বদলেছেন রোহিত, বদলে দিচ্ছেন ভারতের ব্যাটিংও
‘লেজি এলিগেন্স’
বিশেষণটা রোহিত শর্মার একদম পছন্দ নয়। কিন্তু ভারতীয় অধিনায়কের ব্যাটিং বর্ণনা করতে গিয়ে ধারাভাষ্যকার, বিশ্লেষক বা ক্রিকেট পণ্ডিতেরা ঘুরেফিরে এ শব্দ দুটিই ব্যবহার করে থাকেন। অনেকে এর সঙ্গে ‘ইজি অন দ্য আই’ অথবা ‘হি হ্যাজ অ্যা লট অব টাইম’ কথাটাও জুড়ে দেন। এই অপ্রিয় কথাগুলো রোহিত শুনছেন সেই ছোটবেলা থেকে। এসব যতবারই কানে আসে, ততবারই নাকি রোহিতের মেজাজ বিগড়ে যায়। তাঁর যুক্তি, ‘আমি যা অর্জন করেছি, তার জন্য কষ্ট করতে হয়েছে। পরিশ্রম ছাড়া কিছুই হয়নি।’
রোহিতের ক্যারিয়ারই সেই পরিশ্রমের প্রতিচ্ছবি। তা না হলে রাতারাতি কেউ গড়পড়তা মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান থেকে বিশ্বসেরা ওপেনার হয়ে যায় নাকি! এক-দুই মৌসুমের জন্য নয়, এক যুগ ধরে ওয়ানডে ক্রিকেটে রোহিতের ধারেকাছে কেউ নেই। রোহিতের বিশ্বকাপ রেকর্ডের কথা তো নাই–বা বললাম। ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে শতকের সংখ্যায় তিনি ছাড়িয়ে গেছেন শচীন টেন্ডুলকারকে। টেন্ডুলকার বিশ্বকাপ খেলেছেন ছয়টি, এই বিশ্বকাপের রোহিত তৃতীয়।
এত দ্রুত কীভাবে রোহিত এত দূর এলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে রোহিতের ক্যারিয়ারের শুরুতে যেতে হবে। ২০০৭ সালে ওয়ানডে ক্যাপ পাওয়া রোহিত মিডল অর্ডারে খেলেছেন ২০১২ সাল পর্যন্ত। এই সময়টায় ৮৬ ম্যাচ খেলে রোহিতের রান ১৯৭৮, গড় ৩০.৪৩, স্ট্রাইক রেট ৭৭.৯৩। সংখ্যাগুলো নিশ্চয়ই কোনো ভবিষ্যৎ তারকার আভাস দেয় না। কিন্তু ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই গড়পড়তা পারফরম্যান্সের পরও ‘প্রতিভাবান’ কোটায় দলে জায়গা হচ্ছিল রোহিতের।
সে সময় থিতু হয়ে আউট হওয়ার প্রবণতা রোহিতকে বড়ই ভুগিয়েছে। সেটি থেকে বেরিয়ে আসতে প্রথম ২০ বলে আউট না হওয়ার চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা নিয়ে ব্যাটিং করতেন তিনি। শুরুর স্নায়ুর পরীক্ষাটা উতরে গেলেই শটের ভান্ডার খুলে বসতে বাঁধা নেই রোহিতের। ২০১৩ সালে তখনকার ভারতীয় অধিনায়ক এমএস ধোনি যখন রোহিতকে উদ্বোধনে পাঠালেন, তখন থেকে ভারতীয় ক্রিকেটে নতুন এক অধ্যায়ের শুরু। পরের গল্পটা রেকর্ড ঘাঁটলেই দেখতে পাবেন। ১০৫১৪ ওয়ানডে রানের মালিক রোহিতের ৮৫৩৬ রানই এসেছে ওপেনিংয়ে, গড় (৫৭.২৮) আর স্ট্রাইক রেটও (৯৫.১৮) সাদা বলের কিংবদন্তিতুল্য।
