বসার ঘরটায় একবার চোখ বোলালেই বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে একটা ছোট্ট ভ্রমণ হয়ে যাবে। মোহাম্মদ রফিকের খেলোয়াড়ি জীবনের স্মরণীয় সব মুহূর্তের ছবি, পুরস্কার, স্মারক সাজিয়ে রাখা ঘরজুড়ে। সে সব যতই দেখা হয়, ফেলে আসা অতীত ততই মূর্ত হয়ে ওঠে চোখের সামনে। কত ইতিহাসের সাক্ষী তিনি! হবেন না-ই বা কেন! এ দেশের ক্রিকেটের দুটি আলাদা সময়ের সেতুবন্ধনই যে তিনি!
জাতীয় দলের হয়ে যখন তাঁর অভিষেক তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে অনেক দূরেই বাংলাদেশের ক্রিকেট। ১৯৯৪ সালে কেনিয়ায় আইসিসি ট্রফিতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে জায়গা পাওয়া হয়নি বাংলাদেশের। দেশের ক্রিকেটে তখন এক ধরনের হতাশার সময়। জাতীয় দলেও বাজছে বদলের সুর। এমন একটি সময়ে ৯৪-এর ডিসেম্বরে দেশের মাটিতে সার্ক ক্রিকেট নামের একটি আমন্ত্রণমূলক প্রতিযোগিতা দিয়ে অভিষেক রফিকের। অভিষেকেই তিনি দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করলেন। সেই প্রতিযোগিতাতেই সৌরভ গাঙ্গুলি, প্রভীন আমরে, ভেঙ্কটেশ প্রসাদদের নিয়ে গঠিত ভারতীয় ‘এ’ দলের বিপক্ষে বাংলাদেশ পায় ঐতিহাসিক এক জয়। লিগ পর্বে শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলের বিপক্ষেও জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। দুটি জয়েই রফিকের ছিল অনন্য অবদান। বাঁ-হাতি স্পিনের সঙ্গে মারকুটে ব্যাটিংটাও যে রফিক ভালো করেন, সে প্রতিযোগিতায় দেশবাসী জেনেছিল তা-ও।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রফিকের অভিষেক শচীন টেন্ডুলকারের উইকেট পেয়ে—রফিকের অনেক অর্জনে ঢাকাই পড়ে গেছে ব্যাপারটি। ১৯৯৫ সালে শারজায় এশিয়া কাপে তাঁর অভিষেক। জীবনের প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে তাঁর বোলিং পরিসংখ্যানটি ছিল এমন, ‘৫-০-১৫-১।’ টেন্ডুলকারকে বোল্ড করে যে যাত্রা শুরু, এক যুগ পর ২০০৭ সালে হয়েছিল তার পরিপূর্ণ সমাপ্তি।
রফিক তাঁর ক্যারিয়ার নিয়ে দারুণ তৃপ্ত, ‘ক্যারিয়ার নিয়ে কোনো অতৃপ্তি নেই। যে সময়ে খেলেছি, এখনকার মতো এত অর্থ-উপার্জন কিংবা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ছিল না। তবুও যতটুকু খেলার সুযোগ পেয়েছি, মন থেকে খেলেছি। নিজের পুরোটা ঢেলে দিয়েছি।’
বাংলাদেশের ক্রিকেটকে উপহার দিয়েছেন বহু স্মরণীয় মুহূর্ত। এর মধ্যে এগিয়ে রাখেন কোনটি? রফিক ফিরিয়ে নিয়ে যান ১৮ বছর আগে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সেই স্বপ্ন বাঁকে, ‘১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জেতা ও বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করা খেলোয়াড়ি জীবনের সবচেয়ে সেরা মুহূর্ত। ওটা ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের টার্নিং পয়েন্ট। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের ক্রিকেট এ পর্যন্ত এসেছে কেবল ওই আইসিসি ট্রফির সাফল্যের কারণেই।’
>ক্যারিয়ার নিয়ে কোনো অতৃপ্তি নেই। যে সময়ে খেলেছি, এখনকার মতো এত অর্থ-উপার্জন কিংবা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ছিল না। তবুও যতটুকু খেলার সুযোগ পেয়েছি, মন থেকে খেলেছি। নিজের পুরোটা ঢেলে দিয়েছি।
দেশের প্রথম ওয়ানডে জয়ের নায়ক তিনি। ১৯৯৮ সালে হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত কেনিয়ার বিপক্ষে সেই ওয়ানডে, যেটিতে বাংলাদেশ পেয়েছিল প্রথম জয়। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে নেমে করেছিলেন ৭৭। হয়েছিলেন ম্যাচসেরাও। তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনাও হয়ে আছে এটা।
