আম্পায়ারদের এলিট প্যানেল কী, কীভাবে এই নির্বাচন
আম্পায়ার—ক্রিকেটে বাধ্যতামূলক অনুষঙ্গ; যাকে ছাড়া খেলাই হবে না। এই শব্দের পূর্বসূরি শব্দ অনুসন্ধানে তাকাতে হয় ‘ওল্ড ফ্রেঞ্চ’ ভাষায়—খ্রিষ্টীয় অষ্টম থেকে ১৪ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলের মানুষ যে ভাষায় কথা বলতেন, সেটাকেই বলা হয় ‘ওল্ড ফ্রেঞ্চ।’ সেই ভাষারই শব্দ ‘ননপার’ (nonper) শব্দটি আম্পায়ার শব্দের শিকড়। ‘দুজন মানুষের মধ্যে বিরোধে যাকে বিচারক হিসেবে ডাকা হয়’—এটা ‘ননপার’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ। মধ্যযুগের ইংরেজি ভাষায় এই শব্দটাই এসেছে ‘নউম্পার’ (noumper) হয়ে। সেটি ১৩৫০ সাল নাগাদ।
১৪৪০ সালের পর এ ‘মিডল ইংলিশ’ শব্দ থেকে ‘এন’ উঠে গিয়ে দাঁড়ায় ‘ওউম্পের’ (owmpere)। ১৪৭৫ সাল নাগাদ শব্দটি মুখে মুখে উচ্চারণে আরেকটু পাল্টে দাঁড়ায় ‘অ্যান ওউম্পার’ (an oumper)। এখন লোকে যখন বলে ‘অ্যান আম্পায়ার’—সেটাই আসলে আগে উচ্চারিত হতো ‘অ্যা নাম্পায়ার’ (a numpire)।
আম্পায়ার—শব্দের শিকড় সন্ধানের প্রসঙ্গ আসছে শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদের কারণে। গত পরশু বাংলাদেশের প্রথম আম্পায়ার হিসেবে আইসিসির এলিট প্যানেলে জায়গা করে নেন শরফুদ্দৌলা। এরপরই আম্পায়ারিং নিয়ে বাংলাদেশে একটু হলেও আলোচনা শুরু হয়। এমন গৌরবের ক্ষণে জানিয়ে রাখা ভালো, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন যেমন নিরপেক্ষ আম্পায়ার দেখা যায়, আগে কিন্তু এই ব্যাপারটা এমন ছিল না। ইতিহাস জানাচ্ছে, ১৭৭৪ সাল নাগাদ ক্রিকেটে আম্পায়ার বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। এর প্রায় ১০০ বছর পর ১৮৭৭ সালে টেস্ট ক্রিকেট আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরুর পর স্বাগতিক দেশের আম্পায়াররাই দায়িত্ব পালন করতেন। মাঝে ব্যতিক্রম ছিল শুধু ১৯১২ সালে ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া নিয়ে আয়োজিত ত্রিদেশীয় টেস্ট সিরিজ। অস্ট্রেলিয়া–দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্টে প্রথমবারের মতো নিরপেক্ষ আম্পায়ার (দুজনেই ইংরেজ) দেখা যায় সেই সিরিজে। তবে সেটি আনুষ্ঠানিক কিছু ছিল না। বাঁকবদলটা ঘটে ওই ত্রিদেশীয় সিরিজের ৭৪ বছর পর। এর পুরোধা ছিলেন ইমরান খান।
হোম আম্পায়াররা পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত দেন—পাকিস্তানের মাটিতে সিরিজের পর সিরিজে এমন অভিযোগ শুনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন ইমরান। ১৯৮৬ সালের ৭ নভেম্বর লাহোরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্টে তাই দুজন ভারতীয় আম্পায়ারকে দেখা যায়। এই পরিকল্পনার ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিলেন ইমরান। তিন বছর পর পাকিস্তানের মাঠে ভারতের বিপক্ষে সিরিজে দেখা গেল দুজন ইংরেজ আম্পায়ার। ১৯৯২ সালে প্রতি টেস্টে একজন নিরপেক্ষ আম্পায়ার রাখাটা পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে আইসিসি, দুই বছর পর সেটাই নিয়ম করা হয়। এরপর ২০০২ সালে ভারতের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকে প্রতি ম্যাচেই দুজন নিরপেক্ষ আম্পায়ার রাখার নিয়ম চালু করা হয় এবং সেটা এখনো বর্তমান। এই পথেই ২০০২ সালে এপ্রিলে সেরা আম্পায়ারদের নিয়ে একটি প্যানেল গঠন করে আইসিসি—এলিট প্যানেল অব আইসিসি আম্পায়ার্স। শরফুদ্দৌলা এখন সেই অভিজাত আম্পায়ারদেরই কাতারে। বর্তমানে এলিট প্যানেলে আছেন ১২ জন আম্পায়ার।
