ফুটবল খেললেই হয় না, নিয়ম-কানুনও জানতে হয়...

গোল করে সমতায় ফেরার আনন্দে জার্সি খোলার চেষ্টা করে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন বাংলাদেশের ইয়াসিন খান। এতেই ৯ জনের দলে পরিণত হয় বাংলাদেশ। ছবি: বাফুফে
গোল করে সমতায় ফেরার আনন্দে জার্সি খোলার চেষ্টা করে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন বাংলাদেশের ইয়াসিন খান। এতেই ৯ জনের দলে পরিণত হয় বাংলাদেশ। ছবি: বাফুফে
>খুব কাছে গিয়েও টানা দুবার অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ ফুটবলের শিরোপা জেতা হলো না বাংলাদেশের। অহেতুক লাল কার্ড দেখে ফুটবলারদের মাঠ ছাড়ার খেসারতই দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এর পেছনে মূল কারণ ফুটবলারদের জানা নেই ফুটবলের আইন-কানুন।

‘তোমাদের ছোট ভাইয়েরা কি ফুটবলের আইন জানে না!’

২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর থিম্পুর এক কনকনে শীতের সন্ধ্যায় দেখেছিলাম জাতীয় দলের তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ান কোচ অ্যান্ড্রু ওর্ডের রুদ্র মূর্তি। চাংলিমিথাং স্টেডিয়ামে ছাউনি টানানো অস্থায়ী প্রেস বক্সের চেয়ার লাথি মেরে লেখার অযোগ্য গালি দিয়ে শুরুর কথাটি বলেছিলেন। অনূর্ধ্ব-১৮ সাফের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নেপালের বিপক্ষে অহেতুক কনুই মেরে বিশ্বনাথ ঘোষ লাল কার্ড দেখায় তাঁর সেই রুদ্র মূর্তি। ভুল বা অন্যায় যাই হোক না কেন, করেছেন তাঁর-ই খেলোয়াড়। কিন্তু আমার মতো সাংবাদিকের দিকে তেড়ে আসা কেন?

‘তোমাদের ছোট ভাইয়েরা’ কথাটির জোরের সঙ্গেই বলেছিলেন। ভুলে গিয়েছিলেন একজন সাংবাদিকের পেশার ধর্ম। সাংবাদিকদের সঙ্গে ফুটবলারদের একটা নিবিড় সম্পর্ক থাকে, সেটি তিনি জানতেন। সে কারণেই বিশ্বনাথের ভুলের পর এই সাংবাদিককে কাঠগড়ায় তোলা। কিন্তু বিশ্বনাথের ভুল যে দুই বছর পর কাঠমান্ডুতে করলেন আরেক তরুণ ফুটবলার। এই ৩০ সেপ্টেম্বর অনূর্ধ্ব-১৮ সাফের ফাইনালে বিশ্বনাথের জায়গায় এবার অহেতুক লাল কার্ড দেখে খলনায়ক সেন্টারব্যাক ইয়াসিন আরাফাত। অথচ গোল করে সমতায় ফেরানো ইয়াসিনই হতে পারতেন নায়ক।


রোববার অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ ফুটবলের ফাইনালে ভারতের কাছে ২-১ গোলে হেরে রানার্সআপ হয়েছে বাংলাদেশ। অথচ ইয়াসিনের ভুলের খেসারত না দিতে হলে ম্যাচের ফলটা অন্য রকম হলেও হতে পারত। ১-০ গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় ৩৯ মিনিটে অধিনায়ক ইয়াসিনের গোলে সমতায় ফেরে বাংলাদেশ। কিন্তু গোলের আনন্দ জার্সি খুলে উদ্‌যাপন করার চেষ্টায় মুখ ঢেকে ফেলেন তিনি। আইনানুযায়ী দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখানোর জন্য ওটাই ছিল যথেষ্ট। বাকিটা সময় বাংলাদেশকে খেলতে হয় একজনকে কম নিয়ে।

এর আগে ২১ মিনিটে একটা ফাউলকে কেন্দ্র করে দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে হাতাহাতিতে লালকার্ড দেখানো হয় দুই দলের দুজনকে। অর্থাৎ প্রথমার্ধের শেষের দিক থেকে ভারতের ১০ জনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ৯ জন খেলে আর কুলিয়ে উঠতে পারেননি। ফলে অনেক কাছে গিয়েও আরও একটি যুব সাফের শিরোপা হাতছাড়া হলো কেবলই অখেলোয়াড়ি মনভাবের কারণে, সেই সঙ্গে ফুটবলের আইনের ব্যাপারে অজ্ঞতার কারণে।

এর পর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, প্রিমিয়ার লিগে খেলা একজন খেলোয়াড়ের কি জানা নেই, জার্সি খুললে বা গোল করার আনন্দে খোলার চেষ্টা করলেই হলুদ কার্ড? বা প্রশ্নটা ঘুরিয়ে ওর্ডের ভাষায় আমাদের ছোট ভাইয়েরা ফুটবলের আইন কি জানে না? তাঁরা জানেন কিনা, সে প্রশ্নের উত্তর পরে খুঁজছি। এর আগে মনে করিয়ে দেওয়া যাক থিম্পুতে বিশ্বনাথ কি করেছিলেন।

হাতাহাতি কলে লার্ল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন বাংলাদেশের এক খেলোয়াড়। ছবি: বাফুফে
হাতাহাতি কলে লার্ল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন বাংলাদেশের এক খেলোয়াড়। ছবি: বাফুফে

আগেই বলে নেওয়া যাক দুই বছর আগে বিশ্বনাথের ওই লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়ার খেসারতেই যুব সাফের শিরোপা জেতা হয়নি বাংলাদেশের। সেই দিনের সন্ধ্যাটা আজও চোখের সামনে স্পষ্ট। হাই প্রেসিং করে নেপালি রক্ষণভাগ ও মাঝমাঠকে নিজেদের অ্যাটাকিং থার্ডের মধ্যেই আটকে রেখেছিল বাংলাদেশের যুবারা। মাঝমাঠে বাংলাদেশের ডাবল পিভট দুই মিডফিল্ডার মোহাম্মদ আল আমিন ও সোহানুর রহমানের চেজিংয়ে মাথা তুলতেই পারছিল না নেপাল। কিন্তু ১-১ গোলে সমতায় থাকা ম্যাচে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই অহেতুক নেপালি খেলোয়াড়কে কনুই মারলে সরাসরি লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়ের বিশ্বনাথ। শেষ পর্যন্ত ২-১ গোলের হার নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় বাংলাদেশকে। পরের ম্যাচে ভুটানকে হারালেও গোল ব্যবধানে পিছিয়ে থাকায় সমান পয়েন্ট নিয়ে নেপাল চ্যাম্পিয়ন আর বাংলাদেশ রানার্সআপ।

এবার আসা যাক দেশের তরুণ ফুটবলারদের অখেলোয়াড়ি আচরণের ব্যাপারে। ইয়াসিন আরাফাতদের জানা থাকে না গোল করে জার্সি দিয়ে মুখ ঢাকলেই হলুদ কার্ড। বিষয়টি নিজেই শিকার করেছেন ইয়াসিন, ‘কার্ড দেখতে হবে, আমি জানতামই না। গোলের পর স্বাভাবিকভাবে জার্সি দিয়ে মুখ ঢাকি। কিন্তু এর জন্য হলুদ কার্ড দেখতে হবে, আমার মোটেই জানা ছিল না। জানলে জার্সি দিয়ে মুখ ঢাকতাম না।’

এর মূল কারণ বাংলাদেশের ফুটবলে ফুটবল-শিক্ষা খুবই দুর্বল। অন্যান্য দেশে খেলোয়াড়েরা ৮-১০ বছরেই ঢুকে পড়ে একাডেমিতে। সেখানে ফুটবলীয় দক্ষতার সঙ্গে শেখানো হয় ফুটবলের আইন কানুন, মাঠের নানা আদব কেতা। কিন্তু আমাদের দেশে সে সুযোগ নেই। খেলোয়াড়েরা নামকাওয়াস্তে খেলা শুরু করে ১৪-১৫ বছর বয়সে। অনেক কোচের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে জাতীয় দলের খেলোয়াড়দেরও অনেক মৌলিক বিষয় শেখাতে হয়।

জাতীয় দলের সাবেক সহকারী কোচ মাহবুব হোসেন রক্সি সেটিই জানালেন, ‘আমাদের খেলোয়াড়দের ফুটবল এডুকেশনের অভাব। কারণ ফুটবলে একাডেমিক শিক্ষা নেওয়ার তেমন ব্যবস্থা নেই। তাই ফুটবলের আইন কানুন সম্পর্কে অবগত নন। অনেক সময় জাতীয় দলের খেলোয়াড়দেরও বল দেওয়া-নেওয়া শেখাতে হয়। এখানে খেলোয়াড়দের দোষ দেওয়া যাবে না। কারণ ছোট বেলায় সঠিক উপায়ে তাদের শেখার সুযোগ ছিল না। আর বড় হওয়ার পর শেখানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে।’

ফুটবলের ১৭টি আইনের কথা জাতীয় দলের অনেক ফুটবলার জানেন না, তা ধরেই নেওয়া যায়। কী কী কারণে হলুদ কার্ড বা সরাসরি লাল কার্ড দেখতে হতে পারে তাও জানা নেই খেলোয়াড়দের। ম্যাচ পরিচালনা করতে গিয়ে মাঠে এই ধরনের সমস্যায় পড়তেন বলে জানান বর্তমানে ফিফা রেফারিদের টেকনিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর আজাদ রহমান, ‘মাঠে খেলা চালাতে গিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ আমাদের খেলোয়াড়দের আইন-কানুন জানা নেই। কোন ফাউলের জন্য কার্ড দেখালাম এই নিয়ে খেলোয়াড়সহ কর্তারাও তর্ক করে মাঠে। আইন জানা থাকলে এই সমস্যাগুলো হয় না। অনেক সময় তো মাঠে খেলোয়াড়দের থ্রোইনের আইন-কানুনও শেখাতে হয়েছে। খেলোয়াড়দের ফুটবল এডুকেশন খুব জরুরি।’