‘হা...হা...। ইন্টারনেটেই তো দেখছেন আমরা কেমন আছি!’
কুশল বিনিময়ে খাঁটি বাংলায় জবাব দিলেন শ্রীলঙ্কার পাকির আলী। লঙ্কান সাবেক এই তারকা ফুটবলার সম্পর্কে জানা থাকলে তাঁর বাংলা ভাষায় কথা বলার পারদর্শিতা সম্পর্কে সন্দেহ থাকার কথা নয়।
দীর্ঘদিন বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে খেলার সুবাদে বাংলা ভাষাটা তাঁর ঠোঁটের আগায় থাকে। বাংলাদেশের কারও সঙ্গে কথা বললে মধুর বাংলা ভাষাতেই কথা বলতে তাঁর আনন্দ।
ফুটবলের সুবাদে ১৯৮১ সাল থেকে বাংলাদেশের নাড়ি-নক্ষত্রের সঙ্গে বন্ধন পাকির আলীর। যত সময় গড়িয়েছে, বাংলার সঙ্গে এই শ্রীলঙ্কানের ভালোবাসার সম্পর্ক গভীর থেকে হয়েছে গভীরতর।
আশির দশকে আবাহনী-মোহামেডান যখন হৃদয়ে দোলা দিত, সেই সময়ে ১৯৮১ থেকে ৯ বছর খেলেছেন ঢাকার ফুটবলে। পালন করেছেন ঐতিহ্যবাহী আবাহনী লিমিটেডের অধিনায়কের দায়িত্বও। বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল তাঁর দ্বিতীয় বাড়ি। ভাষাতেও এখনো পুরোদস্তুর বাঙালিয়ানার ছাপ।
খেলা ছাড়ার পর বাংলাদেশের শেখ জামাল ধানমন্ডি ও বাংলাদেশ পুলিশ ফুটবল ক্লাবের দায়িত্বও পালন করেছেন শ্রীলঙ্কান জাতীয় দলের সাবেক এই কোচ। পুলিশের কোচ হিসেবে গত বছরও বাংলাদেশে অনেক সময় কাটিয়েছেন। শ্রীলঙ্কার চলমান এই দুঃসময়ে কেমন আছেন তিনি? কলম্বো থেকে হোয়াটসঅ্যাপে শোনালেন তাঁর বর্তমান দৈনন্দিন জীবনের গল্প।
স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে রাজধানী কলম্বোর গোথাতুয়াতে বসবাস করেন পাকির আলী। মালদ্বীপ থেকে বড় ছেলে ফোন দিয়ে সারা দিনই খোঁজ খবর নিতে থাকেন। স্বামীর সঙ্গে সুইডেনে সংসার পাতা বড় মেয়েও।
স্বাভাবিকভাবে দেশটির বর্তমান টালমাটাল অবস্থার ছাপ পরিবারের প্রতে৵ক সদস্যের ওপরে এসে পড়েছে, প্রভাব ফেলেছে জীবনব্যবস্থায়ও। দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে বাড়ছে গণবিক্ষোভ। জীবনের বেশির ভাগ সময় ফুটবল নিয়ে কাটিয়ে দেওয়া পাকির আলী এখন সময় সুযোগ পেলেই দাঁড়িয়ে পড়ছেন সেই আন্দোলনে।
কাল কলম্বো থেকে পাকির আলী বলছিলেন, ‘ভাই এখানে বিরাট খারাপ অবস্থা। আমরা সবাই আন্দোলনে নেমেছি। চিকিৎসক, আইনজীবী...ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই এখন সাধারণ মানুষের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন। সবার লক্ষ্যই দেশটিকে এ অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনা। রাজনীতিতে নতুন একটি প্রজন্ম চাই আমরা।’
অর্থনীতিতে শ্রীলঙ্কার মরণ দশা। সরকারের আয় নেই। অতি মূল্যস্ফীতির দিকে দেশ। বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না পণ্য। স্বাভাবিকভাবে এর প্রভাব পাকির আলীর ধনাঢ্য পরিবারের রান্নাঘরেও পড়েছে।
দুদিন আগে বাজারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা শোনালেন সাবেক তারকা এই ডিফেন্ডার, ‘বাজারব্যবস্থার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দোকানিরা যে যেভাবে পারছেন বিক্রি করছেন। ১৮ রুপির ডিম কিনেছি ২৮ রুপি দিয়ে।’
অন্য জিনিসপত্রের দাম কেমন? উচ্চ স্বরেই জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলেন স্ত্রীকে। স্ত্রীর মুখ হয়ে সেটা শোনাচ্ছিলেন এই প্রতিবেদককে, ‘আমি দামাদামি করতে পারি না বলে স্ত্রীই বাজারে যায়। ৩০০ রুপি কেজির মুরগির দাম এখন ৯০০ রুপি। ৫০০ রুপি কেজির গরুর মাংসের দাম এখন ১ হাজার ৬০০ রুপি। আমার স্ত্রী গতকাল হলুদ কিনেছে ৫ হাজার রুপি কেজি দরে, যার দাম আগে ছিল ৩০০ রুপি।’
প্রসঙ্গক্রমে গত বছর ঢাকার একটি গল্পও শোনালেন পাকির আলী, ‘আমি গত বছর বাংলাদেশ থেকে ফেরার সময় ২ কেজি হলুদ কিনে এনেছিলাম। সেগুলো তো সব আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে দিয়েছি। কে জানত দেশের অবস্থান এখন এমন হবে।’
স্বাভাবিকভাবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে হতাশ পাকির আলী, ‘আমাদের কত সুন্দর একটা দেশ ছিল। সেটা কী হয়ে গেল। এরকম একটা দেশে কেন এমন হবে বুঝতে পারছি না। দৈনিক সর্বনিম্ন পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। শুনেছি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর জন্য যে তেল-ডিজেলের প্রয়োজন, তা পর্যাপ্ত নেই।’
দৈনন্দিন জীবনের যখন দৈন্যদশা, তখন ক্রীড়াঙ্গনের অবস্থা জিজ্ঞাসা করা বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়! তবুও তারকা ফুটবলার পাকির আলীর সঙ্গে যখন কথোপকথন, তাঁর কাছে চরম সংকটে পড়া দেশটির ফুটবলের অবস্থা জিজ্ঞাসা না করে পারা যায় না।
নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্ধকারে ৬৯ বছর বয়সী এই কোচ, ‘এখানে সব খেলা বন্ধ। জুনে লিগ শুরু হওয়ার কথা ছিল। কয়েকটি ক্লাবের সঙ্গে কথা চালাচালি হচ্ছিল। এখন তো মনে হয় লিগটা হবে না।’
চারপাশে ঘোর অন্ধকার। তবে অন্ধকার গলির শেষে আশা খুঁজে নিচ্ছেন পাকির আলী, ‘আমাদের দেশে ৩০ বছর গৃহযুদ্ধ হয়েছে। তবুও আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। এ অবস্থা থেকেও শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়াবে আমার বিশ্বাস।’
বিশ্বাসই তো এখন তাঁদের একমাত্র জ্বালানি, যেটি কিনতে লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে চড়া দাম দিতে হয় না। এই বিশ্বাসটাই বাস্তব হয়ে দেখা দিক পাকির আলীদের জীবনে।