বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম দ্বিশতক হাঁকানো ব্যাটসম্যান তিনি। পাঁচ হাজার রানের মাইলফলকেও প্রথম উঠে গেল মুশফিকুর রহিমের নাম। তবে দুটি ক্ষেত্রেই কী একটা অবিশ্বাস্য মিল! দুবারই প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা—এই মিল তো আছেই, তার চেয়েও বড় মিল মাইলফলকে মুশফিকের প্রথম হওয়ার ধরনে। মুশফিকের আগে তাঁর আরেক সতীর্থ মাইলফলকের দৌড়ে এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু দুবারই শেষ পর্যন্ত কোনো না কোনো কারণে ওই সতীর্থের রেকর্ড না হয়ে হলো মুশফিকের।
ভাগ্য? হয়তো। তবে মুশফিক সেটি মানতে নারাজ। চট্টগ্রামে আজ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্টের দ্বিতীয় দিনে পাঁচ হাজারের মাইলফলকে যাওয়ার পর মুশফিককে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলো ভাগ্য নিয়ে। উত্তরে কপাল দেখিয়ে মুশফিক মনে করিয়ে দিলেন, ভাগ্য যদি থেকেও থাকে, সেটির পেছনে অবদান তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমেরই।
পাশাপাশি তামিম ইকবালকে নাটকীয়ভাবে পেরিয়ে ৫ হাজারের তালিকায় প্রথম বাংলাদেশি হওয়ার পর তামিমের সঙ্গে তাঁর কী কথা হয়েছে, সেটিও জানিয়েছেন মুশফিক।
আমি যখন সকালে অনুশীলনে আসি, আপনারা সবাই তখন ঘুমিয়ে থাকেন। আল্লাহ তো সবই দেখেন
তামিম আর মুশফিক—দুজনই ৫ হাজার রানের মাইলফলকের হাতছানি নিয়ে টেস্টটা শুরু করেছিলেন। মুশফিকের আগে তামিমেরই রেকর্ডটা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু প্রচণ্ড গরমে পানিশূন্যতা আর ক্লান্তিতে পেশিতে টান পড়ে তামিমের। ৫ হাজার থেকে ১৫২ রান দূরে থেকে ব্যাটিংয়ে নামা তামিম যখন ১৩৩ রানে আহত অবসরে যান, মুশফিক তখন ব্যাট করছিলেন ১৪ রানে—৫০০০ থেকে তখনো ৫৪ রান দূরে তিনি।
শেষ পর্যন্ত ড্রেসিংরুমে বসেই মুশফিককে ৫ হাজারের মাইলফলকে যেতে দেখেন তামিম। ড্রেসিংরুম থেকে তাঁর মুশফিককে অভিবাদন জানানো দেখে মোটেও মনে হলো না, এ নিয়ে তাঁর খেদ আছে। পরে দুজনের কী কথা হয়েছে? সংবাদ সম্মেলনে মুশফিকের উত্তর, ‘কথা হবে না কেন! ওরই তো সব (পরিসংখ্যান) জানা, কার যে কখন কী হয়! ও কাছাকাছি ছিল, এ কারণে বলল, ‘আমারটা হলো না, তোরটা হলো।’ অভিনন্দন জানিয়েছে।
এবার তামিমকে পেরিয়ে ৫ হাজারের মাইলফলকে গেলেন, এর আগে ২০১৩ সালে গল টেস্টে মুশফিকের প্রথম দ্বিশতকের গল্পটা একই রকম। তৃতীয় দিন শেষে মোহাম্মদ আশরাফুল ব্যাট করছিলেন ১৯০ রানে, মুশফিকের রান ছিল ১৫২। কিন্তু চতুর্থ দিন সকালে আশরাফুল ১ রান যোগ করেই আউট, সে সুযোগে মুশফিক হয়ে গেলেন বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে প্রথম দ্বিশতক হাঁকানো ব্যাটসম্যান।
