বল হাতে লেগেছে দেখেও স্মিথ কেন রিভিউ নিয়েছিলেন?
তাৎক্ষণিকভাবে মনে হয়েছিল, স্টিভ স্মিথের ওপর বোধ হয় ক্রিস গেইল ভর করেছেন।
মাঝে কিছুদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সর্বেসর্বা ছিলেন গেইল। এই ওপেনার রান নিলে দল জেতে বা লড়াই করে, আর ব্যর্থ হলেই প্রতিপক্ষের সামনে উড়ে যায় উইন্ডিজরা। এমন যখন দশা, তখন প্রতিপক্ষ গেইলকে আউট করলেই দেখা মিলত সে দৃশ্যের—রিভিউ নিচ্ছেন এই ওপেনার। অনেকের চোখেই যেটা নিশ্চিতভাবেই আউট, সেটাতেও আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্তুষ্ট হতেন না গেইল। আরেকবার পরখ করে দেখতেন। ভাবটা এমন, আহা দেখিই না, যদি ভাগ্য পক্ষে থাকে!
আজ ব্রিসবেনে মোহাম্মদ সিরাজের বলে যখন আউট হলেন স্মিথ, ঠিক তেমনই এক দৃশ্যের জন্ম হয়েছিল। বল যে স্মিথের গ্লাভসে লেগেছে, সেটা বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছিল। এমনকি স্মিথের প্রতিক্রিয়া থেকেও সেটা বোঝা যাচ্ছিল যে বলের গ্লাভসে লাগা নিয়ে তাঁর মনে দ্বিধা নেই। এমন অবস্থাতেও রিভিউ নিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক। তাই কিছুটা বিভ্রান্তির জন্ম নিল, কেন নিচ্ছেন রিভিউ। কিছুক্ষণের জন্য আবার ‘ব্রেন ফেড’ হয়ে গেল নাকি স্মিথের?
ক্রিকেটে ‘ব্রেন ফেড’ শব্দের জন্মদাতা স্মিথ নিজেই। ২০১৭ সালে ভারত সফরে এক টেস্টে আউট হওয়ার পর আউট নিয়ে সন্দিহান ছিলেন স্মিথ। কিন্তু সে আউটের রিভিউ নেবেন কি না, সেটা বুঝতে নিজের ড্রেসিংরুমের দিকে তাকিয়েছিলেন। আশা করছিলেন, সেখান থেকে কেউ তাঁকে নির্দেশনা দিক, আউট হয়েছেন কি হননি সেটা জেনে তাঁকে রিভিউ নেওয়ার সিদ্ধান্তে সহযোগিতা করুক। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই ভুল বুঝতে পেরে ড্রেসিংরুমের দিকে হাঁটা দেন। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তার মধ্যেই হয়েছে। ভারতের মনে হয়েছে, পরিষ্কার প্রতারণা করছেন স্মিথ। ওদিকে স্মিথ বলেছিলেন, তাঁর মাথা কাজ করছিল না, এটা ‘ব্রেন ফেড।’
আজও স্মিথ যখন আউট হয়েছেন, তখন পরিস্থিতিটা ম্যাচের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আউট হলেই দলের ব্যাটিংয়ের লেজ উন্মোচিত হয়ে যাবে। আর তিনি টিকে থাকলেই বড় লিড পাওয়ার পথটা সুগম হবে। এমন অবস্থায় স্মিথ তাই আউট হওয়ার সিদ্ধান্ত মানতে না-ও চাইতে পারেন। দিন শেষ হওয়ার আগে এর কারণ টেরও পাওয়া গেছে। ৪ উইকেটে ১৯৬ রান করা স্বাগতিক দল স্মিথের বিদায়ের পর এক শ রানও করতে পারেনি।
