বাংলাদেশের ফুটবলে একবারই 'দর্শকবিহীন' ম্যাচ
>করোনা-আতঙ্কে ইতালির সিরি ‘আ’তে দর্শকবিহীন অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়েছে খেলা। স্প্যানিশ লিগ আগামী দুই সপ্তাহ প্রতিটি ম্যাচই আয়োজন করবে দর্শকবিহীন অবস্থায়। অতীতে বাংলাদেশেও একটি দর্শকবিহীন ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যদিও সেটির প্রেক্ষাপট ছিল পুরোপুরি ভিন্ন
সারা দুনিয়াতে থাবা বসিয়েছে করোনাভাইরাস। আতঙ্কিত সারা বিশ্বের মানুষ। অসম্ভব ছোঁয়াচে এই রোগের বিস্তার রোধে বিভিন্ন প্রতিরোধক ব্যবস্থা হাতে নিয়েছে বিশ্বের প্রতিটি দেশই। জনসাধারণকে বলা হচ্ছে জনবহুল জায়গা এড়িয়ে চলতে। এখন খেলার মাঠের চেয়ে জনবহুল জায়গা আর কী হতে পারে! অনন্যোপায় হয়েই অনেক দেশেই স্থগিত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন খেলা। সেটি করতে না পারলে দর্শকবিহীন অবস্থায় খেলা আয়োজনের পথেও বেছে নেওয়া হচ্ছে। লিওনেল মেসির স্প্যানিশ লিগ কর্তৃপক্ষও ঘোষণা দিয়েছে করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে আগামী অন্তত দুই সপ্তাহ দর্শকবিহীন অবস্থায় অনুষ্ঠিত হবে তাদের সব ম্যাচ। স্থগিত হয়ে যাওয়া ইতালীয় সিরি ‘আ’র ম্যাচ কয়েক দিন দর্শকবিহীন অবস্থায় হয়েছিল।
দর্শকবিহীন ম্যাচ ফুটবলে নতুন কিছু নয়। অনেক সময়ই বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে দর্শকবিহীন অবস্থায় খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৭ সালে কাতালান আন্দোলনের ঝাঁজ স্প্যানিশ লিগের ওপর এসে পড়ায় বার্সেলোনার একটি ম্যাচ দর্শকবিহীন অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গাতেও দর্শকবিহীন ম্যাচের সাক্ষী হয়েছে মানুষ। বাংলাদেশেও ১৯৮৭ সালে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী ও মোহামেডানের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল দর্শকবিহীন অবস্থায়। যদিও সেটির প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বাংলাদেশের ফুটবল বা যেকোনো খেলার ইতিহাসেই সেটি এখনো পর্যন্ত একমাত্র দর্শকবিহীন আয়োজন। এ প্রজন্ম ইতালি বা স্পেনের ফুটবল লিগের ‘ক্লোজড ডোর’ ম্যাচের কথা জানলেও আবাহনী-মোহামেডানের সেই ‘দর্শকবিহীন’ ম্যাচটির কথা হয়তো সেভাবে জানে না। আজ থেকে ৩৩ বছর আগে দেশের ফুটবলের রমরমা অবস্থার মধ্যে দর্শকবিহীন খেলা ছিল সবার কাছেই অচিন্তনীয়। সে সময় ঢাকা স্টেডিয়ামে (আজকের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) প্রিয় দলের খেলা দেখতে ভিড় হতো হাজার হাজার দর্শকের। প্রিয় দলের জয়-পরাজয় সমর্থকদের মধ্যে অন্যরকম উন্মাদনা তৈরি করত, সে সময় আবাহনী-মোহামেডান দর্শকশূন্য খাঁ খাঁ গ্যালারির সামনে মাঠে নামছে—সেটি সবার জন্য ছিল অন্যরকম এক অভিজ্ঞতাই।
দর্শক হাঙ্গামা আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে খুবই সাধারণ ঘটনা ছিল। ১৯৮৭ সালের ২৬ অক্টোবর এ দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যকার শিরোপা-নির্ধারণী লড়াইয়ে হাঙ্গামা ঠেকাতেই ‘দর্শকবিহীন’ আয়োজনের কথা ভাবা হয়েছিল। বনানীর সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত আর্মি স্টেডিয়ামে (সে সময় এরশাদ আর্মি স্টেডিয়াম; তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধানের নামে ছিল স্টেডিয়ামটি) দেশের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী-মোহামেডান মুখোমুখি হয়েছিল ‘ভুতুড়ে’ এক লড়াইয়ে।
১৯৮৭ সালের ফুটবল লিগ ছিল যেমন জমাটি তেমন ঘটনাবহুল। লিগের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মানও ছিল অনেক উঁচু। সে বছর দুই প্রধানেই খেলতে এসেছিলেন অত্যন্ত উঁচুমানের বিদেশি ফুটবলাররা। আবাহনীতে এসেছিলেন ইরাকের সামির শাকির—যিনি ১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপে ইরাকের হয়ে খেলেছিলেন। এসেছিলেন বিশ্বকাপ স্কোয়াডে থাকা স্ট্রাইকার করিম মোহাম্মদ আলভী। মোহামেডানও কম যায় না। কোচ কাম খেলোয়াড় হয়ে এসেছিলেন ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে ইরানের হয়ে খেলা এশিয়ার অন্যতম সেরা গোলরক্ষক নাসের হেজাজি। এ ছাড়া ইরানের রেজা নালজেগার, বোরহানজাদেহ আর মোর্তজাও খেলেছিলেন মোহামেডানের সাদা-কালে জার্সিতে। মোহামেডানে আরও ছিলেন নাইজেরিয়ার এমেকা ইজিউগো।
