ইংল্যান্ডের মূল ভরসা যখন অ-ইংলিশ!
কেভিন পিটারসেন অধিনায়ক থাকার সময় সাংবাদিকদের কতটা ঝামেলা পোহাতে হতো, কল্পনা করে নিতে কষ্ট হচ্ছে না। ইংল্যান্ড দলের অধিনায়ক, কিন্তু লেখার জো নেই—ইংলিশ অধিনায়ক পিটারসেন! এউইন মরগানের বেলাতেও একই কথা খাটে। ইংল্যান্ড দলের অধিনায়ক একজন আইরিশ—বাক্যটার শেষে আসলে বিঘত আকারের কিছু বিস্ময়চিহ্ন বসাতে হয়। ইংলিশ-আইরিশদের শত্রুতার ইতিহাস কে না জানে! এমন একজন আইরিশকে দিয়েই ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯ ট্রফি হাতে তোলার স্বপ্ন বুনছে ইংলিশরা!
শুধু মরগান? এই দলের অন্ততপক্ষে পাঁচজন ক্রিকেটার আছেন, যাদের জন্মটা যুক্তরাজ্যে নয়।
১. বেন স্টোকস
প্রথম ম্যাচের ম্যান অব দ্য ম্যাচ বেন স্টোকসের কথাই ধরুন। ৮৯ রান, দুই উইকেট, এক রানআউট আর অবিশ্বাস্য এক ক্যাচে, বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচকে পুরোপুরি নিজের করে নিয়েছিলেন এই অলরাউন্ডার। অথচ কিছুটা এদিক-ওদিক হলেই পারফরমেন্সটা হতে পারত নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দলের হয়ে।
বেন স্টোকসের জন্ম আর শৈশবের পুরোটাই কেটেছে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে। খেলাধুলাটাও মিশে ছিল রক্তে। বাবা জেরার্ড স্টোকস ছিলেন পেশাদার রাগবি প্লেয়ার, নিউজিল্যান্ডের হয়ে রাগবির টেস্ট ম্যাচও খেলেছিলেন একটি। অবশ্য খেলোয়াড় হিসেবে যতটা, তার চেয়েও বেশি নাম কুড়িয়েছিলেন কোচ হিসেবে। নানা জায়গায় কোচিং করিয়ে ডাক পেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের ওয়ার্কিংটন টাউন রাগবি লিগ ক্লাবের কোচ হতে। সে ডাকে সাড়া দিয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান জেরার্ড, সঙ্গে পুরো পরিবার। ফলাফল হিসেবে নিউজিল্যান্ডের বেন স্টোকস হয়ে যান ইংল্যান্ডের।
২. জেসন রয়
একই পথের পথিক হয়েছিলেন ওপেনার জেসন রয়ও। তিনি অবশ্য এসেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। জেসন রয়ের বয়স তখন সবে দশ। দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান থেকে তার পরিবার দেশান্তরি হয় ইংল্যান্ডের সারের উদ্দেশে। সেই থেকে আছেন এখানেই। জেসন রয়ের ক্রিকেট ক্যারিয়ারও শুরু হয়েছিল সারের হয়েই। সারের বয়সভিত্তিক দল পেরিয়ে এখন তো জায়গা করে নিয়েছেন ইংল্যান্ড দলেই। অবশ্য ইংল্যান্ড দলে প্রোটিয়া ক্রিকেটারদের আধিক্য চোখে পড়ার মতোই।
৩. টম কারেন
ইনিও দক্ষিণ আফ্রিকান। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম শ্রেণির এক ক্রিকেট দলের হয়ে খেলেছেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও। অবশ্য পিতাকে অনুসরণ করলে বেছে নিতে হতো জিম্বাবুয়েকে। জিম্বাবুয়ের প্রথম বিশ্বকাপের স্বপ্নসারথিদের একজন ছিলেন টমের পিতা কেভিন কারেন। শেষমেশ অবশ্য দু দলের কোনোটিই নয়, জাতীয় দল হিসেবে টম কারেন বেছে নিয়েছেন ইংল্যান্ডকে। স্কুল ক্রিকেট খেলার সময়ে সারের সাবেক অধিনায়ক ইয়ান গ্রেগের নজর কেড়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন সারের দ্বিতীয় দলে। সেসময়েই কলেজ বদলে ইংল্যান্ডের ওয়েলিংটন কলেজে চলে আসেন টম।
