লায়ন থেকে ‘গোট’ হয়ে ওঠার গল্প
৮০০ টেস্ট উইকেট! মুত্তিয়া মুরালিধরনের এই ‘পর্বত’-এর চূড়ায় ওঠার কেউ আছেন?
এখনকার স্পিনারদের মধ্যে নাথান লায়ন ও রবিচন্দ্রন অশ্বিন। মুরালির বাজির ঘোড়া তাঁর প্রতিবেশী দেশের স্পিনার। ওদিকে মুরালির মাঠের প্রতিদ্বন্দ্বী শেন ওয়ার্নের বাজি নিজের দেশের স্পিনার লায়ন। টেস্ট ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এ উইকেটশিকারির বিশ্বাস, লায়ন আরও বেশ কয়েক বছর খেলতে পারলে যে কোনোকিছুই সম্ভব।
লায়ন নিশ্চয়ই এসব নিয়ে ভাবছেন না। দেশের হয়ে টেস্ট খেলার স্বপ্ন থাকে বেশির ভাগ ক্রিকেটারের। লায়ন সেখানে ব্রিসবেনে জন্মভূমির হয়ে খেলছেন শততম টেস্ট; ঈর্ষা তো অস্বাভাবিক কিছু না! লায়ন অবশ্য ঈর্ষাকে স্বাভাবিকভাবে নিয়ে বলতে পারেন, কী আর করা! সব-ই তো ভাগ্য ও চেষ্টার খেলা!
ভাগ্য? ক্যানবেরায় ছিলেন পিচ কিউরেটর, সেখান থেকে হয়ে গেলেন টেস্ট ক্রিকেটার! তা-ও কারণে–অকারণে বৈচিত্রের এই যুগে ‘ক্ল্যাসিক’ টেস্ট অফ স্পিনার। বল বাতাসে ভাসিয়ে ব্যাটসম্যানের চোখকে ধন্দে ফেলা, তীক্ষ্ণ বাঁক ও বাউন্স; ৯ বছর ধরে তাঁর আঙুল অবিশ্রান্তভাবে কাজটা করে যাচ্ছে শুধুই অস্ট্রেলিয়ার হয়ে উইকেট নিতে।
স্পিনে তাঁর প্রতিভা চিনেছিলেন বিগ ব্যাশের কোচ ড্যারেন বেরি। ক্যানবেরা থেকে অ্যাডিলেডে এসেছিলেন মাঠকর্মী হয়ে। সেখানেই লায়নের অফ স্পিন ধরা পড়ে বেরির রাডারে। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টি-টোয়েন্টিতে ভালো করলেন, এর প্রথম শ্রেণিতে অভিষেকের সাত মাস পর ডাক পড়ল টেস্ট দলে, ২০১১ শ্রীলঙ্কা সফরে। অস্ট্রেলিয়াও তখন শেন ওয়ার্নের শূন্যতা পূরণে মরিয়া। ‘জাদুকর’-এর প্রস্থানের পর ১১জন স্পিনার পরখ করেছে অস্ট্রেলিয়া, এমনকি ব্যাটসম্যানকে (স্মিথ) দিয়েও করিয়েছে স্পিন। কিন্তু মনের মতো মেলেনি, লায়ন মিলিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত।
আর মিলিয়ে দেওয়াটাও ছিল কী প্রভাবজাগানিয়া! গলের স্পিনবান্ধব উইকেটে টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম বলেই তাঁর শিকার কুমার সাঙ্গাকারা। সেই ক্ল্যাসিক অফ স্পিনেই স্লিপে, শেন ওয়ার্ন ঠিক যেভাবে একের পর এক শিকার করে গেছেন ক্ল্যাসিক লেগ স্পিনে! লায়ন তাঁর উল্টো সংস্করণ ; ওয়ার্ন যেমন অস্ট্রেলিয়ার সেরা লেগি, লায়নও তেমনি অস্ট্রেলিয়ার সেরা অফ স্পিনার। ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরাও নয় কি!
টেস্ট ক্রিকেটের ১৪৪ বছরের ইতিহাসে ন্যূনতম ১০০ টেস্ট খেলার সৌভাগ্য হয়েছে ৬৮ ক্রিকেটারের। লায়ন তাঁদের সর্বশেষ ও ১৩তম অস্ট্রেলিয়ান। শুধু শেন ওয়ার্ন ও লায়নই বিশেষজ্ঞ স্পিনার হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ন্যূনতম ১০০ টেস্টের দেখা পেলেন। অ্যালান বোর্ডার, মাইকেল ক্লার্ক ও ডেভিড বুনদের ব্যাটসম্যান পরিচয়টা হাত ঘোরানো ছাপিয়ে গেছে।
টেস্টে ন্যূনতম ১০০ ম্যাচ খেলা শীর্ষ পাঁচ স্পিনারের একজনও লায়ন। এর মধ্যে লেগি দুজন—শেন ওয়ার্ন ও অনিল কুম্বলে। অফ স্পিনার তিনজন মুরালিধরন, হরভজন ও লায়ন। অফ স্পিনারদের মধ্যে উইকেটসংখ্যায়ও মুরালির পর যথাক্রমে হরভজন (৪১৭) ও লায়ন (৩৯৭)। ব্রিসবেনে আজ রোহিতকে তুলে নিয়ে চার শ-এর পথে শেষ চার ধাপের যাত্রা শুরু হয়েছে লায়নের, যার শুরুটাও ছিল ‘কীর্তিমান’ খাতায় নাম তুলে। ৯ বছর আগে সাঙ্গাকে তুলে নিয়ে টেস্টে প্রথম বলে উইকেট পাওয়া ২০ জন চরম সৌভাগ্যবানদের একজন!