ভাগ্য? বলতে পারেন, তবে সেখানেও কথা থাকে। দুবারই সতীর্থের হয়নি কোনো না কোনো কারণে—আশরাফুল আউট হয়ে গেছেন, তামিম পড়েছেন চোটে। কিন্তু এরপর সুযোগটা নেওয়ার দক্ষতা তো মুশফিকের ছিল।
সে কারণেই কি না, দুবারই ভাগ্য তাঁকে সাহায্য করেছে কি না—আজ সংবাদ সম্মেলনে এমন প্রশ্নে মুশফিক প্রথমে বলেন, ‘এটা আমি সব সময় মনে করি যে আপনি নিজে যেটা করেন, সেটা আপনার সতীর্থ, ভাই, বন্ধু যদি সেটা অর্জন করে সেটার অনুভূতিটা অন্য রকম। আমার ডাবল হান্ড্রেডের পর আমার রেকর্ড কিন্তু ভেঙেছিল ও-ই। স্বাভাবিক, রেকর্ড হয়ই ভাঙার জন্য। ও-ই তখন আবার আমাকে বলেছিল যে দুই-তিন বছরের মধ্যে তুই-ই আবার আমারটা ভাঙবি। এটা একটা স্বাস্থ্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা।’
এরপর ভাগ্য নিয়ে তাঁর কথা, ‘আর যেটা বললেন, লাকি...এই যে কপালটা দেখছেন...(পবিত্র কোরআন শরিফের আয়াত উদ্ধৃত করে) আমি যখন সকালে অনুশীলনে আসি, আপনারা সবাই তখন ঘুমিয়ে থাকেন। আল্লাহ তো সবই দেখেন।’
তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে এই মাইলফলক আরও অনেকেই ছাড়িয়ে যাবেন, এমনই আশা মুশফিকের। দারুণ কীর্তিতে অনুভূতি জানাতে গিয়ে তা-ই বললেন, ‘খুবই ভালো লাগছে যে বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে পাঁচ হাজার রান করেছি। তবে আমি মনে করি এটাই শেষ না। ইনশা আল্লাহ আরও অনেকেই করবে, অনেক খেলোয়াড়ই আছে সেটা করার মতো। শুধু সিনিয়রদের কথাই বলছি না, জুনিয়ররাও আছে। আশা করি ভবিষ্যতে একটা সময় দেখতে পাব ওরাও একটা সময় ৮ হাজার, ১০ হাজার রান করবে।’
দ্বিশতকের পর প্রথম পাঁচ হাজার রানের মাইলফলকে যাওয়া মুশফিককে যখন প্রশ্ন হলো, এ থেকে দেশের ক্রিকেটে কোন ধরনের লিগ্যাসি দেখতে চাইবেন, তাতেও আবার একই সুর মুশফিকের, ‘ড্রেসিংরুমে আমাদের ম্যানেজার নাফিস ভাই (নাফিস ইকবাল) কেক কাটার ব্যবস্থা রেখেছিলেন পাঁচ হাজারের জন্য। সেখানে জয়কে (মাহমুদুল হাসান) কেক খাইয়েছি, তখন ওকে বলেছি, তুই এখন দলের সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান, ১০ হাজার রানের সময় আশা করি তুই এভাবে আরেকজনকে খাওয়াবি। এটাই চাই যে আমরা যেখানে ছেড়ে যাব, ওরা যেন সেটাকে দ্বিগুণ করে নেয়। তাহলেই বাংলাদেশ ক্রিকেট এগিয়ে যাবে।’
তবে সবকিছুর মধ্যেও একটু অভিমানও থেকে গেল মুশফিকের। লিগ্যাসি, দেশের ক্রিকেটে কী দেখতে চান...সে প্রশ্নেই সেটি টের পাওয়া গেল, ‘কিছু চাওয়া-পাওয়ার তেমন কিছু নাই। আমার যেটা মনে হয় যে বাংলাদেশে আসলে অভিজ্ঞতার কোনো দাম নাই। ১৭ বছর যে খেলতে পেরেছি সেটাই আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার। সামনে আল্লাহ যতটুকু রেখেছেন, ততটুকুই যেন করতে পারি।’