পাকিস্তানের ক্রিকেট: কে গেলেন, কে এলেন সেই হিসাব রাখা সত্যিই কঠিন
চোট? উইজডেন জানিয়েছে, পাকিস্তান টিম ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলা হয়নি। পাকিস্তানের সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন, বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে মোহাম্মদ রিজওয়ানকে। হোবার্টে আজ তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে তাই পাকিস্তানের অধিনায়কত্ব করেন সালমান আগা। কী কাকতাল! আজই জানা গেল, জেসন গিলেস্পিকে সরিয়ে সাদা বলে পাকিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হতে যাচ্ছেন আকিব জাভেদ।
পাকিস্তানের ক্রিকেটকে বোঝাতে সক্রেটিস-পূর্ব গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাসের আশ্রয় নিতে হয়। মনীষী বলেছিলেন, ‘জীবনে একমাত্র ধ্রুবক হলো পরিবর্তন, যা কখনো পরিবর্তন হয় না।’ পাকিস্তান ক্রিকেটও কি তেমন নয়?
পরিবর্তন যেন পাকিস্তান ক্রিকেটের মজ্জাগত। বোর্ডের সংবাদ সম্মেলনে কিংবা কর্তারা এমনিতে বলেন, পাকিস্তান ক্রিকেটে স্থিতি ফিরিয়ে আনা হচ্ছে কিংবা হবে। এসব নিয়ে নানা পদের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। কিন্তু দিন শেষে যে লাউ সেই কদু। আজ অমুক আছে তো কাল নেই! পাকিস্তান ক্রিকেটে পরিবর্তনের বাজনায় সবার ভাবনা যেন একটাই, বাজনা থামলে বসব কোথায়! আজ আছে কিন্তু কাল চেয়ারটা না–ও থাকতে পারে! এই যে পরিবর্তনের ধারা, সেটা কখনো না পাল্টানোই সম্ভবত পাকিস্তান ক্রিকেটের একমাত্র ধ্রুবক।
পরিবর্তনকে পাকিস্তান ক্রিকেটের বুকে আগলে রাখার (বদ) অভ্যাসেরই সর্বশেষ শিকার অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি গিলেস্পি। মজার ব্যাপার হলো, তাঁর জায়গায় সাদা বলের সংস্করণে যিনি অধিষ্ঠিত হচ্ছেন, সেই আকিব জাভেদ কিন্তু পিসিবির প্রথম পছন্দ ছিলেন না। ভাবনায় ছিলেন সাকলায়েন মুশতাক ও আজহার মেহমুদ। এর আগে গ্যারি কারস্টেন সাদা বলের কোচের দায়িত্ব ছাড়ার পর পিসিবি গিলেস্পিকেই অনুরোধ করেছিল টেস্ট দলের পাশাপাশি বাকি দুই সংস্করণে কোচের দায়িত্ব নিতে। পাশাপাশি আবদারসুলভ একটি শর্তও জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, বাকি দুটি সংস্করণের কোচ হিসেবে গিলেস্পি অতিরিক্ত পারিশ্রমিক পাবেন না।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি পিসিবির অনুরোধে ঢেঁকি না গেলার পর ২০২৫ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত আকিব জাভেদের কাঁধে সাদা বলের অন্তর্বর্তীকালীন কোচের জোয়াল তুলে দেওয়া হলো। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি শেষ হওয়ার আগেই সাদা বলে স্থায়ী কোচ খুঁজে বের করার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায় পিসিবি। অর্থাৎ পরিবর্তন হবে আবারও!
