বিপিএল কেমন হওয়ার কথা ছিল, কেমন হচ্ছে
১৬ দিনে শেষ ২০ ম্যাচ। ঢাকা থেকে সিলেট হয়ে বিপিএল এখন চট্টগ্রামে। আগামীকাল জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে শুরু হবে চট্টগ্রাম পর্ব। এর আগে এই ১৬ দিনের ২০ ম্যাচে কেমন হলো বিপিএল?
মাঠের খেলা জমজমাট হয়েছে, সন্দেহ নেই। টি–টোয়েন্টির প্রাণই হলো রান। এবার বেশির ভাগ ম্যাচেই দুই শর কাছাকাছি রান হচ্ছে, দুই শর বেশি রান উঠেছে আট ইনিংসে। বড় লক্ষ্য তাড়া করে জেতার ম্যাচ হচ্ছে। অনেক ম্যাচেই লড়াই হয়েছে শেষ পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত বিপিএল সেঞ্চুরিও দেখে ফেলেছে ৫টি। গ্যালারিতে দর্শক থাকছেন। টিকিট নিয়ে শুরুর দিকে যে বিশৃঙ্খলা ছিল, সেটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
রানের প্রসঙ্গ যখন এল, মনে করিয়ে দেওয়া ভালো যে এবার বিপিএলের বাউন্ডারি দেখা যাচ্ছে তুলনামূলক ছোট। রান বেশি হওয়ার এটা একটা কারণ তো অবশ্যই।
বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্যসচিব নাজমূল আবেদীন বিষয়টি মেনে নিয়ে ‘বাউন্ডারি আরও বড় হতে পারত’ বলেও যুক্তি দিয়েছেন, ‘যে রকম বড় বড় ছয় হচ্ছে, বাউন্ডারি স্বাভাবিক হলেও ছয় খুব কম হতো না। যেসব ক্ষেত্রে বাউন্ডারি কমানো হয়েছে, অনেক বেশি যে কমানো হয়েছে, তা–ও নয়। হয়তো কোথাও ৬৫ মিটারের জায়গায় ৬২–৬৩ মিটার হয়েছে। আবার কোথাও ঠিক আছে।’
রান বেশি হওয়ার পেছনে ছোট বাউন্ডারির তুলনায় ভালো উইকেটের ভূমিকাই বেশি দেখেন নাজমূল, ‘স্বীকার করতেই হবে, উইকেট এবার অনেক ভালো। যে কারণে বড় রান হচ্ছে, বড় রান তাড়া করতে গিয়েও ব্যাটসম্যানরা শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে পারছে। আগে থেকে ম্যাচ ছেড়ে দিচ্ছে না।’
রান–উইকেট–মাঠ–দর্শকের বাইরে বিপিএলের চৌহদ্দি অবশ্য আরেকটু বড়। ভালোয় মন্দে মেশানো হলেও বাংলাদেশের একমাত্র ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টটিকে মাপার আরও নিক্তি আছে। টুর্নামেন্টে কারা খেলছেন, এটাকে ঘিরে সার্বিক আয়োজনটা কেমন—এসবও গুরুত্বপূর্ণ। আগের আসরগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে এ রকম কিছু মানদণ্ডে এবারের বিপিএল আসলে একটু পিছিয়েই আছে।
প্রথমত, যে টুর্নামেন্টের খেলোয়াড় তালিকায় পূর্বসুরি হিসেবে জ্বলজ্বল করে ক্রিস গেইল, শহীদ আফ্রিদি, ডোয়াইন ব্রাভো, কাইরন পোলার্ড, আন্দ্রে রাসেল, সুনীল নারাইন, শেন ওয়াটসন, ডেভিড ওয়ার্নার, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, এবি ডি ভিলিয়ার্স, কুমার সাঙ্গাকারা, স্টিভ স্মিথের মতো বিশ্ব তারকাদের নাম; সেই টুর্নামেন্টে এবার বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবে কারা খেলছেন? রংপুর রাইডার্সের অ্যালেক্স হেলস, ফরচুন বরিশালের শাহিন শাহ আফ্রিদি, কাইল মায়ার্স—এমন কয়েকটি নাম ছাড়া আর কার কথা বলা যায়? তা–ও এরই মধ্যে প্রতিশ্রুত ম্যাচগুলো খেলে চলে গেছেন এই ক্রিকেটাররা।
রান উৎসবে ভাসতে থাকলেও বিপিএলটা তাই এবার তারার আলোয় আলোকিত হতে পারেনি। এবারের বিপিএল যেন দ্বিতীয়–তৃতীয় সারির বিদেশিদেরই মেলা! অখ্যাত সব ক্রিকেটারের খেলার ধরন–ধারণও প্রশ্নসাপেক্ষ। এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে কোনো অভিযোগ না এলেও সন্দেহ জাগানোর মতো অনেক কিছুই হয়েছে। বিদেশিদের সঙ্গে অবশ্য স্থানীয় ক্রিকেটারদের নামও আসবে এতে। টুর্নামেন্টে চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো ওয়াইড আর নো বলগুলো নিয়ে বসলেই তদন্তের যথেষ্ট উপকরণ পেতে পারে বিসিবির দুর্নীতি দমন ইউনিট।
