দুই যুগের দুই কোচের চোখে বাংলাদেশ
‘আমি চাই, বাংলাদেশ এই ম্যাচটাতে ভালো করুক। জিতে যাক, এটা চাইছি না। সবচেয়ে ভালো হয়, নিউজিল্যান্ড ২৮০ রান করল, এরপর বাংলাদেশ ১০ রানে হারল। খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হলে দেখে কোনো মজা নেই।’
ডানেডিনে তৃতীয় ওয়ানডেতে তখন নিউজিল্যান্ড ব্যাটিং করছে। পাকা চুল ও পাকা গোঁফের ভদ্রলোক নিজে থেকে এসেই পরিচিত হয়েছেন। ইউনিভার্সিটি ওভাল মাঠের প্যাভিলিয়নের উল্টো দিকে পাশাপাশি প্রেসবক্স আর কমেন্ট্রি বক্স। রেডিও কমেন্ট্রি বক্স থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেই বুঝেছি, স্থানীয় কোনো ধারাভাষ্যকার হবেন। গলায় ঝোলানো অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেখে তিনিও আমার পরিচয় পেয়ে গেছেন। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সাংবাদিক, তাই না? আমি বাংলাদেশে গেছি। টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের মেয়েদের নিয়ে। সিলেটে খেলা হয়েছিল।’
২০১৪ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের মেয়ে দলটার কোচ যেন কে ছিলেন? মনে করতে না পেরে নামটা জিজ্ঞেস করেই ফেললাম। যা শুনে রীতিমতো লজ্জা পেলাম। ইনিই ওয়ারেন লিস। নিউজিল্যান্ডের পক্ষে ২১টি টেস্ট খেলেছেন, ওয়ানডে ৩১টি। প্রথম টেস্ট ১৯৭৬ সালে, ১৯৮৩ সালে শেষটি। রেকর্ড এমন কিছু নয় যে, দেখলেই চিনে ফেলতে হবে। চেনা উচিত ছিল অন্য কারণে। ১৯৯২ বিশ্বকাপে মার্টিন ক্রোর বিখ্যাত সেই নিউজিল্যান্ড দলের কোচ ছিলেন এই লিস। ব্যাটিংয়ের শুরুতে মার্ক গ্রেটব্যাচকে ইচ্ছামতো মারার লাইসেন্স দিয়ে আর অফ স্পিনার দীপক প্যাটেলকে দিয়ে বোলিং ওপেন করিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটের ব্যাকরণই বদলে দিয়েছিল যে দল।
দুটি ভাবনাই যে মার্টিন ক্রোর মস্তিষ্কপ্রসূত, সেটি স্বীকার করতে একটু দ্বিধা করলেন না। তবে কোচের সমর্থন তো লাগতই। লিস সোৎসাহে তা করেছেন। মার্টিন ক্রোর মৃত্যুটা এখনো মেনে নিতে পারেন না, ‘আমরা দুজন পুরো আলাদা চরিত্রের মানুষ। কিন্তু তিন বছরে আমাদের একবারও কোনো কিছু নিয়ে মতবিরোধ হয়নি।’ লম্বা সময় বাড়ির বাইরে থাকতে হয় বলে কোচিং থেকে সরে গেছেন খুব তাড়াতাড়িই। কমেন্ট্রিও করেন শুধু নিজের শহর ডানেডিনে খেলা হলেই।
৬৭ ছুঁই–ছুঁই ওয়ারেন লিসের কথাবার্তায় সবচেয়ে মন ছুঁয়ে গেল জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। ক্রিকেটের আধুনিক যুগ নিয়ে তাঁর আপত্তির জায়গা আছে, সেটির কারণও ওই মানসিকতাই, ‘আমরা যখন খেলতাম, দলের সবাই একটা পরিবারের মতো ছিলাম। এখন তো দেখি, ক্রিকেটাররা কানে হেডফোন লাগিয়ে যে যার জগতে ডুবে আছে।’ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নতির প্রসঙ্গে কথা বলার সময়ও পরিচয় মিলল তাঁর মুক্ত মনের, ‘বাংলাদেশ ভালো করতে শুরু করায় আমি খুশি হয়েছি। আমি যখন খেলি, তখন শ্রীলঙ্কা টেস্ট স্ট্যাটাস পেল আর যখন কোচ, তখন জিম্বাবুয়ে। শুরুতে ওদের নিয়েও অনেক বাজে কথা হয়েছে। অথচ শ্রীলঙ্কা দলে তখনই ভালো কিছু ক্রিকেটার ছিল। দুই রত্নায়েকে (রবি ও রুমেশ) দারুণ বোলার ছিল। এরপর এল অরবিন্দ ডি সিলভা। ওফ্, কী ব্যাটসম্যান! শ্রীলঙ্কানরা এত ফ্রেন্ডলি ছিল যে বিপক্ষে খেলার সময়ও ওদের সাফল্য কামনা করতে ইচ্ছা করত।’