এলিট প্যানেল কী
এটি বাছাইকৃত সেরা আম্পায়ারদের একটি প্যানেল। এই প্যানেলে আম্পায়ারদের বাছাই ও নিয়োগ দিয়ে থাকে আইসিসি। ১৯৯৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অব আইসিসি আম্পায়ার্স গঠন করা হয়। আট বছর পর এই প্যানেলকেই আরেকটু সম্প্রসারণ করে আম্পায়ারিংয়ের মান আরও বাড়াতে বানানো হয় এলিট প্যানেল। অর্থাৎ, আইসিসির আন্তর্জাতিক আম্পায়ারদের মধ্য থেকে সেরাদের নিয়ে আলাদা একটি প্যানেল বানায় আইসিসি। এই এলিট প্যানেলের আম্পায়ারদের সাধারণত বিশ্বের সেরা আম্পায়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই প্যানেলের আম্পায়াররা বছরে অন্তত ৮ থেকে ১০টি টেস্ট ও ১০ থেকে ১৫টি ওয়ানডে পরিচালনা করার সুযোগ পান। আইসিসির আম্পায়ার্স সিলেকশন প্যানেল প্রতিবছর এই এলিট প্যানেলের আম্পায়ারদের পারফরম্যান্স বিচার করে প্রয়োজনে তালিকায় সংযোজন–বিয়োজন করে।
আগে কী ছিল
একসময় টেস্টের দুজন আম্পায়ারই থাকতেন স্বাগতিক দেশের। ১৯৯২ সালে নিয়ম করা হয়, একজন আম্পায়ার হবেন স্বাগতিক দেশের, আরেকজন প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশের বাইরের কোনো দেশের। ২০০২ সালে এলিট প্যানেল গঠনের পর টেস্টে স্বাগতিক দেশের কোনো আম্পায়ার থাকেন না। যদিও করোনার সময় এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়েছে।
এলিট প্যানেলের আম্পায়াররা কীভাবে নির্বাচিত হন
ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো আম্পায়ারিং করে দেশের জাতীয় প্যানেলে উঠে আসেন আম্পায়াররা। সেখান থেকে আইসিসির তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য সুপারিশ করা হয় সংশ্লিষ্ট বোর্ড থেকে। আইসিসির আন্তর্জাতিক প্যানেলে অন্তর্ভুক্তির পর সংস্থাটির বার্ষিক পর্যবেক্ষণ এবং নির্বাচনপ্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ভালো পারফরম্যান্স করা আম্পায়ারদের শীর্ষ স্তরে (এলিট প্যানেল) আনা হয়। আন্তর্জাতিক প্যানেল থেকে এবার এলিট প্যানেলে আম্পায়ার নির্বাচন করার জন্য যে নির্বাচক কমিটি কাজ করেছে, তাতে ছিলেন আইসিসির ক্রিকেট মহাব্যবস্থাপক ওয়াসিম খান, সাবেক ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার সঞ্জয় মাঞ্জরেকার, সাবেক আম্পায়ার টনি হিল এবং বিশেষজ্ঞ পরামর্শক মাইক রাইলি।
আইসিসির এলিট প্যানেল আম্পায়ার
কুমার ধর্মসেনা (শ্রীলঙ্কা), ক্রিস্টোফার গ্যাফানি (নিউজিল্যান্ড), মাইকেল গফ (ইংল্যান্ড), আদ্রিয়ান হোল্ডস্টক (দক্ষিণ আফ্রিকা), রিচার্ড ইলিংওর্থ (ইংল্যান্ড), রিচার্ড কেটেলবরো (ইংল্যান্ড), নিতিন মেনন (ভারত), আহসান রাজা (পাকিস্তান), পল রাইফেল (অস্ট্রেলিয়া), শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ (বাংলাদেশ), রডনি টাকার (অস্ট্রেলিয়া) ও জোয়েল উইলসন (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)।