'কার্লোস ব্রাফেট' মনে রাখার মতো এক নাম
লং অনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন্ট বোল্টের তালুবন্দী হলেন ব্রাফেট। হতাশায় তাঁর শরীরটাও যেন মাটিতে হেলে পড়তে চাইল! নিউজিল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা এমন ‘নখ কামড়ানো’ ম্যাচ জয়ের উদ্যাপন করলেন, উল্লাস করলেন। আরও একটা কাজ করলেন; ছুটে গেলেন ব্রাফেটকে সান্ত্বনা দিতে, তাঁর পিঠ চাপড়ে দিতে। সব হারিয়ে উইন্ডিজদের স্বপ্ন যখন প্রায় ডুবে যাচ্ছিল, তখন একাই অতল থেকে সে স্বপ্ন তুলে আনার চেষ্টা করেছেন ব্রাফেট। শেষ পর্যন্ত তিনি পারলেন না।
২৯২ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা নিউজিল্যান্ডের কাছে ৫ রানে হারল। এ জয়ে অপরাজিত নিউজিল্যান্ড ১১ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের শীর্ষে উঠে গেল। তবে এসব হিসাব এক পাশে রেখে এ ম্যাচে সবাই মনে রাখবে ব্রাফেটের অমন দাপুটে, বুক চিতিয়ে লড়াই করা ব্যাটিংটাই।
এমন ম্যাচ বছরে বারবার আসে না। যে ম্যাচের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে উত্তেজনা আর রোমাঞ্চের অনুভূতি। এবারের ক্রিকেট বিশ্বকাপের শুরু থেকে বেশ শোনা যাচ্ছিল—‘নাহ্, জমছে না...বড্ড একপেশে...’ এমন কথামালা। তবে বিশ্বকাপ ক্রিকেট জমে উঠেছে, দিন শেষে বুঝিয়ে দিচ্ছে ‘ক্রিকেট খালি হাতে ফেরায় না।’ এই যেমন আজকের দুটি খেলার কথাই ধরুন না। ভারতকে হারিয়ে রূপকথার গল্প অল্পের জন্য লেখা হয়নি আফগানিস্তানের। সে কাহিনি এতক্ষণে জানা হয়ে গেছে নিশ্চয়। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের শনিবারের আরেক ম্যাচে ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে মুখোমুখি হয়েছে নিউজিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই ম্যাচের ভাগ্য পেন্ডুলামের মতো দুলেছে শেষ পর্যন্ত।
নিউজিল্যান্ডের ইনিংসের কথাই বলা যাক আগে—ইনিংসের প্রথম বলেই রান না করে বিদায় নেন মার্টিন গাপটিল। কটরেলের এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়েন কিউই ওপেনার। আরেক ওপেনার কলিন মানরোরও একই দশা! দলের ৭ রানের মাথায় এই ওপেনারও ফেরেন কোনো রান না করে। ৭ রানে ২ উইকেট হারিয়ে নিউজিল্যান্ড ঘুরে দাঁড়ানোর বার্তা দেয় উইলিয়ামসন ও টেলরের ব্যাটে ভর করে। নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক তো শেষ পর্যন্ত ১৫৪ বলে ১৪৮ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংসই খেলে ফেলেন। তিনিও অবশ্য শিকার হন কটরেলের। উইলিয়ামসন সাজঘরে ফেরার আগে তাঁকে সঙ্গ দেওয়া টেলর (৬৭) শিকার হন গেইলের। এরপর ক্রিজে খানিকক্ষণ ছিলেন লাথাম (১২)। উইলিয়ামসনকে ফেরানোর আগে লাথামের উইকেটও তুলে নেন কটরেল। নিউজিল্যান্ডের সংগ্রহ ততক্ষণে ৫ উইকেট হারিয়ে ২৫১। এরপরের ব্যাটসম্যানরা এসেই উইন্ডিজ বোলারদের ওপর চড়াও হন। শেষ পর্যন্ত ৮ উইকেট হারিয়ে পুরো ওভার খেলে নিউজিল্যান্ডের সংগ্রহ গিয়ে ঠেকে ২৯১ রানে।
এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসের কথাই শোনা যাক তাহলে—২৯২ রানের লক্ষ্য অসম্ভব না। কিন্তু শুরুতেই দলের ৩ রানের মাথায় ১ রান করেই শাই হোপ ফিরে গেলে চাপে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। নিকোলাস পুরানও (১) খুব বেশিক্ষণ ক্রিস গেইলকে সঙ্গ দিতে পারেননি। দলের ২০ রানে ২ উইকেট হারানো উইন্ডিজ তখন ঘুরে দাঁড়ায় গেইল ও হেটমায়ারের ব্যাটে চড়ে। হ্যাটমেয়ার ৫৪ রান করে আউট হন। রানের চাকা সচল রাখা গেইল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জেসন হোল্ডারেরও (০) চলে যাওয়া দেখেন। নিজে ৮৪ বলে ৮৭ রান করে যখন ফিরে যান তখন দলের সংগ্রহ ৫ উইকেটে ১৫২। ততক্ষণে ক্রিজে আসেন ব্রাফেট। গেইলের পর নার্সও ১ রান করে আউট হলে উইন্ডিজদের পরাজয় তখন সময়ের ব্যাপার ধরে নেন অনেকে (১৬৩/৬)। স্কোরবোর্ডে আর ১ রান যোগ করে এভিন লুইস যখন ফিরে যান খেলার পরিধি তখন মাত্র অর্ধেক শেষ হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পরাজয় তখনই লিখে ফেলেন কেউ কেউ। কে জানত ব্রাফেট ‘অতিমানবীয়’ এমন ইনিংস খেলবেন!