সেই যে এলেন, এরপরে ইংল্যান্ডকেই বানিয়ে ফেলেছেন ঘরবাড়ি। ২০১৫ সালে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে জাতীয় দলেও জায়গা বাগিয়ে নিয়েছেন বছর দু-একের মাঝে। এবার তো খেলছেন বিশ্বকাপেই।
৪. জফরা আর্চার
বিশ্বকাপের দলে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ছিল গোটা ইংল্যান্ড ক্রিকেট। ক্রিস ওকস, লিয়াম প্লাঙ্কেট, ডেভিড উইলিরা চাননি এত দ্রুতই জাতীয় দলে অন্তত এই সময়ে তাঁকে দেওয়া হোক। আবার মাইকেল ভনের মতো সাবেকেরা চেয়েছিলেন, আর্চারকে নেওয়া হোক বিশ্বকাপেই।
ইংল্যান্ডের নাগরিক হওয়ার যে যোগ্যতা, সেই যোগ্যতা অর্জন করেছেন বিশ্বকাপ শুরুর মাসখানেক আগে। জন্মসূত্রে তিনি যে বার্বাডিয়ান।
এমনকি ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন তিন ম্যাচে, বাংলাদেশের বিপক্ষে। ২০১৩ সালের সেই সিরিজে খেলতে গিয়ে পড়েছিলেন ভয়াবহ পিঠের ইনজুরিতে, ফলাফল হিসেবে ছিটকে গিয়েছিলেন বার্বাডোজের ক্রিকেট সিস্টেম থেকে।
বদলে, আরেক বার্বাডিয়ান ক্রিকেটার ক্রিস জর্ডানের সাহায্যে জায়গা করে নিয়েছিলেন সাসেক্সের দ্বিতীয় দলে। এর পর কখনো পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের ঘোল খাইয়ে, কখনো রয়্যাল লন্ডন কাপে সমারসেটের বিপক্ষে পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে, এক কাউন্টি মৌসুমে ২৫ গড়ে ৬১ উইকেট দখল করে, আইপিএল-বিপিএল কাঁপিয়ে জায়গা করে নিলেন এবারের ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ দলে।
বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই ৩ উইকেট তুলে নেওয়ার পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হাহাকারও একটু বাড়িয়েছেন নিশ্চয়ই!
৫. এউইন মরগান
ইংল্যান্ড অধিনায়ক এউইন মরগান আগে খেলেছেন আয়ারল্যান্ডের হয়ে। আয়ারল্যান্ডের বয়সভিত্তিক সব দল পেরিয়ে আয়ারল্যান্ড জাতীয় দলে জায়গা পেয়েছিলেন ২০০৬ সালের শেষার্ধে। তার চেয়ে কম বয়সে আয়ারল্যান্ডের জাতীয় দলে খেলেননি আর কেউ। অভিষেক ম্যাচেই ৯৯ রানের এক ইনিংসে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সামর্থ্য আইরিশ ক্রিকেটের ছোট্ট গণ্ডির চেয়েও অনেক বড়। তখনো যে আয়ারল্যান্ড টেস্ট ক্রিকেটের কুলীন জগতেই পা রাখতে পারেনি।
বুঝতে পেরেছিলেন তিনি নিজেও। এমনকি এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন ১৩ বছর বয়সেই।
আয়ারল্যান্ডের হয়ে ক্যারিয়ার মাত্র ২৩ ওয়ানডে ম্যাচে থামিয়ে দিয়ে ছুটতে শুরু করেছিলেন ইংল্যান্ড দলে সুযোগ করে নিতে। পারফরমেন্স প্রোগ্রাম, ইংল্যান্ড লায়ন্সের দল পেরিয়ে ২০০৯ সালে জায়গা করে নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের মূল দলে। সেই থেকে খেলে যাচ্ছেন ইংল্যান্ডের হয়ে, ২০১৪ থেকে তো ওয়ানডে দলের অধিনায়ক। বিশ্বকাপ জেতাতে পারলে মরগানই পারবে—এই বিশ্বকাপ থেকেই গত আসরে ভরাডুবির পরও আস্থা হারায়নি ইংল্যান্ড। এবার সেই আস্থার প্রতিদান আইরিশ মরগান দিতে পারেন কি না, সেটাই দেখার।