ক্লাসিকোতে কী করতে হয় এমবাপ্পে তো জানেনই
আশিকুজ্জামান টুলুর সঙ্গে কিলিয়ান এমবাপ্পের পরিচয় সম্ভবত নেই কিংবা থাকতেও পারে কে জানে, যেহেতু পৃথিবী গোল, চলার পথে তাই দেখা হতেও পারে। দুজন দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা হওয়ায় তা হয়নি এখনো, ধরে নিয়েই বলা যায় সংগীতের ভাষা আসলেই বৈশ্বিক। কীভাবে সেটাই বলছি।
নব্বইয়ের দশকে টুলুর লেখা ও সুর করা ‘স্টারস২’ মিক্সড অ্যালবামে জনপ্রিয় একটি গানের শুরুটা ছিল এমন, ‘কত রাত কেটে গেছে নির্ঘুম প্রহরে...।’ অনেকের মতো এমবাপ্পের জীবনেও এমন নির্ঘুম রাত এসেছে। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতেন শৈশবে। একদিন রিয়াল মাদ্রিদে খেলবেন...। গত জুলাইয়ে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে এমবাপ্পেকে রিয়াল মাদ্রিদ নিজেদের খেলোয়াড় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সেই অনুষ্ঠানে ফরাসি তারকা অজান্তেই টুলুর লেখা সেই লাইনকে প্রকাশ করেছিলেন অন্যভাবে, অন্য সুরে, ‘অসংখ্য রাত স্বপ্ন দেখে কেটেছে একদিন খেলব রিয়াল মাদ্রিদে।’
বাকিটা নিশ্চয়ই আপনার জানা।
রিয়ালের সঙ্গে এমবাপ্পের পাঁচ বছরের চুক্তি হলো। আগস্টে অভিষেকও হয়ে গেল সাদা জার্সিতে। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এরই মধ্যে ১৩ ম্যাচে ৮টি গোল, ২টি গোলও করিয়েছেন। কিন্তু এই অল্প সময়ে রিয়াল–সমর্থকদের মনে রাখার মতো কিছু কি এখনো করতে পেরেছেন এমবাপ্পে? প্রশ্নটির উত্তর যদি ‘না’ হয়, তবে এটাও বলতে হবে, রিয়ালে এমবাপ্পের শুরুটা একেবারে মন্দও হয়নি। সহজ কথায় সন্তোষজনক, তবে প্রত্যাশাপূরণ হয়নি।
বড় মাপের খেলোয়াড়েরা সমর্থকদের মনে চিরস্থায়ী দাগ কাটতে বেছে নেন বড় মঞ্চকে। ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় দ্বৈরথ ‘এল ক্লাসিকো’ তেমনই এক মঞ্চ। রিয়াল ও বার্সার ধ্রুপদি এই দ্বৈরথের নাম শুনলে মনের মধ্যে কাদের ছবি ভেসে ওঠে? ইউটিউব কিংবা পুরোনো অ্যালবাম থেকে উঠে আসেন আলফ্রেড ডি স্টেফানো, লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, জাভি, করিম বেনজেমারা। অন্য ভাষায় এই মঞ্চের কিংবদন্তিরা বার্নাব্যু কিংবা ক্যাম্প ন্যুতে কিংবা অন্য কোথাও এই দ্বৈরথে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন তাঁরা। প্রশ্ন হলো, এমবাপ্পে কি হাঁটতে পারবেন তাঁদের পথে?
রিয়ালে যাত্রা শুরু করেও সত্যিকার অর্থে এখনো যাত্রা শুরু করতে না পারা এমবাপ্পের ক্যারিয়ারে আজ রাতের ক্লাসিকোই প্রথম। অর্থাৎ ধ্রুপদি এই দ্বৈরথে তাঁর অভিষেকের লগ্ন। অনেকের চোখেই প্রথম ক্লাসিকো এমবাপ্পের রিয়াল ক্যারিয়ারে ডাইভিংয়ের সেই স্প্রিংবোর্ড, যার এক কোনায় দাঁড়িয়ে দুলতে দুলতে গ্রেগ লুগানিসের (ডাইভিং কিংবদন্তি) মতো জলের কোলে নিখুঁত একটি ডাইভের মতো পারফরম্যান্স কি আজ বার্নাব্যুতে দেখা যাবে তাঁর কাছ থেকে? সেটি পারলে এই ম্যাচ থেকেই সত্যিকার অর্থে শুরু হবে তাঁর রিয়াল-ক্যারিয়ার। পৃথিবীর সবচেয়ে জমজমাট ও জনপ্রিয় এই ক্লাব দ্বৈরথে ডি স্টেফানো, মেসি, রোনালদোদের রেখে যাওয়া পরম্পরার পথে তখন যাত্রা শুরু হবে এমবাপ্পেরও। সেটি আসলে কিংবদন্তি হয়ে ওঠার পথ।
পাল্টা যুক্তি উঠবে, ২৫ বছর বয়সী এমবাপ্পে কি এখনই কিংবদন্তি হয়ে ওঠেননি? ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছেন ১৯ বছর বয়সে। তখন উঠেছিল পেলের সঙ্গে তুলনাও। চার বছর পরের বিশ্বকাপের ফাইনালে হ্যাটট্রিক! সেবার শিরোপা জিততে পারেননি, কিন্তু সর্বোচ্চ গোল করে জিতেছিলেন সোনার বুট, দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড় হিসেবে জিতেছিলেন রুপার বলও। রিয়ালে আসার আগে তাঁর পিএসজি ক্যারিয়ারও ভুলে যাওয়ার উপায় নেই। ছয়বার লিগ ও ক্লাবটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোল করে এসেছেন মাদ্রিদে। কিংবদন্তি হতে তাই আর কী চাই!
না, আর তেমন কিছু না হলেও চলবে। কিন্তু চ্যালেঞ্জটা অন্য জায়গায়। তার কিছুটা নিজের কাছে, কিছুটা এই পৃথিবীর সামনেও। রিয়ালে যোগ দেওয়া ছিল এমবাপ্পের আশৈশব লালিত স্বপ্ন। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে সেই স্বপ্নপূরণের পর রিয়ালের ইতিহাসে যে ম্যাচটিকে সম্মান ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিক থেকে সবচেয়ে বড় বিবেচনা করা হয়, সেখানে কিছু না করলে চলে! খেলাধুলায় ‘টিকিং এভরি বক্স’ বলে একটি কথা আছে। বিশ্বকাপ, নেশনস লিগ, লিগ আঁ—এমবাপ্পে এসব বক্সে টিকচিহ্ন আদায় করে নিয়েছেন পারফরম্যান্স দিয়ে। ক্লাসিকোও তাঁর জন্য তেমনই এক বক্স—এখানেও সেই ছাপ রাখতে হবে তাঁকে যদি সব জায়গাতেই নিজের ছাপ রেখে যেতে চান এমবাপ্পে। আর সেটি করার আদর্শ সময় এখন নয় তো কখন!
উপলক্ষ কম নেই। রিয়াল আজ না হারলে লিগে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদেরই টানা ৪৩ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলবে। আছে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থাকা বার্সাকে ধরারও সুযোগ। দুই দল সমান ১০ ম্যাচ করে খেললেও ৩ পয়েন্ট পিছিয়ে দুইয়ে রিয়াল (২৪)। এমন পরিস্থিতিতে গোল করে রিয়ালকে জেতানোর অর্থ কী হতে পারে, সেটা বোঝেন সবাই। এমবাপ্পের কানে কি তা আলাদা করে তোলার প্রয়োজন আছে? আনচেলত্তি তা মনে করেন না, ‘আমাদের তাড়া নেই। তারও নেই...সে জানে কী করতে হবে...আমরা আত্মবিশ্বাসী (ক্লাসিকোয়) সে দলের জন্য কিছু করবে।’
ক্লাসিকোর কিংবদন্তি হয়ে ওঠা কিংবা ক্লাসিকোর মাধ্যমে আলাদা করে নিজের ছাপ রাখার পরম্পরার কথা বলা হচ্ছিল। সালসহ কিছু নাম বলা যাক—মেসি (২০০৪), ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (২০০৯), জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ (২০০৯), ডেভিড ভিয়া (২০১০), নেইমার (২০১৩), গ্যারেথ বেল (২০১৩), ভিনিসিয়ুস জুনিয়র (২০১৯), জুড বেলিংহাম (২০২৩) ও লামিনে ইয়ামাল (২০২৩)। ক্লাসিকোয় তাঁদের সবারই হিরণ্ময় অভিষেক হয়েছে। অন্যভাবে বললে, নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে অভিষেকেই দাগ কেটেছেন। এই ৯টি নামের মধ্যে শুধু ইব্রাহিমোভিচ বার্সায় বেশি দিন না থাকায় (দুই মৌসুম মিলিয়ে ৪৬ ম্যাচ) এই দ্বৈরথে তাঁর নামটা সেভাবে আলোচনায় আসে না।
এমবাপ্পের অবশ্য বার্সার মুখোমুখি হওয়ার অতীত অভিজ্ঞতা বেশ ভালো। পিএসজির হয়ে চারবারের মুখোমুখিতে জিতেছেন দুবার, একটি ড্র ও হার একটি। গোল ৬টি। এর মধ্যে ২০২০-২১ মৌসুমে শেষ ষোলোয় ক্যাম্প ন্যুতে বার্সার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই করেছিলেন হ্যাটট্রিক। বি সকার প্রো ডাটা জানিয়েছে, বার্সার বিপক্ষে অন্তত তিন ম্যাচ খেলা খেলোয়াড়দের মধ্যে এমবাপ্পের গোলগড়ই সবচেয়ে ভালো (১.৫)।
পিএসজির জার্সিতেই যদি এমন ভালো হয়, তাহলে রিয়ালের জার্সিতে কেমন হবে? এমবাপ্পে শৈশব থেকে যে স্বপ্ন লালন করেছেন, যাঁরা তাঁর সে স্বপ্ন পূরণও করেছেন, তাঁদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে আলাদা করে কোনো প্রেরণা লাগে? আনচেলত্তি তাই বলেছেন, ‘ম্যাচের আগে সে শান্ত থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
ঝড়ের আগে প্রকৃতি নাকি শান্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ ঝড় আসছে!