রাজ্জাক তো জানেনই, ‘সহজ ভাবলে সহজ, কঠিন ভাবলে কঠিন’
জীবনের নতুন অধ্যায় শুরুর সংকেতবাহী খবরটা যে আবদুর রাজ্জাক ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের মাঝপথে পেলেন, এটাকে খুব তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। ক্রিকেটার রাজ্জাকের জীবনের সঙ্গে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এক সিরিজেই প্রথম ডাক পেয়েছিলেন বাংলাদেশ দলে, এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই তাঁর ক্যারিয়ারের পুনর্জন্ম। এখন দেখা যাচ্ছে, রাজ্জাকের শেষ ওয়ানডেটিও এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই।
এত দিন বলতে হতো, সর্বশেষ ওয়ানডে। খেলা তো আর ছাড়েননি। চার বছরের বিরতির পর ২০১৮ সালে যেভাবে টেস্ট ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল, ওয়ানডেতেও তো তেমন হতেই পারত। খেলা চালিয়ে গেলে ক্রিকেটে শেষ বলে যে কিছু নেই, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণের গল্পটি তো আমাদের চোখের সামনেই লেখা হচ্ছে। যা লিখছেন পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান ফাওয়াদ আলম। আবদুর রাজ্জাকও মনে মনে এমন কিছুর স্বপ্ন দেখতেন কি না, আমরা তা জানি না। এখন অবশ্য এই আলোচনার আর কোনো অর্থ নেই। জাতীয় নির্বাচক হিসেবে রাজ্জাককে নির্বাচন করার ঘোষণা নিশ্চিত করে দিয়েছে, ২০১৪ সালের ২৫ আগস্ট সেন্ট কিটসেই শেষ হয়ে গেছে তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ার।
সেই শেষটা মনে রাখার মতো কিছু নয়। ১০ ওভারে ৭৬ রান দিয়ে ১ উইকেট। শেষটা না হয় রাঙিয়ে রাখতে পারেননি (তা পারলে অবশ্য ওখানে শেষই হয় না), তবে মনে রাখার মতো আরও কত কিছুই তো আছে রাজ্জাকের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে। হ্যাটট্রিক আছে, বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ২০০ উইকেট নেওয়ার মাইলফলক, আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ দশে নাম...। এসব পরিসংখ্যানেই লেখা আছে। যা লেখা নেই, সেই ঘোষণাটা দেওয়ার সময় হলো এবার। বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসে সেরা বোলারের নাম আবদুর রাজ্জাক।
সাফল্যের বিচার করতে সংখ্যাই যথেষ্ট। ‘সেরা’র বিচার শুধু সংখ্যায় হয় না। এখানে মতভেদ থাকাটাই তাই স্বাভাবিক। তবে আবদুর রাজ্জাকের ক্ষেত্রে খুব একটা তর্কবিতর্ক হবে বলে মনে হয় না। উইকেট-সংখ্যায় তাঁর ওপরে আছেন দুজন—মাশরাফি বিন মুর্তজা ও সাকিব আল হাসান। তবে তাঁরা ম্যাচও খেলেছেন অনেক বেশি। ম্যাচপ্রতি উইকেট হিসাব করলে রাজ্জাক এই দুজনের চেয়েই এগিয়ে (রাজ্জাক ১.৩৫, সাকিব ১.২৭, মাশরাফি ১.২৩)। ওয়ানডেতে বোলারের কার্যকারিতা বুঝতে উইকেটের মতোই গুরুত্বপূর্ণ বোলিং অ্যাভারেজ ও ইকোনমি রেট। প্রথমটিতে রাজ্জাক বাকি দুজনের চেয়ে এগিয়ে, সাকিবের সঙ্গে ব্যবধান যদিও দশমিকের। ইকোনমি রেটে আবার উল্টো, দশমিকের ব্যবধানে সেখানে এগিয়ে সাকিব।
আপনি কী ভাবছেন, অনুমান করতে পারছি। সংখ্যা দিয়ে সেরার বিচার হয় না বলে সেই সংখ্যা নিয়েই তো দেখি ঘাঁটাঘাঁটি হচ্ছে। তা করার একটাই কারণ, শুধু সংখ্যা দিয়েও যে রাজ্জাককে সেরার স্বীকৃতি দিয়ে ফেলা যায়, তা বোঝানো। তবে রাজ্জাকের আসল মহিমা লুকানো অন্যখানে। ওই যে বোলিং অ্যাভারেজ আর ইকোনমি রেটের কথা হলো, তা তো আপনাকে এটা জানাচ্ছে না যে প্রায় পুরো ক্যারিয়ারে পাওয়ার প্লে আর স্লগ ওভারে বোলিং করতে হয়েছে রাজ্জাককে। বিশ্ব ক্রিকেটে আর কোনো স্পিনার ব্যাটসম্যানদের উন্মাতাল ব্যাট চালানোর ওই সময়টাতে এমন নিয়মিত বোলিং করেছেন কি না, সন্দেহ!
মার তো কখনো কখনো খেতেই হবে, খেয়েছেনও। সেই ঝাল প্রতিপক্ষের বোলারদের ওপর ঝেড়েছিলেন একবার। শুধু ওয়ানডেতে নয়, আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেই একটি মাত্র ফিফটি। আর তাতেই কিনা বাংলাদেশের পক্ষে দ্রুততম ফিফটির রেকর্ডটিতে তাঁর যুগ্ম অধিকার! ২০১৩ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২১ বলে সেই ফিফটি ছুঁয়েছিল ৮ বছর আগে নটিংহামে ইংল্যান্ডের সঙ্গে মোহাম্মদ আশরাফুলের রেকর্ড।
ক্রিকেটার রাজ্জাককে নিয়ে লিখতে গিয়ে শুধুই যে ওয়ানডের কথা লিখে যাচ্ছি, তার কারণ আপনার জানা আছে বলেই অনুমান করি। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে বাংলাদেশের বাকি বোলারদের অনেক পেছনে ফেলে যাঁর সর্বোচ্চ উইকেট, তিনি কিনা টেস্ট খেলতে পেরেছেন মাত্র ১৩ টি! এর শেষটি আবার নাটকীয়ভাবে। সাকিবের ইনজুরি চার বছর বিরতির পর আবার ফিরিয়েছিল টেস্টে। ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই টেস্টেই তাঁর ক্যারিয়ার-সেরা বোলিং। টেস্ট ক্রিকেটে নিয়মিত হতে না পারায় রাজ্জাকের মনে অনেক দুঃখ আছে। সান্ত্বনা পেতে পারেন রাজিন্দার গোয়েলের কাহিনিটা জেনে। রাজ্জাকের মতোই বাঁহাতি স্পিনার। খেলা ছাড়ার এত বছর পরও রঞ্জি ট্রফিতে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ডটি যাঁর, সেই রাজিন্দার গোয়েলের কখনো টেস্টই খেলা হয়নি।
মূলত যাঁর প্রবল উপস্থিতির কারণে হয়নি, সেই বিষেণ সিং বেদিকে রাজ্জাক একসময় আদর্শ মানতেন বলে জানি। এই অনুরাগের সূত্রপাত, ঢাকায় বেদির একটা স্পিন বোলিং ক্যাম্প। যে ক্যাম্পের প্রথম দিনে শুরুতেই বেদি বলে নিয়েছিলেন, ‘আমি তোমাদের যা বলব, তার সব টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে। কারণ ওয়ানডেকে আমি কোনো ক্রিকেটই মনে করি না।’
গল্পটা শুনেছিলাম রাজ্জাকের মুখেই, গ্রেনাডার এক রেস্টুরেন্টে বসে। লেখার শুরুতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে রাজ্জাকের যে যোগসূত্রের কথা বলেছি, তার শুরুর অধ্যায়টাতেও তাহলে এসে গেলাম। ২০০৪ সালের সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেই বাংলাদেশ দলে প্রথম ডাক পেয়েছেন রাজ্জাক। ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ সেন্ট ভিনসেন্টে। প্রথম ম্যাচের উইকেট স্পিন বোলিংয়ের দিকে এমনই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিল যে তখনই সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, দ্বিতীয় ম্যাচে তিন বাঁহাতি স্পিনার নিয়ে নামবে বাংলাদেশ। অভিষেক হবে আবদুর রাজ্জাকের। মনে সেই রোমাঞ্চ নিয়ে রাতে ঘুমুতে গেলেন রাজ্জাক। পরদিন সকালে জানলেন, তিনি খেলছেন না। সকাল থেকে বৃষ্টি ম্যাচ সংক্ষিপ্ত করে এনেছে ২৫ ওভারে। বৃষ্টির কারণে বদলে গেছে উইকেটের চরিত্রও। রাজ্জাকের বদলে তাই খেলানো হলো পেসার তাপস বৈশ্যকে। ক্যারিয়ার-সেরা বোলিং (৪/১৬) করে সেই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতাও প্রমাণ করলেন তাপস। গ্রেনাডায় তৃতীয় ম্যাচেও রাজ্জাকের সুযোগ হলো না।
না খেলেই দেশে ফিরে আসতে হওয়া রাজ্জাককে নিয়ে ‘রাজ্জাকের আসা, রাজ্জাকের যাওয়া’ শিরোনাম দিয়ে একটা ডায়েরি লিখেছিলাম। বলা ভালো, লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম। এর আগে টুকটাক কথা হয়েছে, গ্রেনাডার ওই রেস্টুরেন্টে বসেই প্রথম একটু লম্বা কথা হলো। কথাবার্তায় এমন বিবেচনাবোধ, এমন পরিণত চিন্তাভাবনার ছাপ, একটু অবাকই হয়েছিলাম। বাংলাদেশের বেশির ভাগ নবীন ক্রিকেটারের তুলনায় যে তা রীতিমতো ব্যতিক্রমী বলে মনে হয়েছিল। পুরোনো সেই লেখাটা থেকে কিছু অংশ তুলে দিলে আপনিও বুঝতে পারবেন কারণটা—
‘ধারণা করেছিলাম, হাতের মুঠোয় থাকা স্বপ্নটা হারিয়ে ফেলার বেদনাতেই আচ্ছন্ন হয়ে আছেন আবদুর রাজ্জাক। কথা বলে বুঝলাম, এই ছেলে অন্য ধাতুতে গড়া। নিকষ অন্ধকারেও আলোর রেখা খুঁজে নিতে পারার মতোই আশাবাদী। এত কাছে এসেও খেলতে না পারার বেদনাটা অবশ্যই আছে, তবে কী পাইনি, তার হিসাব না মিলিয়ে প্রাপ্তিটাকেই দেখছেন বড় করে, “ম্যাচ খেলতে পারলে অবশ্যই আরও ভালো লাগত। তবে এই সফরে এসেই আমি অনেক কিছু শিখেছি। এর আগে শুধু টেলিভিশনেই দেখেছি, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে কাছ থেকে দেখলাম এবার।” দেখে কী মনে হলো, সহজ না কঠিন—এ প্রশ্নের উত্তরেও ফুটে বেরোল রাজ্জাকের পরিণতবোধ, “এটা আপনার নিজের কাছে। সহজ ভাবলে সহজ, কঠিন ভাবলে কঠিন।”’
রাজ্জাকের সঙ্গে কথা বলে ‘এই ছেলে অন্য ধাতুতে গড়া’ বলে যে ধারণাটা হয়েছিল, পরের এতগুলো বছরে তা আর বদলায়নি। প্রথাগত অর্থে বড় তারকা হয়তো হতে পারেননি। তবে মাঠে, মাঠের বাইরে খেলা-নিবেদন-জীবনাচরণ—সবকিছু মিলিয়ে রাজ্জাক ক্যারিয়ারজুড়েই বাংলাদেশের বাকি ক্রিকেটারদের জন্য এক রোল মডেল হয়ে ছিলেন। নির্বাচক জীবনেও সেটির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার দায় এখন তাঁর।
ও হ্যাঁ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রসঙ্গ তো এখনো শেষ হয়নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজেই রাজ্জাকের পুনর্জন্ম বলেছিলাম, সেটি কীভাবে? ওয়েস্ট ইন্ডিজে না খেলে ফিরে আসা ওই সফরের কিছুদিন পরই শ্রীলঙ্কা এশিয়া কাপে অভিষেক হয়েছিল রাজ্জাকের। যে ভয়টাকে মেনে নিয়েই তাঁকে দলে ডেকেছিলেন সে সময়ের প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ, তা সত্যি হতে একদমই সময় লাগল না। রাজ্জাকের বোলিং অ্যাকশন নিয়ে আপত্তি তুললেন আম্পায়াররা। বোলিং অ্যাকশন শুধরে টুধরে ফেরার পর কিছুদিন নির্বিঘ্নে খেললেন। ২০০৮ সালে আবারও আতশ কাচের নিচে, এবার নিষিদ্ধই। আবারও দিনরাত খেটে, অস্ট্রেলিয়ার ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা দিয়ে ফিরতে হলো। ফিরেছিলেন ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দিয়ে। তবে রাজ্জাকের সত্যিকারের ফেরা এর কিছুদিন পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে (কারণটা রাজ্জাকের ভাষাতেই বলি, ‘টি-টোয়েন্টিকে আমি গোনায় ধরি না। ওখানে ভালো বলেও ব্যাটসম্যানরা মেরে দেয়’)। ডমিনিকায় প্রত্যাবর্তন—ওয়ানডেতে প্রথম বলেই উইকেট নিলেন রাজ্জাক, এরপর আরও তিনটি উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচও।
এত দিন পর সবিস্তারে এসব বলার একটাই কারণ, তুলনায় কম আলোচিত রাজ্জাকের ‘লড়াই’টার কথা সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া। নির্বাচক হিসেবে নিযুক্তি উপলক্ষে খেলোয়াড়ি জীবন নিয়ে এত কথা কেন? বা রে, রাজ্জাকের খেলোয়াড়ি জীবন তো শেষ হতে যাচ্ছে এই ঘোষণার মাধ্যমেই। সেটিকে সেলিব্রেট করবেন না?
নির্বাচক জীবনটাকেও যেন এমন সেলিব্রেট করার উপলক্ষ হয়, সেই চেষ্টা তো রাজ্জাক অবশ্যই করবেন। শুরুটাই তো করছেন বড় একটা সুবিধা নিয়ে। এই সেদিনও খেলেছেন বলে সব ক্রিকেটারের নাড়ি-নক্ষত্র তাঁর জানা। কারও সঙ্গে খেলেছেন, কারও বা বিপক্ষে। কে কেমন, সবই তাঁর নখদর্পণে। শুধু রান আর উইকেটই তো আর নির্বাচনের মাপকাঠি নয়, তা হলে আর নির্বাচক রাখা কেন, স্কোরকার্ড দেখে যে কেউই তো তা করতে পারেন। জাতীয় দলের জন্য কোনো খেলোয়াড় নির্বাচনে রান আর উইকেটের সঙ্গে বড় বিবেচনা হওয়া উচিত মানসিকতা, চাপে রি-অ্যাক্ট করার ধরন, আত্মবিশ্বাস। এসব তো রাজ্জাকের মুখস্থ থাকার কথা। খেলোয়াড় আর নির্বাচকের মধ্যকার বেড়াটা মাত্রই টপকেছেন বলে নির্বাচকদের কাছে ওই পক্ষের চাওয়াটাও তাঁর কাছে পরিষ্কার। সব মিলিয়ে রাজ্জাকের কাজটা সহজই হওয়ার কথা।
সহজ না কঠিন, এই প্রশ্ন রাজ্জাককে আর করছি না। উত্তরটা যে জানি। গ্রেনাডায় ওই রেস্টুরেন্টে বসে যা বলেছিলেন, নির্ঘাত তা-ই বলবেন, ‘এটা আপনার নিজের কাছে। সহজ ভাবলে সহজ, কঠিন ভাবলে কঠিন।’