আফঈদা–আফরার ফুটবল–পাগল বাবার স্বপ্ন পূরণের গল্প
আর দশজন বাবার মতো নন তিনি। সন্তানদের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্নের পেছনের ছোটেননি। ছুটেছেন তাঁর মতো করে মাঠের সঙ্গে যেন সখ্য গড়েন দুই কন্যা। তা দুই কন্যাই বাবার ইচ্ছা পূরণ করেছেন। বাবা হিসেবে নিজেকে তাই সার্থক ভাবতেই পারেন খন্দকার আরিফ হাসান।
সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুর পৌরসভায় তাঁর বাস। ছোটখাটো ব্যবসা করেন। তবে ২০১১ সালে ‘স্টুডেন্টস ফুটবল একাডেমি’ নামে ফুটবলের-পাঠশালা খুলে ‘খেলোয়াড় তৈরির কারিগর’ তকমা লাগিয়েছেন গায়ে। জনা পঞ্চাশেক ছেলেমেয়ে ফুটবল শেখে তাঁর কাছে। পরশু বিকেলে ঢাকা থেকে আরিফ হাসানের সঙ্গে যখন মুঠোফোনে কথা হয়, তখনো তিনি সুলতানপুর পিএন উচ্চবিদ্যালয়ে মাঠে ছেলেমেয়েদের অনুশীলন করাচ্ছিলেন। জিমন্যাস্টিকস ও বক্সিং কোচও তিনি। খেলোয়াড় ছিলেন বলে খেলার প্রতি অসম্ভব প্রেম ৫৬ বছর বয়সী মানুষটার।
কতটা প্রেম, তা বোধহয় বোঝা যাবে তাঁর এই কথায়, ‘খুব ছোটবেলা থেকে খেলি। বলতে পারেন ফুটবল–পাগল ছিলাম। সাতক্ষীরা জেলা দলে খেলেছি। খুলনা বিভাগীয় যুব দলে খেলা হয়েছে। ঢাকায় শান্তিনগর ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবলে খেলেছি ১৯৮৯-৯০ সালে। এ কারণেই আমি চেয়েছি, আমার দুই মেয়েই খেলাধুলায় আসুক।’
বাবার ইচ্ছা পূরণ করেছেন মেয়েরা। বড় মেয়ে আফরা খন্দকার বক্সার হয়েছেন আগেই। বক্সিংয়ে এসেই জাতীয় পর্যায়ে স্বাধীনতা কাপে রুপা জেতেন। বিজয় দিবস, যুব গেমসে জেতেন সোনা। ২০২১ সালে সিনিয়র প্রতিযাগিতায় রুপা। পেশাদার বক্সার হিসেবে খেলেছেন তিনটি প্রতিযোগিতায়। একটিতে জিতেছেন, হেরেছেন দুটিতে।
আফরার তিন বছরের ছোট আফঈদা খন্দকারকে নতুন করে পরিচয় করানোর কিছু নেই। গত অক্টোবরে কাঠমান্ডুতে সাফ শিরোপা ধরে রাখা বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য। মাত্রই গলায় ঝুলিয়েছেন একুশে পদক। সম্প্রতি কোচ পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ১৮ খেলোয়াড়ের মধ্যে ছিলেন না সেন্টার ব্যাক আফঈদা। তারই পুরস্কার হিসেবেই কি না, সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে জাতীয় দলের নতুন অধিনায়ক হিসেবে তাঁকে বেছে নিয়েছেন কোচ পিটার বাটলার। গত রাতে আমিরাতের বিপক্ষে দুবাইয়ে বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে আফঈদার অভিষেক হয়েছে।
ফুটবলার আফঈদার ভিত্তিভূমি বিকেএসপি। ২০১৬ সালে সাভার বিকেএসপিতে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পথচলা শুরু। বোন আফরাও বিকেএসপির সাবেক ছাত্রী। দুই বোনের সামনেই সিঁড়ি পেতে দেয় বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এমন মাহেন্দ্রক্ষণে খন্দকার পরিবারে উচ্ছ্বাসের ঢেউ বইছে। বোন আফরার ভাষায়, ‘বলতে পারেন আমাদের পরিবারে এখন খুশির বন্যা। আমাদের স্বপ্ন ছিল আফঈদা একদিন জাতীয় দলের অধিনায়ক হবে। সেটা পূরণ হয়েছে।’ বাবা মনে করছেন নতুন ভূমিকায়ও সফল হবে মেয়ে, ‘সে গত বছর সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্টে অধিনায়ক হিসেবে চ্যাম্পিয়ন করেছে বাংলাদেশকে। আমার বিশ্বাস, জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবেও খুব ভালো করবে। দলটা তরুণদের নিয়ে হলেও ভালো ভালো খেলোয়াড় আছে।’
ফুটবলার আফঈদার ভিত্তিভূমি বিকেএসপি। ২০১৬ সালে সাভার বিকেএসপিতে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পথচলা শুরু। বোন আফরাও বিকেএসপির সাবেক ছাত্রী। দুই বোনের সামনেই সিঁড়ি পেতে দেয় বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেটাও অন্য রকম এক গল্প তৈরি করে। বাবার মুখেই শোনা যাক তা, ‘২০১৬ সালে আফরা সাভার বিকেএসপিতে চার মাসের ক্যাম্পে যায়। ছোট মেয়ে আফঈদাকে তখন বিকেএসপিতে নিয়ে যাই বড় বোন কোথায় অনুশীলন করে সেটা দেখাতে। পাকেচক্রে তখন দুই বোন একসঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। টিকে যায় ছোট মেয়ে, বড় মেয়ে বাদ পড়ে। বুঝুন অবস্থা!’
একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে বিষাদ। খন্দকার পরিবারে তখন দুই রকম অনুভূতি। দুই বোনই কাঁদছেন। একদিকে প্রাপ্তি, অন্যদিকে প্রান্তি (দুজনের ডাক নাম, বাবার ডাক নাম প্রিন্স)। দুই বোন একে অন্যকে ছেড়ে থাকবে কী করে! ‘তখন আমরা ঠিক করি বড় মেয়েকেও বিকেএসপিতে ভর্তি করাতেই হবে। বাড়ি এনে ওকে ক্রিকেট সেট কিনে দিয়ে ছয় মাস একটানা অনুশীলন করাই আমি। এরপর ভর্তি করি সাতক্ষীরা শুটিং ক্লাবে। কিছুদিন পর সাতক্ষীরায় বক্সিং প্রতিভা অন্বেষণে আসে বাংলাদেশ বক্সিং ফেডারেশনের প্রতিনিধিদল। আফরার ফিটনেস দেখে ওকে বক্সিংয়ে নির্বাচন করা হয়। পরে বক্সিং ফেডারেশনের সুপারিশে ২০১৭ সালে অষ্টম শ্রেণিতে বিকেএসপিতে ভর্তি করা হয় আফরাকে।’ আরিফ হাসানের কাছে সবকিছু এখন রোমাঞ্চকর লাগে।
বিকেএসপি থেকে ২০১৮ সালে আফঈদা বাফুফের ক্যাম্পে আসেন। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে আফরা বিকেএসপি থেকে বেরোন ২০২১ সালে। আফরা এখন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়ে ক্রীড়াবিজ্ঞানে পড়ছেন। আফঈদা এইচএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা ২৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু আমিরাত সফরে যাওয়ায় তাঁর ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা করার অনুরোধ জানিয়ে বাফুফে চিঠি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে।
আমার স্বপ্ন ছিল ওদের খেলাধুলা শেখাব। কারণ, আমি মনে করেছি খেলাধুলায়ও জীবন গড়া যায়। তাই নিজে ওদের খেলাধুলা শিখিয়েছি। আমি আজ সফল।
দুই বোন একে অন্যের ভালো বন্ধু। ছোট বোনকে নিয়ে আফরা বলছিলেন, ‘ও চুপচাপ স্বভাবের। ছবি তুলতে পছন্দ করে না। তবে আমি এর বিপরীত।’ ওদিকে দুই মেয়েকে এক সুতোয় গাঁথতে পেরে তৃপ্ত বাবা, ‘আমার স্বপ্ন ছিল ওদের খেলাধুলা শেখাব। কারণ, আমি মনে করেছি খেলাধুলায়ও জীবন গড়া যায়। তাই নিজে ওদের খেলাধুলা শিখিয়েছি। আমি আজ সফল।’
কিন্তু শুরুটা মসৃণ ছিল না। আফরা তা মনে করে নিজেদের সুখী ভাবেন, ‘ছোটবেলায় বাবা আমাদের দুই বোনকে মাঠে নিয়ে যেতেন। ফুটবল শেখাতেন। আমরা যখন শুরু করি, লোকে নানা কথা বলত। মেয়েরা হাফপ্যান্ট পড়ে কেন খেলবে। তবে আমরা ভালো করায় এখন কেউ কিছু বলে না।’
দুই মেয়ে পিঠে পেয়েছেন মায়ের সহযোগিতার হাতও। মা মমতাজ খাতুন স্কুল, কলেজে অ্যাথলেটিকস করতেন। সাতক্ষীরা জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য ছিলেন। খুলনা বিভাগীয় অদম্য নারী ২০২৪-এ সফল জননী পুরস্কার পেয়েছেন ২৩ ফেব্রুয়ারি। একই দিনে আফঈদার নাম জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। আদরের ছোট মেয়ের কাছে এর চেয়ে বেশি আর কী চাইতেন পারতেন আরিফ-মমতাজ দম্পতি!