লিস যদি ক্রিকেট কোচ হিসেবে পুরোনো যুগের প্রতিনিধি হন, সেটির একেবারে আধুনিক রূপের সঙ্গেও কথা হলো কিছুক্ষণ পরই। ইনি বেরিয়ে এসেছেন টেলিভিশন কমেন্ট্রি বক্স থেকে এবং তাঁকে না চেনার প্রশ্নই ওঠে না। নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম কোচ মাইক হেসন। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালেই আটকে যাওয়ার জাল ছিঁড়ে নিউজিল্যান্ডকে প্রথমবারের মতো ফাইনালে নিয়ে যাওয়া যাঁর মুকুটে উজ্জ্বলতম পালক। নিজেদের দেশে টেস্ট ক্রিকেটে অজেয় হয়ে ওঠাও তাঁর সময়েই। টানা চারটি গ্রীষ্মে দেশে কোনো সিরিজ হারেনি নিউজিল্যান্ড। মার্টিন ক্রোর সঙ্গে জুটি বেঁধে ওয়ারেন লিস যা করেছিলেন, ব্রেন্ডন ম্যাককালামের সঙ্গে হেসনের জুটি সেটিকেই নিয়ে গেছে আরেক ধাপ ওপরে। একসময়কার বিরক্তিকর নিউজিল্যান্ড দলের খেলার ধরনটাই বদলে দিয়ে রোমাঞ্চকর ক্রিকেটের বিজ্ঞাপনে পরিণত করেছেন নিউজিল্যান্ড দলকে। দুজনের রসায়নটা এমনই জমেছিল যে, ম্যাককালাম তাঁর দেখা সেরা কোচের স্বীকৃতিও দিয়ে দিয়েছেন হেসনকে।
ওয়ারেন লিসের মতো ডানেডিন হেসনেরও ঘরের মাঠ। এখানেই শুরু তাঁর কোচিং–রূপকথায়। মাত্র ২২ বছর বয়সে দায়িত্ব নিয়েছিলেন ওটাগো দলের। এত কম বয়সেই কোচিংয়ে আসার কারণটা এমনভাবে বললেন যেন চাইলেই কোচ হওয়া যায়! ‘শুধু খেলে যে টাকা পেতাম, তাতে আমার সংসার চলছিল না। এ কারণেই কোচিং শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। শুরুতে কিছুদিন কোচিং করানোর পাশাপাশি খেলেছিও। দুটি চালিয়ে যাওয়া কঠিন বলে পুরোদস্তুর কোচ হয়ে গেছি পরের বছর।’
২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত চুক্তি ছিল। বিশ্বকাপের এক বছর বাকি থাকতে নিজে থেকেই সরে দাঁড়িয়েছেন। এখানেও ওয়ারেন লিসের সঙ্গে মিল। নিজের বাড়ি আর পরিবারের বাইরে লম্বা সময় কাটাতে আর ভালো লাগছিল না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চাপটাও একটু দুর্বহ হয়ে উঠেছিল। এখন অনিয়মিত কমেন্ট্রি করেন, তবে কোচিং ছাড়েননি। গত অক্টোবরে আইপিএলের দল কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের সঙ্গে দুই বছরের চুক্তি হয়েছে। আপাতত আরও কিছুদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দূরে সরে থাকতে চান। ভবিষ্যতের কথা এখনো জানেন না।
ওয়ারেন লিসের মতো হেসনও বাংলাদেশে গেছেন। তবে দুজনের অভিজ্ঞতা পুরো বিপরীত। লিস যেখানে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা নিয়ে পঞ্চমুখ, হেসন বাংলাদেশকে মনে রেখেছেন ‘বিশ্বের সবচেয়ে বাজে অনুশীলন সুবিধা’র দেশ হিসেবে। ২০১৩ সালের বাংলাদেশ সফরে ওয়ানডেতে ৩–০ ম্যাচে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার সিরিজে মিরপুরে অনুশীলন করার অভিজ্ঞতা বলার সময়ও হেসনের চোখে–মুখে চরম বিরক্তি, ‘এমন উইকেটে আমাদের প্র্যাকটিস করতে দিয়েছিল, যেখানে বল পড়ে কোথায় যাবে, তার ঠিক নেই। আর নেট বোলাররা সব পাঁচ ফুট উচ্চতার। অথচ মাঠের অন্য পাশেই বাংলাদেশ দল ভালো উইকেটে প্র্যাকটিস করছিল।’
বাংলাদেশে বাংলাদেশ যে কঠিন এক প্রতিপক্ষ, সেটি তো নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছেন। দেশের বাইরেও বাংলাদেশের ভালো করার একটাই পূর্বশর্ত দেখেন হেসন—দলে ভালো একজন ফাস্ট বোলার।