ঢাকার ফুটবলকে রঙে রঙিন করা ১০ নম্বরেরা

>ফুটবলে ১০ নম্বর জার্সির কথা উঠলেই ভেসে ওঠে কিছু কিংবদন্তির মুখ। বিশ্ব ফুটবলে পেলে-ম্যারাডোনা থেকে শুরু করে রোনালদিনহো-জিদান হয়ে বর্তমানের লিওনেল মেসি-নেইমারের গায়ে শোভা পায় ১০ নম্বর। বাংলাদেশের জাতীয় দলের ইতিহাসে যাদের গায়ে উঠেছে মর্যাদার এই ১০ নম্বর জার্সি, তাদের কয়েকজনকে নিয়েই নতুন এই ধারাবাহিক 'বাংলাদেশের ১০ নম্বর'-
বাদল রায়। ছবি: সংগৃহীত
বাদল রায়। ছবি: সংগৃহীত

কী রমরমা একটা সময়ই না গিয়েছে দেশের ফুটবলে! উপচে পড়া গ্যালারী, ফুটবলারদের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশের ফুটবল দেশকে বড় কোনো শিরোপা এনে দেয়নি ঠিকই, তবে এ দেশের তারকা ফুটবলারেরা তখন ফুটবলের রংয়ে রঙিন করে রেখেছিল শহর থেকে জনপদ।

ঢাকা লিগে তাদের ফুটবলীয় নৈপুণ্য এখনকার বিশ্ব তারকাদের চেয়ে কম আনন্দ দেয়নি এই দেশের মানুষদের। কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের কাছে তখন তাঁরাই ছিলেন তারকা। যাদের শুধু দূর থেকেই দেখা যায়। একবার ছুঁয়ে দেখা মানে স্বপ্ন পূরণ। সারা জীবন বলার মতো এক গল্প। তবে এসব এখন শুনলে মনে হতেই পারে- এ বুঝি ঠাকুরমার ঝুলির গল্প!

কাজী সালাউদ্দিন। ছবি: সংগৃহীত
কাজী সালাউদ্দিন। ছবি: সংগৃহীত

আবাহনীর '১০' নম্বর কে, '১০' নম্বর জার্সি পরে খেলা মোহামেডানের খেলোয়াড়ের নাম কি? কমলা জার্সিধারী তারুণ্যের প্রতীক ব্রাদার্সের ১০ নম্বর ফুটবলারই বা কে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল না, ৭০ থেকে ৯০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া ছিল দুস্কর। জনপ্রিয় ক্লাবগুলোর ১০ নম্বর জার্সি গায়ে চাপিয়ে আলাদা হয়ে আছেন কাজী সালাউদ্দিন, এনায়েতুর রহমান, বাদল রায়, মোহাম্মদ মহসীন, রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির, আলফাজ আহমেদরা।

সময়ের পরিক্রমায় ফুটবলের জনপ্রিয়তায় ধ্বস নেমেছে। হারিয়ে গিয়েছে ক্লাব সংস্কৃতি। খেলোয়াড়দের নামও এখন জানা থাকে না সমর্থকদের, জার্সি নম্বর জানা তো দূরের কথা।

বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে ১০ নম্বর জার্সি পরে খেলে জনপ্রিয়তা পাওয়া ফুটবলারদের নাম উঠলে সবার আগে রাখতে হবে সালাউদ্দিনকে। ১৯৭২ থেকে শুরু করে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত টানা আবাহনীতে খেলেন সালাউদ্দিন। আবাহনীর '১০ নম্বর' জার্সিটি ছিল তাঁর অধিকারেই। সেই স্মৃতিতে ডুব দিয়ে সালাউদ্দিন বলছিলেন, '১০ নাম্বার জার্সি পরে আমি একটানা খেলেছি আবাহনীতে। সব সময় প্রথম একাদশে খেলতাম। তাই কেউ আমার ১০ নম্বর নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেনি।'

সালাউদ্দিনের অবসরের পর প্রায় দশ বছর তুলে রাখা হয় আবাহনীর ১০ নম্বর জার্সি। ১৯৯৪ সালে ইরাকি স্ট্রাইকার নজর আলির গায়ে তুলে দিয়ে নতুন করে মাঠে নামানো হয় সেটি।

রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির। ছবি: সংগৃহীত
রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির। ছবি: সংগৃহীত

ওই সময়ে দেশের সেরা ফুটবলার হিসেবে সালাউদ্দিনের সঙ্গে এনায়েতুর রহমানের প্রতিদ্ব›িদ্বতা ছিল। দুজন একসঙ্গে জাতীয় দল ও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে খেললেও তাঁদের মধ্যে যেন অদৃশ্য একটা দেয়াল ছিল। তবে দুই তারকাকেই দেশের ফুটবল ইতিহাস এক ফ্রেমে রেখেছে '১০' নম্বর জার্সির বন্ধনে।