কালেভদ্রে জ্বলে ওঠা তরুণ ব্যাটসম্যান থেকে রোহিতের অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা অর্জনের পেছনে শক্ত ভিত্তি ছিল ওই ২০ বলের চ্যালেঞ্জ। শুরুতে ধরে খেলে ধীরে ধীরে রানের গতি বাড়ানো—ঝুঁকিহীন এই ওয়ানডে ব্যাটিং রোহিতের ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ করছিল ঠিকই। কিন্তু দল বড় কোনো ট্রফি জিততে পারছিল না। ২০১৯ সালের বিশ্বকাপের কথাই ধরুন। ৯ ম্যাচের ৯ ইনিংসে ব্যাট করে রোহিত ৫টি শতক ও ১টি অর্ধশতকে রান করেছেন ৬৪৮। বিশ্বকাপে তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। কিন্তু সেই বিশ্বকাপে রোহিতের শতক উদ্যাপনে উদ্বাহু ছবির চেয়ে বেশি স্মরণীয় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ম্যানচেস্টারের ড্রেসিংরুমের কাচে মাথা ঠেকিয়ে কান্নার ছবিটি। বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্সের পর দলকে শিরোপা জেতাতে না পারার কষ্টটা সেই ছবিতে স্পষ্ট।
একই কষ্টের পুনরাবৃত্তি হোক, রোহিত নিশ্চয়ই তা চাইবেন না। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে রোহিতকে ভারতের তিন সংস্করণের অধিনায়ক করা হয়। নেতৃত্ব পেয়ে ভারতীয় ক্রিকেটে আরও নতুন একটি অধ্যায়ের মধ্যমণি হয়ে উঠলেন রোহিত। সেটা কীভাবে? কোহলির যুগে ভারত সাদা বলের খেলাটা খেলত নিরাপদ ধাঁচে। ভারত তাতে সাফল্যও পাচ্ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের ট্রফি জিততে এমন কিছু দরকার, যা অন্য দলের নেই। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ড দলে ছিল সে ব্যতিক্রমী শক্তি। ওভারপ্রতি ছয়ের বেশি রান রেটে ব্যাটিং করা ইংল্যান্ডের ধারেকাছে কেউ ছিল না বললেই চলে।
২০১৯ সালের পর ইংল্যান্ডের ব্যাটিং ধরন অনুকরণ করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া। দ্রুত রান করার মতো ক্রিকেটার থাকায় খুব দ্রুতই বদলে যাওয়া সাদা বলের খেলার ধরনটা ধরতে পেরেছে এই দুটি দল। রোহিত ও কোচ রাহুল দ্রাবিড় নেতৃত্বে আসার পর সে পথে এগিয়েছে ভারতও। আর নিজের খেলার ধরন বদলে রোহিতই দেখিয়েছেন সেই পরিবর্তনের পথ। ইনিংসের শুরুতে যেই রোহিত খেলতেন দেখেশুনে, তিনিই এখন বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে ভারতকে এনে দিচ্ছেন উড়ন্ত সূচনা।
রোহিতের গত দুই বছরের পরিসংখ্যানেই আছে তার প্রমাণ। গত দুই বছরে ৩০ ইনিংসে ব্যাটিং করা রোহিত রান করেছেন ১৩০৯, গড় ৫০.৩৪। রোহিতের ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট যেখানে ৯১.৩৭, গত দুই বছরে তা ১১৩.৬২।
সর্বশেষ কোনো অধিনায়ককে পাওয়ার প্লেতে এমন বিস্ফোরক ব্যাটিং করতে দেখা গেছে ২০১৫ সালে, ব্রেন্ডন ম্যাককালামকে। সেই বিশ্বকাপে ম্যাককালামের পাওয়ার প্লে স্ট্রাইক রেট ছিল ১৬৩। এই বিশ্বকাপে রোহিতের স্ট্রাইক রেট ওপেনারদের মধ্যে সর্বোচ্চ (১২০)। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ছক্কাও (২০) রোহিতের।
রোহিত নিজেকে বদলেছেন। সেটি করতে গিয়ে হয়তো বদলে দিচ্ছেন ভারতের সাদা বলের ক্রিকেটও। বিশ্বকাপের মঞ্চ বলেই হয়তো এর প্রভাব জাতীয় দলে সীমাবদ্ধ থাকবে না, ছড়িয়ে যাবে পুরো ভারতীয় ক্রিকেটে। পরবর্তী প্রজন্মের ভারতীয় ওপেনাররাও হয়তো রোহিতের দেখানো পথে হাঁটবেন।