ল্যাপটপ কোচ থেকে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন কোচ
২০০৮ সালে ইন্দো–বাংলা গেমসের ক্যাম্প চলছে। ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে আবাসনব্যবস্থা আর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় অনুশীলন। শীতের এক সকালে অনুশীলনে গিয়ে জানতে পারলাম, আজ আমাদের ওয়ার্মআপ করাবেন এমন একজন, যিনি আমাদের দলের কোচিং স্টাফের কেউ নন। এমনকি যাঁর সঙ্গে আমাদের আগে কখনো পরিচয়ও হয়নি।
স্বল্পভাষী এক ভদ্রলোক তাঁর নাম মারুফুল হক পরিচয় দিয়ে ‘ফিফা টেন’ নামে কী যেন বলে ওয়ার্মআপ শুরু করলেন। ফিফা টেন নাম শুনে দু–একজন সিনিয়র খেলোয়াড় ভ্রু কুঁচকালেন। ভ্রু কুঁচকানোই স্বাভাবিক। কারণ, আগে আমরা কখনো সেই বিশেষ ওয়ার্মআপ করা দূরের কথা, নামও শুনিনি। আমি দলের জুনিয়র খেলোয়াড়। ভ্রু–ট্রু না কুঁচকে নতুন কিছু করতে যাওয়ার আনন্দ নিয়ে তাঁকে অনুসরণ করলাম। কয়েক বছর বাদে জানতে পেরেছি, সেই ফিফা টেন হলো চোট থেকে রক্ষা পাওয়ার বিশেষ ওয়ার্মআপ। ফিফা টেকনিকাল কমিটির অধীনে যা এখন ধাপে ধাপে উন্নত হয়ে ফিফা ফোরটিন (১৪টি ব্যায়াম) নামে পরিচিত।
সেই ২০০৮ সালেই বাড্ডা জাগরণীতে আমার ‘পেশাদার’ ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু। দলের কোচ হিসেবে পেলাম সেই মারুফুল স্যারকে। অনুশীলনের প্রথম সেশনেই তিনি আমাদের সবার ওজন নিলেন। খেলোয়াড়েরা তো বলেই ফেললেন, ‘খেলতে এসেছি ফুটবল, আমাদের ওজন দিয়ে কোচ কী করবেন?’
আসলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মারুফুল হলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা কোচ। প্রায় সবাই একবাক্যে বলে থাকেন, বাংলাদেশের ফুটবলে আধুনিক কোচিং এসেছে মারুফুলের হাত ধরেই। কথাটার স্বীকৃতির দলিল হলো দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম উয়েফা ‘এ’ লাইসেন্সধারী কোচ বাংলাদেশের মারুফুল।
অথচ কোচিং ক্যারিয়ারের শুরুতে কত কটু কথাই না শুনতে হয়েছে মারুফুলকে! সর্বোচ্চ পর্যায়ে না খেলে কোচ হয়ে গেছেন, শুরুতে এই বিষয়টি তো মানতেই পারতেন না আমাদের কিছু সাবেক ফুটবলার ও কোচ। শুরুর দিকে কটু ভাষায় তাঁকে বলা হতো ‘ল্যাপটপ কোচ’। তখন বাংলাদেশের কোনো কোচ ল্যাপটপে দলের ট্যাকটিক্যাল বিষয় পাওয়ার পয়েন্টে উপস্থাপন করে বিশ্লেষণ করবেন, এমনটা ছিল কল্পনার বাইরে। তাই তাঁর নাম হয়ে গেল ল্যাপটপ কোচ। আর আমরা হয়ে গেলাম ল্যাপটপ কোচের খেলোয়াড়। সেই ল্যাপটপ কোচই এখন বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন কোচ। সাফের বয়সভিত্তিক আসরে যে ট্রফিটি এত দিন অধরা ছিল, গতকাল সে ট্রফিটাই জিতল মারুফুলের বাংলাদেশ।
তা–ও কিনা বাংলাদেশের যুবারা ম্যাচটা জিতল স্বাগতিক নেপালের বিপক্ষে ৪-১ গোলে। এই তো ২০২২ সালের টুর্নামেন্টে অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো ফাইনালেই ব্রিটিশ কোচ পল স্মলির বাংলাদেশ ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটি হেরেছিল ৫–২ গোলে।
আগে ফাইনাল নাম শুনলেই বাংলাদেশের ফুটবলারদের গলা শুকিয়ে যেতে দেখেছি। সেই ফাইনালের গা থেকে বড় ম্যাচের চাপকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে পাড়ার ম্যাচ বানিয়ে ফেললেন মিরাজুল ইসলাম, রাহুল, আসিফ ভূঁইয়ারা।
বাংলাদেশের ফুটবলাররা আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল করতে জানেন না! চলমান এমন অভিযোগের দায় মাথায় নিয়ে ফাইনাল ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে এক হালি গোল। তা–ও আবার ৭০ মিনিটের মধ্যেই ৩–০ গোলে এগিয়ে যাওয়া। খেলা শেষ হওয়ার পর এক রাত পার হয়ে গেলেও চিমটি কেটে বিশ্বাস করতে হচ্ছে।
ঘরোয়া ফুটবলে একের পর এক শিরোপা জেতায় মারুফুলের নামের পাশ থেকে ল্যাপটপের কোচের কটু তকমা কেটে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভালো ফুটবল কোচের মানদণ্ডে পৌঁছতে হলে বিদেশি হওয়াটা একপ্রকার অলিখিত নিয়ম। মারুফুল বাংলাদেশি হওয়ায় তিনি আবার কিসের ফুটবল কোচ!
তাই মারুফুল মোহামেডানকে কোটি টাকার সুপার কাপ চ্যাম্পিয়নই বানান না কেন, দেশের একমাত্র কোচ হিসেবে শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রকে ‘ট্রেবল’ জেতাক না কেন, তরুণদের নিয়ে গড়া আরামবাগকে নিয়ে রূপকথায় জন্ম দিক না কেন—আমাদের তাতে রোচে না। স্বাভাবিকভাবেই তিনি যেহেতু বিদেশি কোচদের মতো ঘাড় ঝাঁকি দিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে কথাও বলতে পারেন না, কোচ হিসেবে তাঁকে আবার গোনায় ধরার কী আছে!
কেউ দায়িত্ব নেওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। আমার দেশ। আমি তো আর ভয়ে দেশকে অগ্রাহ্য করতে পারি না।
স্বয়ং বাফুফে সভাপতি কথায় কথায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে থাকেন দেশি কোচদের। তাই বাফুফেও এই যোগ্য লোককে সেভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। না খেলোয়াড় তৈরিতে, না কোচ তৈরিতে। অথচ দেশের ফুটবল উন্নয়নে রোডম্যাপ কী হওয়া উচিত? তাঁর চেয়ে ভালো আর কে–ই বা জানেন! উল্টো বাফুফের অনিয়ম নিয়ে কথা বলায় দেশের সর্বোচ্চ ফুটবল সংস্থার নিষেধাজ্ঞাও পড়তে হয়েছে তাঁকে।
এবারও তো তাঁর গর্দান যেত! মারুফুলের হাতে দল তুলে দিয়ে মাত্র দুই সপ্তাহের প্রস্তুতির ব্যবস্থা করে দেয় বাফুফে। আবারও বলছি, মাত্র দুই সপ্তাহের প্রস্তুতি নিয়ে সাফের এই টুর্নামেন্টটি খেলতে গিয়েছিল বাংলাদেশ। ভাবা যায়!
এই স্বল্প প্রস্তুতিতে রেজাল্ট ভালো হলে তো ভালোই, আর রেজাল্ট খারাপ হলে কোচের দোষ। আর মারুফুল হক যেহেতু বাংলাদেশের কোচ, তাঁকে বলির পাঁঠা বানানো তো বাঁ হাতের খেল।
খেলোয়াড়েরা একেবারেই খেলার বাইরে ছিলেন। তাই প্রস্তুতির জন্য দুই সপ্তাহ সময়টা একেবারেই অপ্রতুল। কিন্তু ইতিহাসের কোনো পাতাতেই এসব প্রতিকূলতার গল্প লেখা থাকবে না। ইতিহাসে জয়ীদের বীরত্বের গল্প লেখা থাকে। পরাজিতদের ব্যর্থতার অজুহাত সেখানে ব্রাত্য।
কোচ হিসেবে এমন দলের দায়িত্ব নেওয়া, জেনেশুনে বিষ পান করার মতো। একবার মারুফ স্যারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আগাম বিপদ জেনেও এই অল্প সময়ের জন্য দলের দায়িত্ব নিলেন কেন? উনার জবাব ছিল, ‘কেউ দায়িত্ব নেওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। আমার দেশ। আমি তো আর ভয়ে দেশকে অগ্রাহ্য করতে পারি না। ’
এটাই কোচ মারুফুল। অভিবাদন মারুফুল হক।
লেখক: জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার ও সাবেক ক্রীড়া সাংবাদিক