এনায়েতের ফুটবলীয় দক্ষতাকে আজও কুর্নিশ করেন ফুটবল প্রেমীরা। কোনো ক্লাবের হয়ে দীর্ঘদিন না খেললেও বিজেএমসিতে (৭৫ থেকে ৭৭) ও মোহামেডানে (৭৮ থেকে ৮০) ১০ নাম্বার জার্সিতে মাঠ মাতিয়েছেন তিনি। শোনা যায়, ওয়াপদা, ভিক্টোরিয়ার হয়ে খেলার সময়ও তাঁর গায়ে ছিল এই নম্বর। অবশ্য সেই স্মৃতি খুব বেশি স্মরণ করতে পারলেন না কানাডা প্রবাসী এনায়েত, '১০ নম্বর জার্সি নিয়ে তখনও খেলে থাকতে পারি। তবে খুব বেশি মনে নেই।' স্বাধীনতার পর থেকে এনায়েতের আগে মোহমেডানের ১০ নাম্বার নিয়ে খেলতেন মেজর (অব) হাফিজউদ্দিন ।


আশির দশকের মোহামেডানে ১০ নম্বর ছিল বাদল রায়ের। ১৯৭৭ সালে ৭ নম্বর জার্সিতে মোহামেডানে শুরু। ১৯৮১ সালে পান ১০ নম্বর। সেটি গায়ে ছিল ১৯৮৯ সালে অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত। সেই স্মৃতি এখনো তরতাজা বাফুফের বর্তমান সহসভাপতির মনে, 'এনায়েত ভাইয়ের অবসরের পর মোহামেডানের ১০ নম্বর জার্সিটি আমার হাতে তুলে দেওয়া হলো। ১০ নম্বর নিয়ে খেলার আলাদা একটা গর্ব আছে। মানুষ তো নম্বর দেখলেই বুঝত আমি বাদল।'


মোহামেডানে বাদলের উত্তরসূরি ছিলেন সাব্বির, আলফাজ, নকীবরা। তাঁদের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলা যাক মোহাম্মদ মহসীনের কথা। ব্রাদার্সের ১০ নম্বর পরতেন তিনি। ১৯৭৩ সালে কিশোর বয়সে তৃতীয় বিভাগ দিয়ে ব্রাদার্সের কমলা জার্সিতে শুরু, সেই জার্সিতেই ১৯৮৫ সালে শেষ।

অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত ব্রাদার্সের ১০ নম্বর জার্সিটাকে যেন নিজের সম্পত্তিই বানিয়ে ফেলেছিলেন মহসীন! তাঁর জার্সিও দিকে কারও চোখ দেওয়ারও সাহস হতো না তখন। মহসীন বলছিলেন, 'তৃতীয় বিভাগ থেকে শুরু করে সবসময় এত বেশি গোল করতাম যে, মৌসুমের শুরতেই জার্সিটি আমাকে দিয়ে দেওয়া হতো। অবসরের আগ পর্যন্ত ১০ নম্বর নিয়েই খেলেছি।'

এনায়েতুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
এনায়েতুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

ব্রাদার্সের মহসীন ও আবাহনীর সালাউদ্দিনের অধ্যায় এক পাশে সরিয়ে রাখলে ১০ নম্বর জার্সি পরে খেলার রীতি ছিল মোহামেডানেও। বাদলের পর ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৪ পযন্ত সাদাকালোর ১০ নম্বর ছিল সাব্বিরের। সেই স্মৃতি হাতড়ে এক সময়ের তুখোড় এই ফুটবলার বলছিলেন, 'যতদূর মনে পড়ে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত মোহামেডানের ১০ নম্বর নিয়ে আমিই খেলেছি। এই জার্সিতে অনেক ভালোবাসা পেয়েছি মানুষের।'

সাব্বিরের পর দুই দফায় মোহামেডানের ১০ নম্বর পরে বিখ্যাত হয়ে আছেন আলফাজ আহমেদ ও ইমতিয়াজ আহমেদ নকিব। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পযন্ত আলফাজ, পরে নকিব। তবে আলফাজের দাবি মাঝে ক্লাব বদল করলেও পুনরায় ফিরে আসার পর ২০০২ সালে জার্সিটি আবার পেয়েছিলেন তিনি। এর আগে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার হয়ে ১০ নাম্বার জার্সিতে খেলেছেন নকিব।

এরপর অভিজাত এই নম্বর নিয়ে ঘরোয়া ফুটবলে আলাদাভাবে আর কেউ আলো কেড়ে নিতে পারেননি। কিছুটা ব্যতিক্রম বলা যায় জাহিদ হাসান এমেলিকে। ২০১০ সালের পর যখন যে ক্লাবেই গিয়েছেন, ১০ নম্বর উঠেছে তাঁর গায়েই। আবাহনী, মোহামেডানও শেখ রাসেলের ১০ নাম্বার জার্সিতে খেলেছেন তিনি।

সদ্য বাতিল বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের প্রতিটি বড় ক্লাবেই ১০ নম্বর জার্সি ছিল বিদেশিদের গায়ে। আবাহনীতে নাইজেরিয়ান সানডে সিজোবা, মোহামেডানে মালির সুলেমান ডায়াবাতে, শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্রে নাইজেরিয়ান রাফায়েল অনব্রো পরেছেন মর্যাদার ১০ নম¦র। তবে নতুন বড় দল বসুন্ধরা কিংসের ১০ নম্বও জার্সি ছিল স্থানীয় তৌহিদুল আলমের গায়ে। অবশ্য তৌহিদুল এতই দূর্ভাগা যে, গায়ে ১০ নম্বর চড়িয়েও তাঁর মাঠে নামার সুযোগ হয় না নিয়মিত।