তা, গত এক বছরে পরিবর্তনের এই ধারাটা একবার দেখে নেওয়া যাক। বেশি না—মাত্র পাঁচজন! ঠিকই পড়েছেন। এ সময়ে পাকিস্তানের সাদা বলে পঞ্চম কোচ হবেন আকিব জাভেদ। বলা হয়, টেকসই উন্নতির জন্য কোচকে সময় দিতে হয়। কিন্তু কোচ নিয়ে পিসিবির কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হতে পারে, টেকসই নয়; পিসিবি ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ নীতিতে বিশ্বাসী।
পরিস্থিতিটা একবার দেখুন। গত বছর সাকলায়েন মুশতাকের কাছ থেকে পাকিস্তানের প্রধান কোচের দায়িত্ব পান নিউজিল্যান্ডের গ্র্যান্ট ব্র্যাডবার্ন। পদত্যাগ করেন গত ৮ জানুয়ারি। মাঝে নিউজিল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি সিরিজে পরিচালক ও কোচের দায়িত্ব পেয়েছিলেন মোহাম্মদ হাফিজ। গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁকেও সরিয়ে দেয় পিসিবি। এরপর এপ্রিলে গ্যারি কারস্টেনকে সাদা বল ও গিলেস্পিকে লাল বলের কোচের দায়িত্ব দেয় পিসিবি। কারস্টেনের অধীনে কোনো ওয়ানডে খেলতে পারেনি পাকিস্তান। দল ও অধিনায়ক নির্বাচন নিয়ে পিসিবির সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরায় গত ২৮ অক্টোবর পদত্যাগ করেন কারস্টেন। মাঝে এক দিন পর অস্ট্রেলিয়া সফরে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজের জন্য গিলেস্পিকে প্রধান কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ১৮ দিনের মাথায় আবারও পরিবর্তন।
সাদা বলের দায়িত্বে চলে এলেন আকিব জাভেদ, যিনি নির্বাচক কমিটিতেও সিনিয়র সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। গিলেস্পি থেকে যাবেন লাল বলের কোচ হিসেবেই। সত্যি বলতে, পাকিস্তান ক্রিকেটের এভাবে কোচ অদলবদলের হিসাব রাখাটাই যেন বেশ বড় চ্যালেঞ্জ। তাই অধিনায়কের হিসাবে যাওয়া যাক। ওমা! সেখানেও এই এক বছরে তিন সংস্করণে নিয়মিত বিরতিতে চলছে পাল্টানোর গান। কোচের মতো এই এক বছরে পাঁচজন অধিনায়কও পেয়েছে পাকিস্তান—শান মাসুদ, শাহিন শাহ আফ্রিদি, বাবর আজম, মোহাম্মদ রিজওয়ান ও সালমান আগা।
এ বছর জানুয়ারি থেকে হিসাব করলে এই পাঁচ অধিনায়কের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছেন বাবর আজম। ১৪ ম্যাচ এবং সবগুলোই টি-টোয়েন্টিতে। গত ১ অক্টোবর সাদা বলের অধিনায়কত্ব ছাড়েন বাবর এবং তারপর সে মাসেই এই সংস্করণে নেতৃত্ব পান রিজওয়ান। অস্ট্রেলিয়ায় ওয়ানডে সিরিজের তিন ম্যাচ এবং টি-টোয়েন্টি সিরিজে দুই ম্যাচে অধিনায়কত্ব করার পর রিজওয়ান বিশ্রাম পাওয়ায় আজ অধিনায়ক হিসেবে দেখা গেল তাঁর সহকারীর দায়িত্ব পাওয়া আগা সালমানকে।
মাসুদকে খানিকটা ব্যতিক্রম বলা যায়। গত বছর নভেম্বরে বাবরের জায়গায় টেস্ট দলের অধিনায়কত্ব পাওয়া মাসুদ এখনো নেতৃত্বে। এরই মধ্যে ৬টি টেস্টে অধিনায়কত্ব করেছেন। গত বছর নভেম্বরে বাবর আজম তিন সংস্করণে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব ছাড়ার পর টি-টোয়েন্টির নেতৃত্ব পেয়েছিলেন শাহিন আফ্রিদি। কিন্তু পিসিবির শীর্ষ কিছু পদে রদবদল হওয়ার পর গত মার্চের শেষ দিকে আফ্রিদিকে এক সিরিজ পরই অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে বাবরকে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পড়তে পড়তে নিশ্চয়ই প্যাঁচ লেগেছে? মাথা কি কিছুটা ঘুরেছে? কোন মাসে কে গেলেন, কে এলেন সেই হিসাব রাখা সত্যিই কঠিন। কিন্তু পাকিস্তান ক্রিকেট এই কঠিনেরেই বাসিয়াছে ভালো। তাই পরিবর্তনই সেখানে ধ্রুবক।