সেই ফুটবলারই মায়ের গর্ব

নাসির উদ্দিন
নাসির উদ্দিন

গত ১১ জুন বিশ্বকাপ বাছাইয়ে কিরগিজস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে হাঁটুতে চোট পেয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন নাসির উদ্দিন চৌধুরী। সেই চোট ১৬ জুন পরের ম্যাচে তাজিকস্তানের সঙ্গে খেলতে দিল না তাঁকে। জেতা ম্যাচ ড্র করে বসল বাংলাদেশ। ওই ম্যাচে নাসিরের অভাবটা ভীষণভাবেই অনুভব করল বাংলাদেশ। শেখ জামাল ধানমন্ডিকে গত মৌসুমে লিগ জিতিয়েছেন, জিতিয়েছেন ফেডারেশন কাপ। দলকে কলকাতায় আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে তুলতে এবং ভুটানে কিংস কাপ জেতাতেও তাঁর বড় অবদান। এ মুহূর্তে চোট থেকে সেরে উঠে আবারও দলে ফেরার অপেক্ষায় বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের এই রক্ষণ সৈনিক।
ছেলেটির বংশে কেউ কখনো ফুটবল খেলেনি। কিন্তু তাঁকে পেয়ে বসল ফুটবলের নেশা। বই-খাতার চেয়ে বেশি টানত খেলার মাঠ। স্কুল ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই ফুটবল খেলতেন। খেলার জন্য মায়ের হাতে মার খাওয়ার কোনো হিসাব-নিকাশ নেই! খেলতে নিষেধ করায় রাগ করে বাড়িও ছেড়েছিলেন। কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য কোচিংয়ের টাকা খরচ করে তিনি খেলে বেড়িয়েছেন ফুটবল। লেখাপড়াবিমুখ সেই উড়নচণ্ডী ছেলেটিই এখন মা হুসনে আরা বেগমের গর্ব। ঘরে-বাইরে যতটা সম্মান পান, সেটা ফুটবলার নাসিরের মা বলেই।
চট্টগ্রাম থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরের গ্রাম সিলক। সেখানেই ফুটবলে হাতেখড়ি ‘আর্মির নাসিরে’র। এই পরিচয়ও অনেক ঘামে-শ্রমে কেনা। চট্টগ্রামের পাইওনিয়ার ফুটবলে ট্রায়াল দেওয়ার আগেও তাঁর বুট ছিল না। মায়ের দেওয়া ১২০ টাকায় এক জোড়া বুট কেনেন। ট্রায়ালের পর রাতে ফিরে দেখেন পায়ের আঙুলে ফোসকা পড়েছে। বড় ভাইয়ের পরামর্শে বুটে তেল লাগিয়ে রাখেন। বুট পেয়ে সব যন্ত্রণা উধাও হয়ে গিয়েছিল নাসিরের, ‘আনন্দে ফোসকার কষ্টটা ভুলে গিয়েছিলাম। বুট জোড়া কাউকে ধরতে দিতাম না। মাথার পাশে রেখে ঘুমাতাম।’
চট্টগ্রামে খেললেও নাসিরকে সব সময়ই ডাকত ঢাকা। শত অনুনয়-অনুরোধেও এক বড় ভাইয়ের মন গলিয়ে ঢাকায় যেতে পারেননি। ওই দিনই প্রতিজ্ঞা করেন ঢাকায় খেলবেন, ‘মনের মধ্যে জেদ পুষে রেখেছিলাম। নিজেকে বলেছিলাম, যেভাবেই হোক ঢাকায় খেলবই।’ নাসিরের সেই স্বপ্ন সত্যি হয়েছে, খেলছেন দেশের সেরা ক্লাব ঢাকার শেখ জামাল ধানমন্ডিতে।
চট্টগ্রামের লিগ বন্ধ হয়ে গেলে এক বন্ধু একদিন নাসিরকে সেনাবাহিনীর ফুটবলে ট্রায়াল দিতে উদ্বুদ্ধ করেন। কিন্তু বাবা-মায়ের অনুমতি পাননি। তাঁরা তো চেয়েছিলেন ছেলে লেখাপড়াই করবে, অন্য কিছু নয়। কিন্তু নাসিরের একটাই কথা, ‘ফুটবল খেলবই।’ শেষ পর্যন্ত বাড়ি থেকে পালিয়ে চট্টগ্রামে এসে ট্রায়াল দেন সেনাবাহিনীতে। তাঁর খেলা দেখে মুগ্ধ সেনা কর্মকর্তারা চাকরিতে নিয়ে নেন।
চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের ২৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরিজীবন শুরু হলো নাসিরের। সামরিক ট্রেনিং নিলেন। জলের মাছ ডাঙায় তুললে যেমন হয়, নাসিরের তখন সেই অবস্থা, ‘শুধু মনে হতো, কেন যে আর্মিতে এলাম!’ নিয়ম-শৃঙ্খলায় বাঁধা পড়লেন। কাঁদতেন নাসির। কষ্ট পেতেন বাবা-মাও। ওদিকে ফুটবলার নাসিরকে দলে টানতে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টের সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে রীতিমতো কাড়াকাড়িই পড়ে যায়।
প্রথম বিদেশ সফর ২০০০ সালে। শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নেয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। শ্রীলঙ্কায় যাওয়ার আগের রাতে নাসির তো চরম রোমাঞ্চিত, ‘আগের রাতে ঘুমই হয়নি। ঘুম ঘুম চোখে সকালে বিমানবন্দরে গেলাম। আগেই মাকে জানিয়েছিলাম শ্রীলঙ্কায় যাচ্ছি। বলেছিলাম, হাতখরচের জন্য ২০০ ডলার পাচ্ছি।’ এসবই নাসির সম্পর্কে বদলে দিতে থাকে পরিবারের ধারণা।
বিকেএসপিতে জাতীয় দলের সঙ্গে সেনাবাহিনীর একটি প্রীতি ম্যাচে নাসিরের খেলা জাতীয় দলের সাবেক কোচ জর্জ কোটান খুব পছন্দ করেন। তাঁকে জাতীয় দলে খেলার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সেনাবাহিনী ছাড়েনি। ২০০৬ সালে নাসির জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যান লাইবেরিয়ায়। সেখানে দেখা হয় আফ্রিকার অন্যতম সেরা এবং ফিফার সাবেক বর্ষসেরা ফুটবলার জর্জ উইয়াহর সঙ্গে। বাংলাদেশের এক সেনা কর্মকর্তা নাসিরকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ফুটবলার হিসেবেই।
সেখানে অস্ত্র নিয়ে পড়ে থাকতে হতো, কিন্তু খেলার জন্য মন কাঁদত নাসিরের। ফিটনেস ধরে রাখতে এক জোড়া বুট ও ফুটবল জোগাড় করে চুপি চুপি অনুশীলন করতেন। চেষ্টা করতেন ফিট থাকার। দেশে ফিরেই সিদ্ধান্ত নেন চাকরি ছেড়ে দেবেন। ২০০৮ সালে কর্তৃপক্ষের কাছে দরখাস্ত দিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর ছাড়পত্র না পাওয়ায় কোথাও খেলতে পারতেন না। তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন সাবেক গোলরক্ষক আমিনুল হক। মুক্তিযোদ্ধার তৎকালীন পরিচালক মেজর জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরীর সহায়তায় সেনাবাহিনীর ছাড়পত্র পান। পরের বছর খেলেন চট্টগ্রাম মোহামেডানে। সুপার কাপে নাসিরের পারফরম্যান্স দেখে কোচ মারুফুল হক নিয়ে আসেন ঢাকা মোহামেডানে।
সার্বিয়ান কোচ জোরান জর্জেভিচই তাঁকে জাতীয় দলে নেন প্রথম। খেলতেন স্ট্রাইকার হিসেবে, কিন্তু কোচের ইচ্ছায় হয়ে গেলেন ডিফেন্ডার। ২০১০ সালে শ্রীলঙ্কায় এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপ দিয়ে শুরু। পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা ধরে এখনো জাতীয় দলে টিকে আছেন দাপটের সঙ্গে। লাল-সবুজ জার্সি গায়ে আরও অনেক দিন খেলে যেতে চান নাসির।