ক্রিকেটপ্রেমীরা ভুলে যাননি ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসের কথা। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২-২-এ সমতায় থাকা সিরিজের শেষ ম্যাচটিতে ওপেনিংয়ে নেমে করেছিলেন ৭২ রান। দল জিতেছিল ৮ উইকেটে। ২০০৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেন্ট লুসিয়া টেস্টে ১১১ রানের ইনিংসটা কি ভোলা যায়? মূলত বোলার হলেও ব্যাট হাতে রফিক কম উজ্জ্বল ছিলেন না, প্রমাণ এ ম্যাচগুলো। কিন্তু রফিকের মূল পরিচয়টা যে বোলিং দিয়েই। টেস্টে ও ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ১০০ উইকেট নেওয়ার কথা না বললে ‘রফিক-বৃত্তান্ত’ অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
বোলার হিসেবেই যেন রফিকের সব আত্মতৃপ্তি। ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘বাংলাদেশের অনেক বোলারই ভবিষ্যতে হয়তো ওয়ানডে বা টেস্টে ৩০০ বা ৪০০ উইকেট পাবে। তবে ইতিহাস ঘাঁটলে আমার কথাও বলতে হবে। বোলিংয়ে অনেক রেকর্ডই ভাঙা-গড়া হবে, কিন্তু প্রথম ১০০ উইকেট পাওয়া বোলারটার নাম রফিকই থাকবে।’ রফিককে অসম্ভব তৃপ্তি দেয় প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ খেলার গৌরব। টেস্টে উইকেট-সংখ্যা আরও বাড়তে পারত; আক্ষেপ করেই বললেন, `বেশিরভাগ সময় প্রতিপক্ষের এক ইনিংসে বোলিংয়ের সুযোগ পেয়েছি। নইলে উইকেট অারও বাড়তে পারত।'
২০০৩-এর মুলতান টেস্ট খুব মনে পড়ে। উমর গুলের প্রতি দেখানো তাঁর ঔদার্য আজও অালোচনার বিষয় ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে । অনেকে প্রশ্ন তোলেন, মহানুভবতা দেখিয়ে গুলকে রানআউট না করে রফিক কি ঠিক করেছিলেন? অনেকে আবার বলেন, খেলোয়াড়সুলভ মনোভাবের সর্বোচ্চ নিদর্শন ওটা। ওই ঘটনা রফিককে ক্রিকেট ইতিহাসেই আলাদা একটা জায়গা দেয়।
রফিকের কাছে প্রশ্ন ছিল সেই ঘটনা নিয়ে। অতীতে ফিরে যেতে ভীষণ অনীহা। তবে অস্বীকার করলেন না, ওই ম্যাচটি জিততে না পারার আক্ষেপ এখনো কাজ করে মনে। ওই টেস্টে আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্ত ভোলেননি আজও, ‘সবাই তো দেখেছে, কী হয়েছিল সেদিন। বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছিল। জয়-পরাজয় যা-ই হোক, মানুষের মনে এসব ব্যাপার থেকে যায়। কখনো ভোলা যায় না।’
ক্রিকেটকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানিয়েছেন বছর সাত হলো। ২০০৭ বিশ্বকাপ শেষে তাঁর বিদায় ছিল গৌরবের। কাউকে কোনো সুযোগ দেননি। কেউ বলতে পারেননি ‘রফিক আর চলে না।’ এমন গৌরবের বিদায়ই তাঁর ক্রিকেট জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া হয়ে আছে। ক্রিকেট থেকে পাওয়া মানুষের ভালোবাসাও কম নাকি! মানুষের ভালোবাসার ব্যাপারটি আপ্লুত করে দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা এ তারকাকে।
রফিকের এই মুহূর্তের ব্যস্ততা ব্যবসাকে কেন্দ্র করে । ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ততা যতই থাকুক, মন পড়ে থাকে ক্রিকেটেই। নিয়মিতই বাংলাদেশের খেলা দেখেন। ঘরোয়া ক্রিকেটের সঙ্গেও জড়িত। বিসিবি চাইলে কাজ করতে প্রস্তুত আরও বড় পরিসরে, ‘বেশ কিছুদিন ঘরোয়া ক্রিকেটে কাজ করা হয়নি। তবে ক্রিকেট থেকে দূরে নই। মাঝে বোর্ড থেকে একাডেমিতে কাজের কথা বলেছিল। আমাকে ও পাইলটকে (খালেদ মাসুদ) বলেছিল সেখানে যুক্ত হতে। এরপর আর কোনো কিছু জানানো হয়নি। তবে ক্রিকেট থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন নই। স্থানীয় ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত। বোর্ড থেকে সাড়া না পেলে স্বাভাবিকভাবেই অন্য ব্যস্ততায় জড়িয়ে যেতে হয়।’
ভবিষ্যতে নিজ এলাকা কেরানীগঞ্জে একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছেন। সে স্বপ্নের বাস্তবায়ন নির্ভর করছে অনেক ‘যদি’, ‘কিন্তু’র ওপর। তবু পিছিয়ে যেতে চান না স্বপ্ন থেকে। শূন্যে দৃষ্টি রেখে বললেন, ‘এখন সাকিবের মতো খেলোয়াড় আছে। ভবিষ্যতে তাঁর জায়গায় কে আসছে? খেলোয়াড় তৈরির প্রক্রিয়াটা চালু রাখতে হবে। যাতে কখনোই শূন্যতা তৈরি না হয়। যদি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করতে পারি, পূর্ণ মনোযোগ দেব সেখানে।’
আরও পড়ুন: