ক্রিকেটারদের আন্দোলন: যেভাবে শুরু, যেভাবে শেষ
>নিজেদের ন্যায্য দাবিতে এই প্রথম এক ছাতার নিচে বাংলাদেশের এত ক্রিকেটার। যা দেশের ক্রিকেটে থাকবে ঐতিহাসিক এক ঘটনা হয়ে।
বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান খুব সস্তা একটা পন্থা নিলেন। ক্রিকেটারদের ১১ দফা দাবিতে তিনি ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পেলেন। পরশু বিসিবির সংবাদ সম্মেলনে মুখ টিপে হেসে বলেছেন, ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ নাকি শিগগিরই উন্মোচিত হয়ে যাবে। কিন্তু খেয়াল করেননি, তাঁর হাস্যকর ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব¡শুনে মিটিমিটি হেসেছেন দেশের সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীরাও।
নাজমুল হাসানের ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব যে ওই বলা পর্যন্তই, সেটি বোঝা গেল কাল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের পর যখন বিসিবি ক্রিকেটারদের সব দাবি মেনে নিলেন এবং সেটি ষড়যন্ত্রকারীদের পাকড়াও না করেই! বিসিবি সভাপতি পরশু সংবাদ সম্মেলনে এ-ও বলেছিলেন, ক্রিকেটারদের উদ্দেশ্য দেশের ক্রিকেটের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা। তিনি যে ভাবমূর্তির কথা বললেন, মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে তা কিন্তু ক্রিকেটারদের হাতেই গড়া। নিজেদের কিছু মৌলিক দাবির কথা বলে কিনা সেটিকে তাঁরাই ক্ষুণ্ন করে ফেললেন! আর যদি তা-ই হবে, প্রকাশ্যে ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ তুলে মাত্র এক দিনের মধ্যে তাঁদের সব দাবি কীভাবে মেনে নেন দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ অভিভাবক?
আসলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আসন থেকে সাত বছর ধরেই চটকদার, মুখরোচক শব্দাবলি শুনে আসছে মানুষ। এগুলো তাই আর কোনো গুরুত্বই বহন করে না কারও কাছে। ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব ফেলে বরং ফিরে দেখা যাক কীভাবে শুরু হলো ক্রিকেটারদের ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলন, যেটি কাল সন্ধ্যায় রূপ নেয় ১৩ দফায়। কীভাবেই বা তা দেখল শেষ পরিণতি।
বিসিবি সভাপতি যেমন বলেছেন, আন্দোলনটা ক্রিকেটারদের দিয়ে কেউ করাচ্ছে, অনেকের আবার ধারণা, ধর্মঘটের ডাক খেলোয়াড়দের দীর্ঘদিনের আলোচনার ফসল। আসলে এর কোনোটিই নয়। এটা ঠিক যে নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে অনেক দিন ধরেই আলোচনা করছিলেন তাঁরা। সবাই একসঙ্গে হয়ে সেটি জানানোর উদ্যোগ নিয়ে এর আগে ব্যর্থও হয়েছেন। তবে ২১ অক্টোবর মিরপুরের একাডেমি মাঠের সংবাদ সম্মেলন এবং ধর্মঘটের ডাক মোটেও লম্বা প্রস্তুতির উপসংহার নয়। কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ তো নয়ই।
কথা ছিল সাকিব আল হাসান সিপিএল খেলে ১৬ অক্টোবর বাংলাদেশে ফিরলে ক্রিকেটাররা একসঙ্গে বসে এসব নিয়ে কথা বলবেন। সাকিবের আসতে একটু দেরি হওয়ায় একাডেমি মাঠে ক্রিকেটারদের জমায়েতটাও হয় সম্ভাব্য তারিখের তিন-চার দিন পর। আন্দোলনের পুরোভাগে থাকাদের একজনের কথা, ‘এটা ঠিক, যেদিন আমাদের একসঙ্গে হওয়ার কথা ছিল, হয়েছি তার তিন-চার দিন পর। তবে বিশ্বাস করুন, সংবাদ সম্মেলনটা আমরা ঘণ্টা দুয়েক সময়ের ব্যবধানে করলেও তার ১০ মিনিট আগেও ঠিক ছিল না ধর্মঘট হবে। হুট করেই এটা সবার মাথায় আসে এবং আমরা করে ফেলি।’ আর ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব? আন্দোলনের পেছনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন দেখা! ওই ক্রিকেটার হেসে বলেন, ‘একদম ফালতু কথা। আমরা ছাড়া এর সঙ্গে আর কেউ নেই। এটা শুধু ক্রিকেটারদের আন্দোলন।’
