ধাক্কা সামলে নেওয়ার পরই ব্যাকফুটে চলে যায় ‘সেলেসাও’রা। এর মধ্যে গারসন মাঠ ছাড়লে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। আকস্মিকভাবে চাপে পড়ার পর সেই চাপ থেকে বেরোনোর কোনো বিকল্প পরিকল্পনাও যেন ছিল না দলটির। আর এ ধারায় শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ৪১ মিনিটে গোল খেয়ে লিডও হারায় ব্রাাজিল।
ব্রাজিলের আক্রমণভাগে সামর্থ্য নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নেইমার না থাকলেও নিজেদের দিনে ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগো কিংবা রাফিনিয়াদের যে কেউ ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিতে পারেন।
গোল খাওয়ার দৃশ্যটিও বেশ দৃষ্টিকটু। কলম্বিয়া যখন আক্রমণ তৈরি করছিল, তখন নিজেদের বক্সে ব্রাজিলের খেলোয়াড়ের অভাব ছিল না। এমনকি বক্সের ভেতর লুইস দিয়াজ যখন বল পান, তখনো বলের লাইনে দাঁড়ানো ছিলেন চারজন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দিয়াজের শট ব্লক করার তেমন কোনো চেষ্টাই করেনি ব্রাজিল ডিফেন্ডাররা! অনেকটা ‘গার্ড অব অর্নার’ পাওয়ার ভঙ্গিতেই গোলরক্ষকসহ পাঁচজনকে ফাঁকি দিয়ে বল জড়ায় জালে। অথচ যে কেউ এই পরিস্থিতিতে বলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করতেন। চাইতেন অন্তত কোনোভাবে বলটা ‘ক্লিয়ার’ করতে।
কিন্তু সেই মরিয়া শরীরী ভঙ্গিটুকুই আজ দেখা গেল না ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের মধ্যে।
ব্রাজিলের পাসিংও ছিল নিম্ন মানের। শুরুতে দারুণ কিছু পাসে ভালোভাবে শুরুর পর সেটি আর ধরে রাখতে পারেনি তারা।
ব্রাজিল ৮৩ শতাংশ নিখুঁত পাস দিলেও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোতে ভুল পাস দেওয়ার দৃশ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে গতির ওপর আক্রমণে ওঠার সময় একাধিক ভুল পাস দিয়ে সম্ভাবনাময় আক্রমণ নষ্ট করেছে তারা। কখনো বল দিয়েছে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের, আবার কখনো বল বাড়িয়েছে উদ্দেশ্যহীনভাবেই। এভাবে হারিয়েছে প্রচুর সুযোগ।
ব্রাজিলের আক্রমণভাগে সামর্থ্য নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নেইমার না থাকলেও নিজেদের দিনে ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগো কিংবা রাফিনিয়াদের যে কেউ ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিতে পারেন। আজকেরও ম্যাচেও ভিনির তেমন একটি মুহূর্ত ম্যাচটা ব্রাজিলের মুঠোয় এনে দিয়েছে। কিন্তু এটুকুতে আড়াল হচ্ছে না দুর্বলতাগুলো। আক্রমণভাগের তারকা খেলোয়াড়দের বাদ দিলে এই ব্রাজিল বড্ড সাদামাটা। বিশেষ করে ফুলব্যাকদের প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স করতে না পারা বেশ ভোগাচ্ছে দলটিকে।
আজকের ম্যাচেই যেমন রাইটব্যাক পজিশনে ভেন্ডারসন বেশির ভাগ সময় ছিল একেবারেই নিষ্প্রভ। ৭৯ মিনিটে তাঁর বদলে মাঠে নামানো হয় ২১ বছর বয়সী অভিষিক্ত ফুটবলার ওয়েসলি ফ্রাঙ্কাকে। অল্প সময়ের জন্য মাঠে নেমেই ব্রাজিলের খেলায় গতি এনে দিয়েছেন ফ্ল্যামেঙ্গোর এই তরুণ রাইটব্যাক। পাসিংয়ে দক্ষতা দেখানোর পাশাপাশি তৈরি করেছেন একাধিক সুযোগও।
আজকের পারফরম্যান্স হয়তো সামনের ম্যাচগুলোতে আরও বেশি সময় মাঠে থাকার সুযোগ করে দেবে ওয়েসলিকে। পাশাপাশি জোয়াও পেদ্রোর বদলে ম্যাথেউস কুনিয়ার আগমনও ব্রাজিলের খেলাকে ছন্দে ফিরতে সহায়তা করেছে, যদিও তা যথেষ্ট ছিল না।
কিন্তু এক-দুজন বিকল্প খেলোয়াড় মোটেই সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। মাঝমাঠ ও রক্ষণের অন্য খেলোয়াড়দের কাছ থেকে ব্রাজিলের প্রত্যাশা অনেক বেশি। হ্যাঁ, সবাই ভিনিসিয়ুস, রাফিনিয়া বা রদ্রিগোর মতো হবেন না। তবে অন্তত তাঁদের সহযোগী তো অন্তত হতে হবে।
ভিনি-রদ্রিগোদের জ্বলে ওঠার মঞ্চটা তো অন্তত তৈরি করতে হবে। সে ক্ষেত্রে নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্বটুকু অন্তত ঠিকঠাক পালন করলেই হয়। বলতে হবে ব্রাজিল কোচ দরিভালের কথাও। বেশ আশা জাগিয়ে ব্রাজিলের কোচের দায়িত্ব নিয়েছিলেন দরিভাল। শুরুটা বেশ ভালোভাবেই করেছিলেন তিনি। কিন্তু দ্রুতই যেন ফাঁস হয়ে গেছে দরিভালের রণকৌশল। ফলে কৌশলের দিক থেকে প্রতিপক্ষকে খুব একটা ঘায়েল করতে পারছেন না এই ব্রাজিলিয়ান কোচ।
ম্যাচ শেষে অবশ্য উন্নতির কথাও বলেছেন তিনি। কিন্তু উন্নতির জন্য তাঁর হাতে খুব বেশি সময় নেই। দূর ভবিষ্যতের কথা ভাবলে ২০২৬ বিশ্বকাপ আয়োজনে এখন আর দেড় বছরও বাকি নেই। আর নিকট বর্তমানে ব্রাজিলের সামনে অপেক্ষা করছে আর্জেন্টিনার কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এত এত চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে এখন পর্যন্ত নিজেদের হারিয়ে ফেলা সুরটা খুঁজে পায়নি ব্রাজিল। খুব দ্রুত এ সুরের সন্ধান পেতে হবে দরিভালকে। নয়তো অন্ধকার টানেলের পথটুকু যে আরও দীর্ঘ হবে!