ক্যাসিনো–কাণ্ডের এক বছর পূর্ণ হয়েছে গত ১৮ সেপ্টেম্বর। এই সময়ে কেমন কাটল ক্লাবগুলোর? উত্তর খোঁজা হয়েছে নতুন এই ধারাবাহিকে। আজ দ্বিতীয় দিনে পড়ুন ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাবের বর্তমান অবস্থার কথা।
একসময় খেলোয়াড় তৈরির কারখানা বলা হতো ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাবকে। নব্বই দশক পর্যন্ত কোনো কোনো বিকেলে ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে ফকিরেরপুলের লোকজন ফিরতেন জয়ের আনন্দ নিয়ে। হয়তো আবাহনীকে হারিয়ে বা মোহামেডানকে রুখে বীরোচিত ড্র। পরদিনের খবরের কাগজে বড় শিরোনামে ইংয়মেনস। কিন্তু আজ সবই স্মৃতি।
আজ বরং ক্লাবের অবক্ষয় নিয়েই যাবতীয় আলোচনা। সাম্প্রতিক বছরে ক্ষমতা, অর্থ, লুটপাট-এসব ফিরিস্তিই শোনা যায় বেশি। কর্মকর্তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে বলেন। খেলার আলোচনা যেখানে বলতে গেলে নেই-ই। ক্লাবটা যেন টাকা আয়ের হাতিয়ার।
২০০৭ সাল থেকে এই ক্লাবের সভাপতি ছিলেন মতিঝিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিরুল ইসলাম মল্লিক। তাঁকে সরিয়ে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সভাপতি পদ ‘দখল’ করেন ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। সেটাও চরম নাটকীয় কায়দায়। নাসিরুলের মুখে শুনুন সেই বর্ণনা, ‘খালেদ ও তার সঙ্গীরা একদিন প্রায় এক-দেড় শ হোন্ডা নিয়ে ক্লাব দখল করে। আমি তখন বাইরে ছিলাম। আমাকে হুমকি দেওয়া হয়, “ভুলেও ক্লাবে আইবেন না। নইলে খারাপ হইব। ” বাকিদেরও চলে যেতে বলে। তারা বলে, ক্লাবে বোর্ড বসাবে।’
আয়-ব্যয়ের হিসাব কই ইয়ংমেনস ক্লাবের দোকান আছে ১৫ টির মতো। এখান থেকে ভাড়া বাবদ কিছু টাকা আসে। ক্লাব ভবনের দোতলায় একটি বড় গুদামঘর আছে। একটি ইলেকট্রনিকস কোম্পানি সেটি ভাড়া নিয়েছে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেটির ভাড়া আসার কথা ৩২ লাখ টাকা। কিন্তু সেই ভাড়ার অগ্রিমের সঠিক কোনো হিসাব নেই বলে দাবি সহসভাপতি জাহাঙ্গীর আলম প্রধানের। ক্যাসিনো ভাড়া থেকে যা আসত, সেই টাকারও হিসাব পাননি বলে তিনি জানান। ‘আর্থিক বিষয়ে জানতে চাইলে বলা হতো টাকা খেলার পেছনে খরচ করা হয়। অথচ ইয়ংমেনস খেলেই শুধু একটা খেলা’-বলছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। এসব ব্যাপারে জানতে ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাব্বির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্ট করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া দেননি।
শুধু জুয়ার বোর্ডই নয়, ২০১৮ সালের শুরুতে খালেদ ক্যাসিনো বসান ইয়ংমেনসে। ক্যাসিনোর ভাড়া পেত ক্লাব। কিন্তু সেই ভাড়ার টাকা কোথায় গেল, অনেকেই জানেন না। ক্লাবের ভেতরেই এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ক্লাবটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পাওয়া জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হাজী মোহাম্মদ সেলিমও এ বিষয়ে জানেন না বলছেন। ‘আমাকে জোর করে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বানিয়েছে। সবাই মিলে অনুরোধ করায় শেষ পর্যন্ত ফেলতে পারিনি’-তিনি শুধু এটুকুই বলেন।