সেই আন্দোলনে মাশরাফি বিন মুর্তজা নেই কেন, এটা বিরাট প্রশ্ন। ক্রিকেটাঙ্গন ছাপিয়ে মাশরাফি এখন গণমানুষের নেতা। খুব কি ভালো হতো না ক্রিকেটারদের আন্দোলনের নেতৃত্বে তাঁকেও রাখলে? মাশরাফির পরিবর্তে আন্দোলনের পুরোধা যাঁকে করা হলো, সাধারণ ক্রিকেটারদের মধ্যে তো সেই সাকিব আল হাসানের জনপ্রিয়তা কম বলেই প্রচার! মজার ব্যাপার হলো, এই আন্দোলনের সুবাদে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাশরাফি-সাকিবের চেহারা দুটোকেও যেন অন্যভাবে দেখলেন ক্রিকেটাররা। মাশরাফিকে এখন আর তাঁরা নিজেদের নেতা মনে করছেন না। নতুন নেতা সাকিব আল হাসান।
মাশরাফিকে কেন আন্দোলনে নেওয়া হলো না, এমন প্রশ্নে জাতীয় দলের ওয়ানডে অধিনায়কের ঘনিষ্ঠরা বলেছেন, সাংসদ মাশরাফিকে সাধারণ ক্রিকেটাররা পুরোপুরি আস্থায় নিতে পারেননি। তাঁদের শঙ্কা ছিল, আন্দোলনে মাশরাফির উপস্থিতি সবকিছু গুবলেট করে দিতে পারে। তা ছাড়া মাশরাফির এখন যে অবস্থান, সেখান থেকে তিনি হয়তো চাইলেও ক্রিকেটারদের পক্ষে খুব বেশি কিছু করতে পারবেন না। মাশরাফি অবশ্য ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে ক্রিকেটারদের আন্দোলনে একাত্মতাই প্রকাশ করেছেন।
বিসিবি যে ১১ দফা দাবি মেনে নেবে, সেটি ক্রিকেটাররা শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলেন। তবে তাঁরা চেয়েছেন, শুধু মুখে মুখে না বলে দাবিগুলো কাগজে-কলমে মানা হোক। আইন করে প্রতিষ্ঠা করা হোক। বিসিবি সভাপতির দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণার পরও তাই খেলোয়াড়েরা একটু সময় নিলেন। যেন নতুন বোলারের বল বুঝে খেলার চেষ্টা! সন্ধ্যায় একজন আইনজীবীকে মুখপাত্র বানিয়ে তাঁর মুখ দিয়েই জানানো হলো নতুন দুটি দাবির কথা এবং পুরোনো দাবিগুলোর ব্যাখ্যা। নতুন দাবির প্রথমটি, বোর্ডের রাজস্ব আয়ের ন্যায্য ভাগ চান ক্রিকেটাররা। দ্বিতীয়ত, সাকিব-তামিম-মুশফিকেরা নিজেদের জন্য যেসব দাবি উত্থাপন করেছেন, সেসব বাস্তবায়ন করতে হবে নারী ক্রিকেটারদের জন্যও।
পরশুর সংবাদ সম্মেলনে বোর্ড সভাপতির কিছু কথা ক্রিকেটারদের বেশ আহত করেছে। কার খালা, কার বাবা, কার ভাইয়ের জন্য কবে তিনি কী করেছেন, নাজমুল হাসান সেসব সবিস্তারে বলেছেন ক্যামেরার সামনে। যেগুলো পুরো মনে আসছিল না, পাশে বসা বোর্ড পরিচালকদের জিজ্ঞেস করে সেগুলো মনে করছিলেন আর বলছিলেন। সংবাদ সম্মেলনের মঞ্চে উপবিষ্টদের শরীরী ভাষায় মনে হচ্ছিল, তাঁরা যেন যুদ্ধে নামার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। অথচ ক্রিকেটাররা বিসিবির কারও প্রতি অসম্মান প্রদর্শন না করেই তাঁদের মৌলিক দাবি আদায়ে ধর্মঘটে নেমেছিলেন।
অবশ্য সভাপতির এত কথার পরও মনের ক্ষোভটা বাইরে আনেননি কোনো খেলোয়াড়। কাল একজন উল্টো হেসে বলেছেন, ‘এতে প্রমাণিত হয় আইনকানুন না মেনে তাঁরা কাছের মানুষদের জন্য কী পরিমাণ তদবির করেন।’ আরেকজনের কথা, ‘উনি বলেছেন বিমানবন্দরে দাঁড়িয়েই নাকি একবার ক্রিকেটারদের বেতন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বোর্ড সভার অনুমোদন ছাড়া এটা কি সভাপতি পারেন!’ ২৪ কোটি টাকা খেলোয়াড়দের বোনাস দেওয়ার একটা দাবি করেছেন সভাপতি। অথচ এই টাকার বেশির ভাগটাই আইসিসি টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ ফি, বোনাস যৎসামান্যই। সভাপতির কথা থেকে এ রকম মজার আরও অনেক রসদই খুঁজে পেয়েছেন খেলোয়াড়েরা।
কাল রাতে আন্দোলনটা যে শেষ পর্যন্ত সফল পরিণতির দিকে গেল, সেটির সবচেয়ে বড় কারণ ক্রিকেটারদের একতাবদ্ধ মনোভাব এবং লক্ষ্যে অটুট থাকা। কারও কথার তির যেমন তাঁদের ঘায়েল করতে পারেনি, দৃঢ়সংকল্প আর ঐক্য থেকে টলাতে পারেনি ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে ফেলে মানসিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টাও।
মাঠের ক্রিকেটেও এই সংকল্প, এই টিম স্পিরিটটাই দেখান বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।