মেসি-ম্যারাডোনায় আড়াল কে এই ‘সর্বকালের সেরা’ আর্জেন্টাইন ফুটবলার

ম্যারাডোনা ও মেসির মাঝে এনরিক গার্সিয়াসংগৃহীত

তাঁর জন্ম সান্তা ফেতে, তাঁর বাঁ পায়ে বল যেন মায়ের কোলে শিশুর মতোই ছিল নিরাপদ। অনেক আর্জেন্টাইনের কাছে তিনিই সর্বকালের সেরা ফুটবলার—এটুকু ইশারা দেওয়ার পর বেশির ভাগ পাঠকই হয়তো মুচকি হাসিতে ইশারাদাতাকে বোকা ভাবতে ভাবতে নামটা বলে দেবেন! ভাবতে পারেন, লিওনেল মেসির কথা বলার জন্য এত ইশারা দিতে হয় নাকি!

হ্যাঁ, ওপরের প্রতিটি ইঙ্গিত মিলে যায় মেসির সঙ্গে। আর্জেন্টিনা, সান্তা ফে প্রদেশ (মেসির জন্ম সান্তা ফে প্রদেশের রোজারিওতে), বাঁ পা—সবই তো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে মেসির নামের সঙ্গে। তবে কথাগুলো আসলে মেসিকে নিয়ে নয়, এ কথাগুলো বলা হয়েছে এমন একজনের জন্য, যিনি পৃথিবীর আলোয় এসেছিলেন মেসির জন্মের ৭৫ বছর আগে। সেই একই শহরে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা, যেখান থেকে উঠে এসেছেন মেসিও। খেলতেনও মেসির মতো বাঁ পায়েই। এর চেয়ে বরং বলা ভালো মেসিও খেলেন তাঁর মতো বাঁ পায়ে!

আরও পড়ুন

তাঁকে সামনে থেকে খেলতে দেখেছেন—এমন অনেকের কাছে তিনিই ছিলেন আর্জেন্টিনার সেরা ফুটবলার। মেসি ও ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে মনে রেখে কেউ যদি অন্য কোনো আর্জেন্টাইনকে সেরা বলেন, তিনি তো আসলে বিশ্বসেরার কথাই বলছেন।

যে মানুষকে নিয়ে এত নাটকীয় বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে, মেসি বা ম্যাডোনার ভক্তরা নিশ্চয়ই কোঁচকানো ভ্রুর বিরক্তি নিয়ে তাঁর নামটা জানতে উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠেছেন। তাহলে বলেই ফেলা যাক, নাম তাঁর এনরিক গার্সিয়া। আধুনিক ফুটবলে পরিচিত কোনো নাম নয়। কিন্তু যাঁরা তাঁকে খেলতে দেখেছেন, তাঁদের অনেকের কাছে তিনিই সর্বকালের সেরা আর্জেন্টাইন ফুটবলার। গার্সিয়ার আদুরে ডাকনামটাই তাঁর প্রতিভার অনেকটুকু তুলে ধরতে পারে—বাঁ পায়ের কবি!

মেসি ও ম্যারাডোনা দুজনেই বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন আর্জেন্টিনাকে
এক্স

১৯১২ সালের ২০ নভেম্বর সান্তা ফেতে জন্ম গার্সিয়ার। স্থানীয় ক্লাব লা রোসাসে শুরু হয় তাঁর ফুটবল–যাত্রা। ১৯৩২ সালে তিনি আসেন জিমনেসিয়া ওয়াইএস গ্রিমাতে। সেখানে সান্তা ফে স্থানীয় চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি জেতেন গার্সিয়া। গোল করার দক্ষতার কারণে ক্লাবটিতে তিনি নাম পেয়ে যান ‘এল পিস্তেলেরোস (দ্য গানম্যান)’। পরে অবশ্য স্থানীয় পত্রিকা এল লিটোরালের এক সাংবাদিকের দেওয়া এল পোয়েতা (বাঁ পায়ের কবি) বিশেষণটি বাকি সবকিছু ছাপিয়ে যায়।

আরও পড়ুন

এক বছর পর গার্সিয়াকে কিনে নেয় রোজারিও সেন্ট্রাল। তাঁর জন্য ক্লাবটি খরচ করে ৫ হাজার ডলার। ১৯৩৬ সালে প্রায় ৩৮ হাজার ডলারে রোজারিও থেকে রেসিং ক্লাব সেন্ট্রালে নাম লেখান গার্সিয়া, যা সে সময় আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বেশি ট্রান্সফার ফি ছিল। লম্বা সময় ধরে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে দামি ফুটবলারের তকমাটা ছিল গার্সিয়ার পিঠেই। এর মধ্যে ১৯৩৫ সালে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হয় গার্সিয়ার। জাতীয় দলের ক্যারিয়ারে ৩৫ ম্যাচ খেলে ৯ গোল করেন এ উইঙ্গার।

প্রায় ১০০ বছর আগের একজন ফুটবলারকে কেবল পরিসংখ্যান বা সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে মাপতে যাওয়া অবশ্য কিছুটা বোকামিই। সংখ্যার খচখচানি যতটা সত্য বলবে, তার চেয়ে বেশি বিভ্রান্ত করবে। এই মহাতারকারা মূলত বেঁচে থাকেন কিংবা বেঁচে ওঠেন পুরাকথা বা রূপকথার বাঁকে বাঁকে। ইতিহাসের পথে পথে ছড়িয়ে থাকা ধুলোয় খুঁজে নিতে হয় তাঁদের পদছাপ। যেমন কথিত আছে, গার্সিয়া নাকি গোলের পর পা টেনে টেনে মাঝমাঠে নেমে আসতেন। ফেরার সময় পা দিয়ে আবিরের মতো করে ধুলো ওড়াতেন। এটি তিনি এ জন্য করতেন, যেন পায়ের ছাপ দেখে কেউ তাঁর খেলা নকল করতে না পারে!

গার্সিয়া নাকি গোলের পর পা টেনে টেনে মাঝমাঠে নেমে আসতেন। ফেরার সময় পা দিয়ে আবিরের মতো করে ধুলো ওড়াতেন। এটি তিনি এ জন্য করতেন, যেন পায়ের ছাপ দেখে কেউ তাঁর খেলা নকল করতে না পারে!

১৯৪০ সালে এল গ্রাফিকো পত্রিকায় গার্সিয়াকে নিয়ে এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, ‘সে আলাদা, সবার সেরা। কর্নারে, বক্সের ভেতর, তার শট, খেলা, নাচ, মিথস্ক্রিয়া, নমনীয়তা…সবকিছু সে করে এক পায়ে। বাকি পা’টা স্থির হয়েই থাকে। তার অবশ্য আর কিছু লাগেও না।’

কিংবদন্তি ক্রীড়া সাংবাদিক দান্তে পানজেরি বলেছিলেন, ‘সে ইতিহাসের সেরা লেফট উইঙ্গার। সম্ভবত দলের দিক থেকে ফেলিক্স লুসতাউ দলের জন্য ভালো। কিন্তু চুয়েকো (হাঁটার ভঙ্গির কারণে এ নামেও তাঁকে ডাকা হতো) মাঠের পজিশনের দিক থেকে সেরা।’

রেসিংয়ের সাবেক লেফট উইঙ্গার এজরা সুয়েড তাঁকে তুলনা করেছিলেন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী গার্ডেলের সঙ্গে, ‘সে অনন্যসাধারণ, মহৎ, ফুটবলের গার্ডেল। সে এমন একজন খেলোয়াড়, যে এমন একটি খেলা আবিষ্কার করেছে, যা পরে অন্যরা অনুকরণের চেষ্টা করেছে। দৌড়ানোর সময় মাঝমাঠে পাস ছুড়ে দেওয়া কিংবা আশ্চর্য চকিত সব গোল অথবা গোলরক্ষক এবং পোস্টের মাঝে নিখুঁতভাবে বল প্লেস করা—সবকিছুতেই সে অনন্য।’

নিজের বাঁ পায়ে গার্সিয়ার ছিল অটুট আত্মবিশ্বাস। দুই পায়ে কেন একইভাবে কার্যকর নন, জানতে চাইলে তাঁর উত্তর ছিল এমন, ‘যদি আমি দুই পায়েই খেলতে শিখে যেতাম, তবে আপনার কি মনে হয় আমি বাঁ পায়ে এতটা শক্তিশালী হতাম!’

শুধু মাঠে জাদু ছড়ানোতেই নয়, ফুটবলের নানা অনিয়ম, বৈষম্য, এমনকি কৌশল নিয়েও গার্সিয়া ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। ফুটবলে কোচিংয়ের ধারণারও তিনি বেশ বিরোধী ছিলেন। বিশেষ করে কৌশল ও মার্কিং নিয়ে কোচদের উদ্ভাবনকে কখনোই মানতে পারেননি গার্সিয়া, ‘মার্কিং ফুটবল কোচদের আবিষ্কার। আমি সব ধরনের ট্যাকটিকসের শত্রু। তারা ফুটবলের সৌন্দর্যের বিরুদ্ধে। এতে কোনো সৌন্দর্য বা বৈচিত্র্য নেই। এখানে সবকিছু শৃঙ্খলা এবং আদেশের ওপর নির্ভরশীল। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সেরা খেলোয়াড়েরা হারিয়ে যায়। এসব কৌশল শুধু তাদের উপকার করে, যাদের কোনো সৃষ্টিশীলতা নেই। তারা মাঠে নামে প্রতিপক্ষকে খেলতে না দিতে। এমনকি তারা নিজেরাও খেলে না।’

আধুনিক ফুটবলে অভ্যস্ত রোমান্টিকদের কাছে এমন কথাকে হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু এই কথাগুলোতেই লুকিয়ে আছে ফুটবলের প্রতি গার্সিয়ার নিখাদ আবেগটুকু।

সে ছিল দুষ্টু, উপহাসকারী, পরিহাসপূর্ণ, রসিকতাকারী, প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি নিষ্ঠুর, দেবদূত এবং একজন শয়তানও। কেউ কেউ তাকে ভালোবাসে, আবার কেউ ঘৃণাও করে।
গার্সিয়াকে নিয়ে ডিয়েগো লুকেরো, উরুগুয়ের ক্রীড়া সাংবাদিক

উরুগুয়ের ক্রীড়া সাংবাদিক ডিয়েগো লুকেরো গার্সিয়াকে নিয়ে বলেছেন, ‘যদি ফুটবল কাউকে নিজের প্রতিনিধি হিসেবে ডাকে, তবে সেটি হবে বাঁ পায়ের কবি এনরিক গার্সিয়া। সে ছিল দুষ্টু, উপহাসকারী, পরিহাসপূর্ণ, রসিকতাকারী, প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি নিষ্ঠুর, দেবদূত এবং একজন শয়তানও। কেউ কেউ তাকে ভালোবাসে, আবার কেউ ঘৃণাও করে। খেলায় সে ছিল জাদুকর এবং আচরণে একজন বিশুদ্ধ প্রতিবাদী।’ আর প্রতিবাদী এই ফুটবলার বাঁ পায়ের জাদুতে মুগ্ধ করেছিলেন পৃথিবী বিখ্যাত বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারাকেও। গার্সিয়ার খেলায় সে সময় চে নাকি দারুণ মজেছিলেন।

আরও পড়ুন

সান্তা ফের এই ফুটবল জাদুকরের শেষটা অবশ্য ছিল বেশ বেদনাদায়ক। অর্থসম্পদ হারিয়ে কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েছিলেন। এ পরিস্থিতিতে কখনো প্রয়োজনে, আবার কখনো প্রহসনবশত বারগুলোয় গিয়ে বলতেন, ‘আমি এনরিক গার্সিয়া। সর্বকালের সেরা লেফট উইঙ্গার। আপনি আমাকে এক কাপ কফি খাওয়াতে পারেন?’

কবিরা তো এমনই। কবিতার প্রতি হন মায়াবী আর জীবনের প্রতি খেয়ালি, নাকি! বাঁ পায়ের কবিই–বা এর ব্যতিক্রম হবেন কেন!