১৯৮৭ সালে লিগের নির্ধারিত শেষ ম্যাচে মোহামেডান আবাহনীর মুখোমুখি হয়েছিল ২ পয়েন্ট পিছিয়ে থেকে। আবাহনী শেষ ম্যাচে জিতলে বা ড্র করলেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে, কিন্তু মোহামেডান জিতলে আয়োজিত হবে একটি প্লে অফ ম্যাচ। এমন সমীকরণই ছিল। ৮৭’র ৬ সেপ্টেম্বর কাগজে-কলমে লিগের শেষ ম্যাচে আবাহনীকে ৩-২ গোলে হারিয়ে পয়েন্ট সমান করে ফেলে মোহামেডান। ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় সেই ‘প্লে অফ’ ম্যাচটি। সে ম্যাচে নিয়ম করা হয়েছিল নির্ধারিত সময়ের খেলা অমীমাংসিত থাকলে অতিরিক্ত সময় কিংবা টাইব্রেকারে নিষ্পত্তি হবে ম্যাচের ভাগ্য। কিন্তু টান টান উত্তেজনার সেই ম্যাচটি ব্যাপক হাঙ্গামার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। মাঠে গোলযোগ হয় ব্যাপক। দুই দলের খেলোয়াড়েরা নিজেদের মধ্যে বারবার জড়িয়ে পড়তে থাকেন হাতাহাতিতে। সেই ম্যাচটি এমন বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে ৯০ মিনিট পার করে দেয় গোলশূন্য অবস্থায়। অতিরিক্ত সময়ের খেলা শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে ঘটে যায় নজিরবিহীন এক ঘটনা। যে খেলোয়াড়েরা কিছুক্ষণ আগেই নিজেদের মধ্যে বারবার মারামারিতে জড়িয়ে পড়ছিলেন। তাঁরাই এক হয়ে নিজেদের বিভেদ, শত্রুতাকে মাটি চাপা দিয়ে নিজেদের ‘যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন’ ঘোষণা করে দেন। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত সে ম্যাচটি সারা দেশের মানুষই তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে দেখছিলেন। খেলোয়াড়দের হঠাৎ এ ঘোষণায় ফুটবলপ্রেমীরা প্রথমে বড় ধাক্কাই খেয়েছিলেন। কিন্তু এরপর আনন্দের সঙ্গেই ব্যাপারটি গ্রহণ করেছিলেন দুই চিরশত্রুর সম্মিলন।
বাফুফে অবশ্য সিদ্ধান্তটি আনন্দের সঙ্গে নেয়নি। খেলোয়াড়দের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে তারা। বিভিন্ন মেয়াদে তাদের নিষিদ্ধ করা হয়। মোহামেডান ও আবাহনীর দুই অধিনায়ক রণজিৎ সাহা ও শেখ মোহাম্মদ আসলামকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে বাফুফে। আরও কয়েকজন খেলোয়াড়ের (আবাহনীর মোহাম্মদ মহসিন, মোস্তফা কামাল আর মোহামেডানের আবুল হোসেন ও ইলিয়াস হোসেন) ক্ষেত্রে এই মেয়াদ ছিল তিন মাস করে।
খেলোয়াড়দের শাস্তি দিয়ে বাফুফে প্লে অফটি নতুন করে আয়োজন করে। আর সে ম্যাচটিই হয়েছিল দর্শকবিহীন অবস্থায়। আবাহনী প্রথমে সেটি খেলতে চায়নি। মাঝখানে এক মাসেরও বেশি সময় বিরতি পড়ে গিয়েছিল। ইরাকি ফুটবলাররা চলে গিয়েছিলেন লিগ আর হবে না মনে করে। গুরুত্বপূর্ণ তিন খেলোয়াড়, মহসিন, মোস্তফা কামাল ও আসলাম নিষিদ্ধ ছিলেন। মোহামেডান অবশ্য আপত্তি করেনি। তাদের নিষেধাজ্ঞার সমস্যা থাকলেও আবাহনীর মতো সমস্যা অতটা প্রকট ছিল না। বিদেশিদের মধ্যে ছিলেন নাইজেরিয়ার এমেকা। শেষ পর্যন্ত আবাহনী ম্যাচটি খেলে। মোহামেডানের তুলনায় আবাহনী যে সে ম্যাচে দুর্বল ছিল, সেটি না বললেও চলছে।
আমি স্টেডিয়ামে ফাঁকা গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত সে ম্যাচে মোহামেডান জেতে ২-০ গোলে। লিগ শিরোপাও এককভাবে নিশ্চিত হয় তাদের। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত সে ম্যাচটি শুরু হয়েছিল বিকেল তিনটায়। সে ম্যাচটি আজও অন্যরকম এক অনুভূতি হয়ে আসে একটু আগের প্রজন্মের কাছে। হালে প্রায় ‘দর্শকবিহীন’ অবস্থাতেই ফুটবল চলে। কিন্তু ৩৩ বছর আগে ফুটবল মাঠে দর্শক নেই—সেটি যে ছিল কল্পনার অতীত।