কিন্তু এসবের কোনো কিছুই লায়নের শ্রেষ্ঠত্বকে সেভাবে স্পষ্ট করে না। পরিসংখ্যানে শুধু একটি পাতায় তা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার—টেস্ট অভিষেকের পর থেকে এ সংস্করণে তিনিই সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। আর কোনো বোলার তাঁর মতো এত উইকেট নিতে পারেননি। আর কোনো অস্ট্রেলিয়ান বোলার তাঁর মতো টানা পাঁচ বছর (২০১৫-২০১৯) ৪০টি করে উইকেট নিতে পারেননি।
লায়নের ৩৩ বছর বয়স নিয়ে মাথাব্যথা থাকতে পারে অনেকের। কিন্তু স্পিনাররা সম্ভবত এ সময়েই সবচেয়ে পরিণত হন। সে পথে টেস্টে সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানদের ভালোই ভুগিয়েছেন লায়ন। বিরাট কোহলিকে যেমন টেস্টে সাতবার আউট করেছেন, যা পারেননি আর কেউ। আবার কোহলিদের মাটিতে গিয়ে সফরকারি দলের বোলারদের মধ্যে ইনিংসে দুবার ৭ উইকেট নেওয়া বোলারও লায়ন।
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক কোচ জন বুকানন লায়নের শততম টেস্টের আগে বর্তমান কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে বলেছেন, ‘খেলোয়াড়দের গ্রেটনেস মাপতে হয় স্থায়ীত্ব দিয়ে। নাথান লায়ন যেমন এ সপ্তাহে শততম টেস্ট খেলবে, তার মানে হলো সে নানা রকম উত্থান-পতন, চাপ ও বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছে।’ গ্লেন ম্যাকগ্রার ভাষায়, ‘অস্ট্রেলিয়ার হয়ে একটা টেস্ট খেলাই যেখানে অবিশ্বাস্য বিষয়, সেখানে আরও ৯৯টি টেস্ট খেলা মানে বিশাল অর্জন।’
মার্ক ওয়াহর মতে, বেশির ভাগ সময় ‘তারকা ইমেজের বাইরে থেকেই শততম টেস্ট খেলছেন লায়ন।’ অথচ হিউ ট্রেম্বলের ১৪১ উইকেট টপকে যাওয়ার পর থেকেই তিনি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়া অফ স্পিনার। অনেকে তাই বলেন ‘গোট’ (গ্রেটেস্ট অব অলটাইম)।
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ২৪ টেস্ট খেলা কেরি ও’কিফ ১১ বছর বয়সী লায়নকে নিউ সাউথ ওয়েলসের এক কোচিংয়ে দেখে তাঁর মা–বাবাকে বলেছিলেন, ছেলেটির টেনিস খেলা উচিত। ক্রিকেটে লায়নের কোনো ভবিষ্যত দেখেননি ও'কিফে। হয়তো তাঁর বাবারও তেমন বড় আশা ছিল না। অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার খবর বাবাকে ফোনে জানিয়েছিলেন লায়ন। ওপাশ থেকে ধরে আসা গলায় বাবা বলেছিলেন, ‘অন্তত একটা টেস্ট তো খেলতে পারবে!’
লায়নের ভাষায়, বাবা আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। খবরটা শুনে কাঁদতে থাকা তাঁর মা, দাদী ও হতবাক ভাইয়ের মতো আবেগের দুয়ার খুলে দিতে পারেননি। যেমন সহসা পারছেন না শেন ওয়ার্নও। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে শততম টেস্ট খেলা স্পিনারের তালিকায় সতীর্থ হিসেবে এত দিনে কাউকে পেয়ে ওয়ার্নের আহ্লাদিত হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু লায়নকে এখনই পরের কাজটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ওয়ার্ন।
‘সে চোট এড়াতে পারলে আরও পাঁচ বছর অনায়াসে খেলতে পারবে। সম্ভবত আরও ৫০ টেস্ট। ফর্ম ধরে রেখে ম্যাচপ্রতি ৪টি করে উইকেট নিতে পারলেও আরও ২০০-২৫০ উইকেট হবে। সে জন্য খুব ভালো পাঁচটি বছর কাটাতে হবে। তারপর ফর্ম ধরে রাখতে পারলে হয়তো চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে মুরালিকে।’
মুরালিধরন, শুনতে পাচ্ছেন? লায়ন, কথাটার মানে নিশ্চয়ই জানেন!