৪৩ ওভার শেষে উইন্ডিজের সংগ্রহ ৮ উইকেটে ২৪৩। জিততে হলে ৪২ বলে ৪৯ রান করতে হবে। ক্রিকেটের মারমার-কাটকাট যুগে খুবই সহজ সমীকরণ। কিন্তু উইকেট যে হাতে নেই। রোচ ফিরে গেছেন ২১৮ রানের মাথায়। ক্রিজে থাকা কটরেলকে নিয়ে আর কত দূরই বা যাওয়া যায়!
৪৪তম ওভারে উইলিয়ামসন বোলিংয়ের দায়িত্ব দেন বোল্টের কাঁধে। প্রথম বলে সিঙ্গেলস নেন ব্রাফেট। বাকি পাঁচ বল কোনো মতে সামাল দেন কটরেল। পরের ওভারে বোলিংয়ে আসেন ফার্গুসন। তাঁর ওভারের চতুর্থ বলে ১ রান নিয়ে ম্যাচ বাঁচানোর দায়িত্ব দেন কটরেলের কাঁধে। কিন্তু ওভারের শেষ বল যেন আগুনের গোলা ছিল। কোনোভাবেই কটরেল সেটা সামলাতে পারলেন না।
৮ উইকেটে ২৪৩ থেকে ৯ উইকেটে ২৪৫ রান ওয়েস্ট ইন্ডিজের। তখনো ৩০ বলে ৪৭ রান দরকার। নিউজিল্যান্ডের একটা বলেই শেষ হয়ে যাবে সব। তবে আশার কথা একটাই, বোল্ট (১০ ওভারে ৪ উইকেট) আর ফার্গুসনের (১০ ওভারে ৩ উইকেট) বোলিংয়ের কোটা শেষ। এই দুইয়ের বোলিং শেষে হেনরিকে আক্রমণে আনেন উইলিয়ামসন। তখনই ম্যাচের মোড় অন্যদিকে ঘুরে যায়। হেনরি যখন আসেন, তখন জিততে হলে ১৮ বলে ৩৩ রান দরকার ওয়েস্ট ইন্ডিজের। হেনরির প্রথম বলে ২ রান, পরের ৩ বলেই ছক্কা, পরের বলে ৪, শেষ বলে ১ রান নিয়ে স্ট্রাইক ধরে রাখলেন ব্রাফেট। তুলে নিলেন ১ ওভারে ২৫ রান। ব্রাথওয়েট যেন এরই অপেক্ষায় ছিলেন!
১২ বলে দরকার ৮ রান, দূরের বাতিঘর নয় মোটেও। একটু দেখেশুনে খেললেই হয়ে যাবে। ততক্ষণে ক্যারিয়ারের প্রথম শতক থেকে মাত্র ১ রানের দূরত্বে ব্রাফেট। ৪৯তম ওভারে আসলেন নিশাম। তাঁর প্রথম ৩ বল ডট দেওয়ার পর চতুর্থ বলে ২ রান নিয়ে শতক পূর্ণ করলেন ব্রাফেট। শতকের উদ্যাপনও করে নিলেন। সতীর্থ, দর্শকদের অভিবাদনের জবাব দিলেন। ৭ বলে আর ৬ রান করলেই তাঁর এই শতক আজীবন মনে রাখবে উইন্ডিজ ক্রিকেটভক্তরা। এমন কিছু কি তাঁর মনে উঁকি মারছিল তখন? পরের বলে ব্রাফেটকে পরাস্ত করলেন নিশাম। ওভারের শেষ বলে কী যেন হলো ব্রাফেটের! শর্ট বলে তুলে মারলেন লং অনে। বোল্টের হাতে ধরা খেয়ে স্রোতের বিপরীতে রুখে দাঁড়ানোর গল্পের শেষটা সুন্দর করে লিখতে পারলেন না ব্রাফেট। তবু কি তাঁর নাম ভুলে যাবে ক্রিকেট বিশ্ব?