বিসিবি অবশ্য এ প্রসঙ্গে এখনই মন্তব্য করার মতো অবস্থায় নেই। তবে তারকাহীন বিপিএল প্রসঙ্গে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্যসচিব নাজমূল আবেদীন বলেছেন, ‘আর্থিক সংকটের কারণে খেলোয়াড় ড্রাফটে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিকের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। বড় তারকাদের তাই রাখা যায়নি ড্রাফটে।’ নাজমূল আবেদীনের চোখে এর একটা ইতিবাচক দিক, ‘বড় বড় বিদেশি ক্রিকেটার না থাকার সুযোগটা আমাদের ক্রিকেটাররা পাচ্ছে। তারা দলকে জেতানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ রকম বেশ কয়েকজন স্থানীয় ক্রিকেটার আমার চোখে পড়েছে। এমনকি খারাপ খেলতে থাকা ঢাকা ক্যাপিটালসেও সে রকম ক্রিকেটার আছে।’
তবে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো চাইলে ড্রাফটের বাইরে থেকেও সরাসরি চুক্তিতে খেলোয়াড় নিতে পারে। সেখানে পারিশ্রমিকের কোনো সীমা নেই। বড় তারকারা বিপিএলে সব সময় সেভাবেই এসেছেন। এবার যে সে রকম কেউ আসছেন না, সে ব্যাপারে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর ব্যাখ্যা প্রায় একই রকম। যার সারমর্ম, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে পৃষ্ঠপোষকেরা খুব বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে এগিয়ে আসছেন না। আবার বড় খেলোয়াড়েরা ‘ফ্রি’ও নেই। চাইলেও তাদের আনা যাচ্ছে না। সব মিলিয়েই এ পরিস্থিতি। তবে দুটি ফ্র্যাঞ্চাইজি জানিয়েছে, প্লে–অফে যেতে পারলে তারা বড় ক্রিকেটার আনতে চেষ্টা করবে।
দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবারের বিপিএলকে শুরু থেকেই বলা হচ্ছে ‘নতুন’ বা ‘অন্য রকম’ বিপিএল। এর থিম সংয়ে যেমন খোদ প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া দুটি লাইন আছে, তেমনি মাসকট থেকে শুরু করে টুর্নামেন্ট শুরুর আগে হওয়া ‘বিপিএল মিউজিক ফেস্ট’ও হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চেতনাকে ধারণ করে। গ্যালারিতে আবু সাঈদ স্ট্যান্ড করা হয়েছে, দর্শককে বিনা মূল্যে পানি দিতে থাকছে ‘মুগ্ধ কর্নার’।
কিন্তু বিপিএলের মতো বড় আসরে এসব খুব যে চোখে পড়ছে, তা নয়। যে রকম ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘অন্য রকম’ বিপিএলের স্লোগান তোলা হয়েছিল, সেই ‘অন্য রকম’ কিছু এখনো চোখে পড়েনি। একাদশ বিপিএলে সবচেয়ে বড় যে চমকটা দেখানোর প্রতিশ্রুতি ছিল, সেটা হলো টুর্নামেন্ট উপলক্ষে আমন্ত্রিত অতিথি করে আনা হবে বৈশ্বিক কোনো তারকাকে। হতে পারেন তিনি খেলার বা অন্য কোনো জগতের সেলিব্রেটি। কিন্তু এখন আর এ নিয়ে আর কোনো সাড়াশব্দ নেই।
এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলতে পারেননি গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্যসচিবও, ‘বিপিএলের সব পরিকল্পনা কিন্তু বিসিবির নয়। এখানে অন্য অনেকেই সম্পৃক্ত। কেন এলেন না বা এখনো যে সময় আছে তার মধ্যে বড় কেউ আসবেন কি না, এ ব্যাপারে তারাই ভালো বলতে পারবে।’
তবে নাজমূলের দাবি, বিপিএলকে ঘিরে ‘তারুণ্যের উৎসবের’ অংশ হিসেবে সারা দেশে অনেক কিছুই হচ্ছে, যার সব হয়তো বিপিএলে দেখা যাচ্ছে না, ‘১০–১১টি মন্ত্রণালয় এখানে সম্পৃক্ত। অন্য কিছু ক্রীড়া ফেডারেশনও আছে। বিপিএল উপলক্ষে তারুণ্যের উৎসবের অংশ হিসেবে তারা তাদের মতো করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। সব কিছুর প্রতিফলন যে বিপিএলের মাঠে থাকতে হবে, তা নয়।’