স্মিথ ৭৪ বলে ৫৫ রানের ইনিংসটি না খেললে ভারতের লক্ষ্যটা হয়তো ৩২৮ এর চেয়ে আরও অনেক কম হতো। স্মিথকে আউট করতে বিশেষ এক বলেরই দরকার হয়েছে আজ। ৫৫তম ওভারে সিরাজের বলটি বাড়তি বাউন্স নিয়ে স্মিথকে চমকে দেন। এবং সে বাউন্সের ফল ব্যাটে না লেগে বলটি যাওয়ার সময় স্মিথের গ্লাভসে লেগে চলে যায় স্লিপে দাঁড়িয়ে থাকা অজিঙ্কা রাহানের কাছে। উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে ভারত দল।
বলের বাড়তি বাউন্স যে তাঁকে চমকে দিয়েছে, সেটা প্রতিক্রিয়াতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন স্মিথ এবং বল লাগায় যে ব্যথাও পেয়েছেন, সেটাও হাত ঝেড়ে ঝেড়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। গ্লাভস খুলে ফেলার পর যে অংশটায় শুশ্রূষা নিচ্ছিলেন, সেটাও হাতের বুড়ো আঙুলের ওপরের অংশ। এত সব ইঙ্গিতের পরও যখন সেই স্মিথই রিভিউ চেয়ে বসলেন, তাই ভাবলে দোষ ছিল না, আবারও বোধ হয় ব্রেন ফেড হয়েছে তাঁর।
কিন্তু স্টিভ স্মিথ আবারও বুঝিয়ে দিলেন, ক্রিকেটের খুঁটিনাটি নিয়ম কতটা ভালো জানেন তিনি এবং গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সেটা মনে রাখেন।
প্রথমেই দেখা যাক, ক্রিকেটের আইনে ক্যাচ আউটের ক্ষেত্রে বলের স্পর্শ বলতে কী বোঝানো হয়। আইনের ৫.৬ ধারায় বলা হয়েছে,
‘এই আইনে, ৫.৬.১-এ ব্যাট সম্পর্কে বলা হয়েছে ব্যাটসম্যানের হাত বা গ্লাভসের ব্যাট ধরা আছে। যদি না অন্য কিছু হয়ে থাকে।
৫.৬.২-এ বল এবং ৫.৬.২.১ থেকে ৫.৬.২.৪ উপধারায় বর্ণিত বস্তুর সঙ্গে স্পর্শ সম্পর্কে বলা হয়েছে।
৫.৬.২.১ ব্যাট
৫.৬.২.২ ব্যাট ধরে রাখা ব্যাটসম্যানের হাত
৫.৬.২.৩ যে হাতে ব্যাটসম্যান তাঁর ব্যাট ধরে রেখেছেন সে হাতের গ্লাভসের যেকোনো অংশ
(এই তিনটি ক্ষেত্রেই) বল লেগেছে বা ব্যাটের স্পর্শ পেয়েছে বা ব্যাট দিয়ে মারা হয়েছে বলে ধরা হবে।’
এই কঠিন ভাষা পড়ে যদি নিয়মটা বুঝতে কষ্ট হয়, তাহলে আরেকবার ব্যাখ্যা করা যাক। তবে আরেকটু সহজ ভাষায়। ব্যাটসম্যানকে তখনই আউট দেওয়া যাবে, যখন ব্যাট তাঁর হাতে বা গ্লাভসে ধরা থাকে। আজ যখন বলটা আচমকা বাউন্স করেছিল, তখন স্মিথের ডান হাত একটু সরে এসেছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় স্মিথের মনে হয়েছিল বল যখন তাঁর গ্লাভসে লেগেছে, ততক্ষণে তাঁর গ্লাভস থেকে ব্যাটের হাতল ছুটে গেছে।
বাউন্সারের ধাক্কা থেকে বাঁচার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই পেছনের হাত সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা থাকে। স্মিথ ভেবেছিলেন, সময়মতো তিনিও গ্লাভস সরিয়ে নিতে পেরেছিলেন। আর এ কারণেই তিনি রিভিউ নিয়েছিলেন। যদি রিভিউতে দেখা যেত, বল যখন গ্লাভসে লেগেছে, তখন ওই গ্লাভসের সঙ্গে ব্যাটের স্পর্শ নেই, তাহলেই বেঁচে যেতেন স্মিথ। কিন্তু রিপ্লেতে দেখা গেছে স্মিথ সেটা করতে পারেননি। আর তাই ৫৫ রানেই ফিরতে হয়েছে তাঁকে।