এক বছর ধরে ক্লাবটিতে তালা ঝুলছে। ইয়ংমেনস এখন পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে খেলে। ক্যাসিনো-কাণ্ডের পর এই লিগ হওয়ার কথা ছিল গত এপ্রিলে। কিন্তু করোনায় লিগ বাতিল হয়ে যাওয়ায় তাদের মাঠে নামতে হয়নি। তবে মার্চে শুরু হওয়া চ্যাম্পিয়নশিপের দলবদলে অংশ নেয় ইয়ংমেনস। তখন ১৫ লাখ টাকা দেওয়া হয় ফুটবলারদের। আর্থিক সহায়তা করেন ক্লাবের সহসভাপতি ও ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ রিয়াজুল করিম। বাফুফের ৩ অক্টোবরের নির্বাচনে ইয়ংমেনসের কাউন্সিলর রিয়াজুল ক্লাবের বর্তমান অবস্থা নিয়ে চরম হতাশ, ‘সামনে খেলা শুরু হবে। কিন্তু ক্লাবটা কীভাবে চলছে জানি না। কোনো স্বচ্ছতা নেই। ক্লাবের টাকাপয়সা কোথায় যায়, সেটা আমাদেরও অজানা।’
ক্লাবে আর্থিক কোনো নিরীক্ষা হয় না। বার্ষিক সাধারণ সভা হিমাগারে। এসব তথ্য জানিয়ে সহসভাপতি জাহাঙ্গীর আলম প্রধান বললেন, ‘কোনো শৃঙ্খলাই নেই এই ক্লাবে। এভাবে একটি ক্লাব চলতে পারে না।’ ক্যাসিনো-ঘটনার পর ক্লাবের বিদ্যুৎ আর গ্যাসলাইন কাটতে এসেছিল সংশ্লিষ্ট বিভাগ। তখন বকেয়া বিল ছিল ২২ লাখ টাকা। ক্লাবের দোকান ও গোডাউন ভাড়া থেকে এ বকেয়ার অনেকটা শোধ করা হয়েছে।
নেতৃত্ব আর জুয়া–ক্যাসিনোর আমদানিই ইয়ংমেন্সের সর্বনাশের মূলে
ভবিষ্যতে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ খেলতে বাফুফের বেঁধে দেওয়া মানদণ্ড মেনে ক্লাব লাইসেন্সিং করতে হবে ইয়ংমেনসকে। কিন্তু সহসভাপতি জাহাঙ্গীর আলম প্রধানের ভাষ্য, ইংয়মেনসের কোনো ব্যাংক হিসাবই নেই। গঠনতন্ত্র হালনাগাদ নয়। ফলে এগুলো কীভাবে বাফুফের কাছে জমা দেওয়া হবে, সে নিয়ে ভাবছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ক্লাবটির কোনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি পর্যন্ত করা হয়নি! খালেদের কমিটিতে ছিলেন তিনজন সহসভাপতি, একজন সাধারণ সম্পাদক ও একজন যুগ্ম সম্পাদক। খালেদ গ্রেপ্তার হলে তাঁর সহযোগী ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক কিসলুও সরে যান।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইয়ংমেনসে সুবিধা লুটতেই আসে বেশির ভাগ মানুষ। ২০১৬ সালে দলটি চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রিমিয়ারে উঠলেও খেলেনি টাকা না থাকার অজুহাতে। থেকে যায় দ্বিতীয় স্তরেই। অথচ ১৯৬০ সালে খেলার জন্যই জন্ম হয়েছিল ক্লাবটির। প্রথম বছরেই তৃতীয় বিভাগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে ওঠে। প্রথম বিভাগে আসে ১৯৮৭ সালে।
অনেকে বলেন, মনজুর হোসেনের (মালুর) নেতৃত্বে ক্লাবের অবস্থা ভালো ছিল। মনজুরের বাড়িতে তাঁর পড়ার টেবিলেই ইয়ংমেনসের জন্ম। তিনি ছিলেন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। প্রতিভা খুঁজে এনে নিজে কোচিং করাতেন। সেই মনজুর কণ্ঠ এখন বেদনাহত, ‘নেতৃত্ব আর জুয়া ক্যাসিনোর আমদানিই ক্লাবটির সর্বনাশের মূলে।’ একই কথা আবদুর রহিমেরও। ১৯৮৬ সালে তিনি স্থানীয় সাংসদ হওয়ার পর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে স্থায়ী জায়গা পায় ইয়ংমেনস। ক্লাবটির দীর্ঘদিনের এই সাধারণ সম্পাদক মনে করেন, যা হওয়ার হয়েছে। এখন ক্লাবগুলো খুলে দেওয়া উচিত।
এটাই এখন সবার চাওয়া। তবে তার আগে ইয়ংমেনসে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি জরুরি।