তানভীরের অলৌকিক ফেরা

তানভীর চৌধুরী
তানভীর চৌধুরী

খেলোয়াড়ি জীবনে অনেক ডিফেন্ডারকেই ঘোল খাইয়ে গোল করেছেন। রক্ষণের ফাঁকটা তাঁর ভালোই জানা। এ কারণেই বুঝি হারিয়ে দিতে পারলেন স্বয়ং মৃত্যুদূতকে!
মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন, তানভীর চৌধুরী ​বেঁচে আছেন সৃষ্টিকর্তার অসীম অনুগ্রহে। নইলে যেমন দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন, পৃথিবীর আলো-বাতাস আর দেখার কথা নয়। কিন্তু তানভীর চোখ মেলে তাকান দুর্ঘটনার এক মাস পর। প্রায় ১৩ মাস পেরিয়ে এখন টুকটাক কথাও বলতে পারেন। তবে দাঁড়ানোর ক্ষমতা এখনো আসলে ফিরে পাননি। তাই ২৪ ঘণ্টাই কাটে শুয়ে বা হুইল চেয়ারে বসে।
গত বছর ১৯ মে। নাটোর থেকে বাসে ঢাকায় আসার পথে দুর্ঘটনায় পাল্টে গেল তানভীরের জীবনের গতিপথ। বাসে চালকের পাশের আসনে ছিলেন, ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে তানভীরের পাশের জন ঘটনাস্থলে ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। তানভীরের বুকে কাচ ঢুকে যায়। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে কোমায় চলে যান ১৯৯৯ সালে আয়োজিত প্রথম জাতীয় লিগের সেরা ফুটবলার।
ঢাকার প্রায় সব শীর্ষ ক্লাবে খেলা এই উইঙ্গার পেয়েছেন জাতীয় দলে জার্সি গায়ে তোলার স্বাদ। এবার মর্মান্তিক বাস দুর্ঘটনায় মনে করা হচ্ছিল, তাঁর জীবনটা বুঝি শেষ। তবে ভাগ্য ভালো, হেলিকপ্টারে দ্রুত ঢাকায় আনায় অন্তত বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। ঢাকা মেডিকেলে আনলে ডাক্তাররা বললেন, মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে। তারপর স্কয়ার হাসপাতালের বিছানায় অর্ধমৃত নিথর শরীরে প্রাণের স্পন্দন ফেরাতে ডাক্তারদের প্রাণান্তকর চেষ্টা। কোমায় চলে যাওয়ার রোগীর ভবিষ্যৎ​ তাঁরা আর দেখছিলেন না। কিন্তু চেষ্টা আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা বৃথা যায়নি। ১৩ দিন পর খোলা হয়েছিল লাইফ সাপোর্ট।
শেষ পর্যন্ত অলৌকিকভাবে ফিরে এলেন তানভীর। ৩ মাস ৬ দিন স্কয়ারে কাটিয়ে গত বছর ২৪ আগস্ট তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো সাভার সিআরপিতে(পক্ষাঘাত পুনর্বাসন কেন্দ্র), যেখানে থেরাপি দেওয়া হয়। কিছুদিন ওখানে কাটিয়ে নাটোরের বাড়িতেই এখন চলছে থেরাপি এবং আনুষঙ্গিক চিকিৎসা।
এক বছরেরও বেশি সময়ে তানভীরের জীবন-বাঁচানোর লড়াইয়ে সার্বক্ষণিক সঙ্গী স্ত্রী শাহ দিল-ই আফরোজ খুশি এই ভেবে, ঝড়ঝাপটা যা-ই আসুক, মানুষটা তো বেঁচে আছেন। নাটোরের বাড়ি থেকে তাই টেলিফোনে আপ্লুত শোনায় তাঁর কণ্ঠ, ‘এই একটা বছর চরম দুঃসময় গেছে আমাদের জীবনে। তবু আমরা আনন্দিত তানভীর বেঁচে আছে।’
বাবাকে কাছে পাচ্ছে ছয় বছরের বড় মেয়ে। দুর্ঘটনার সময় ছয় মাসের ছোট মেয়ের বয়স এখন দেড় বছর। সে কিছু না বুঝলেও অন্তত বাবার ছোঁয়া তো পাচ্ছে।
স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে তানভীর আরও অন্তত দুই তিন বছর লাগতে পারে। মূল চিকিৎসা এখন থেরাপি, কথা বলা, হাঁটাচলা করা...। যার মাধ্যমে মস্তিষ্কের কাজকর্ম স্বাভাবিক হবে। যেটির এখন খুব দরকার। কারণ, সামনে এলে এখন পরিচিত কাউকে কখনো চিনতে পারেন, কখনো পারেন না। স্মৃতিশক্তি সেভাবে ফিরে পাননি।

তবে তাঁকে ‘ফিরিয়ে আনতে’ অর্থনৈতিকভাবে পরিবারটির নিঃস্ব হওয়ার জোগাড়। পনেরো-বিশ লাখ টাকার মতো টাকা খরচ হয়ে গেছে। স্কয়ার হাসপাতাল ছাড়া সময় দশ লাখ টাকা বাকি ছিল। ওই টাকা দিতে হবে না জানে তানভীরের পরিবার। সতীর্থ ফুটবলাররা এ নিয়ে ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়ের সঙ্গে কথা বলে সব মিটিয়ে ফেরার কথা বলেছিলেন। উপমন্ত্রী নাকি আশ্বাসও দিয়েছিলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বকেয়া মিটিয়ে ফেলবেন। তবে এক বছর হতে চললেও ওই টাকার সুরাহা হয়নি।
তাই হাসপাতাল থেকে ফোন পান শাহ দিল-ই আফরোজ, টাকা পরিশোধের ব্যাপারে আগেই বন্ড সই দিয়েছিলেন। এ কারণে উকিল নোটিশ পাঠানোর কথাও নাকি তাঁকে বলছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তানভীরের পরিবার তাই অনেকটা চিন্তিত। ফুটবল ফেডারেশন দুই লাখ টাকা দিয়েছিল। এর পর আর খোঁজ রাখেনি। টুকটাক আরও কিছু সহায়তা পেলেও যতটা আশ্বাস তাৎক্ষণিক মিলেছিল সেই অনুযায়ী কিছুই হয়নি।
তানভীরের দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসার জন্য আরও আর্থিক সহায়তার দরকার। তাই প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি চাইছেন শাহ দিল-ই আফরোজ। সবাই মিলে চাইলে অলৌকিকভাবে ফিরে আসা তানভীরের পুরোপুরি সুস্থ হওয়া সম্ভব। মৃত্যুদুয়ার থেকে যে ফিরে এসেছে, তাঁর কি হার মানা যায়!