বুমরার ধর্মমাতা, ‘ফাইনালটা দেখিনি যশপ্রীত, তবে তোমাকে ভালোবাসি’

বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে যশপ্রীত বুমরাএএফপি
ভারতের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ে অন্যতম বড় ভূমিকা ছিল টুর্নামেন্ট–সেরা খেলোয়াড় যশপ্রীত বুমরার। এ পেসারকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দীর্ঘ আবেগঘন পোস্টে বুমরার ছেলেবেলার সংগ্রামের কথা তুলে এনেছেন তাঁর ধর্মমাতা সাংবাদিক ও সমাজকর্মী দীপাল ত্রিবেদী। তাঁর সেই পোস্টের বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হলো এখানে—

আমার ক্রিকেটজ্ঞান শূন্য। এমনকি বিরাট কোহলিকেও আমি চিনি আনুশকার (শর্মা) স্বামী হিসেবে। দারুণ একজন। ও নাচার চেষ্টা করলে ব্যাপারটি বেশ ভালো লাগে।

তবে আমার এই (দীর্ঘ) পোস্ট আসলে আমার নায়ককে নিয়ে। ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরের একদিন। আমার বেতন তখন মাসে ৮০০ রুপির কম। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু আর নিকটতম প্রতিবেশী আমাকে ছুটি নিতে বাধ্য করল। ওর বাচ্চা হবে। আমারও বয়স তখন ২২-২৩-এর মতো।

ডিসেম্বরের ওই দিনের প্রায় পুরোটাই আমি কাটালাম পালডির একটা হাসপাতালে। আমার বন্ধু দালজিতের স্বামী যশবীর কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গিয়েছিল। তখনই নার্স আমাদের নাম ধরে ডাকাডাকি করে। আমার কাঁপা কাঁপা হাতে একটা বাচ্চা ধরিয়ে দিয়ে গেল।

দীপাল ত্রিবেদীর সঙ্গে বুমরা
ইনস্টাগ্রাম

সেবারই প্রথম কোনো সদ্যোজাতকে ছুঁয়ে দেখা আমার। শুধু মনে আছে, বাচ্চাটি লিকলিকে ছিল। হাসার চেষ্টা করছিল, কিন্তু আসলে পারছিল না। নার্স বলল, ছেলেশিশু। পাতলা আর রোগা। দ্রুতই ডাক্তাররা তাদের কাছে নিয়ে নিলেন। আমার বন্ধু দারুণ খুশি। ওর মেয়ে জুহিকার ধর্মমাতা আগে থেকেই ছিলাম।

এটা আসলে বলিউডের সিনেমা। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী চিমনলাল প্যাটেল মারা গেলেন। পরের দুই মাসে আমি রাজনৈতিক প্রতিবেদক হলাম। বেতন বাড়ল একটু। একটু আইসক্রিম কিনে সবাই মিলে খেলাম। পাশাপাশি থাকতাম বলে সবই ভাগাভাগি করতাম। আমার কোনো ফোন, ফ্রিজ এমনকি কোনো বিছানাও ছিল না! আমাদের দেয়ালও ছিল একটাই। ওর বাড়িটা ছিল আমার স্বর্গ।

আরও পড়ুন

দুঃখজনকভাবে আমার বন্ধুর স্বামী মারা গেল কদিন পরই। জীবনটা বদলে গেল। অসহায় হয়ে পড়লাম আমরা। ওই মাসের পুরোটাই আমি বাচ্চা দুটোকে সামলেছি। ওদের পড়ে শুনিয়েছি। ছেলেটার কোনো উৎসাহই ছিল না। ওর সস্তা প্লাস্টিক বল নিয়ে খেলা শুরু করত।

বাচ্চাদের সামলাতে গিয়ে এত ক্ষুধা লাগত যে ওদের বিস্কুটই খেয়ে ফেলতাম। আমরা না খেয়ে থেকেছি, ভুগেছি, কেঁদেছি। কিন্তু লড়াই করেছি জীবনের সঙ্গে। মেয়েটা—জুহিকা, যার আমি ধর্মমাতা। আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর শিশু। সে আমাকে আশা দিয়েছিল, ওর ওই হাসিতে আর দৃঢ় আলিঙ্গনে। এখনো দেয়। কিন্তু ছেলেটাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এক প্যাকেট দুধই কিনে দিতে পারতাম না আমরা। তার বেড়ে ওঠার সময়ে আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। ওর মা দিনে ১৬-১৮ ঘণ্টা কাজ করত।

মনে পড়ে, একবার বেতন বাড়ায় আমার চেনা সবচেয়ে অভিজাত দোকানে গিয়েছিলাম একটা জামা কিনতে। আট বছর বয়সের ছেলেটা সেখানে ছিল, ওর মায়ের ওড়নার পেছনে লুকিয়ে। একটা জ্যাকেট চেয়েছিল। তাকে দেওয়া আমার একমাত্র উপহার সেটি। এরপর দীপাবলি, বড়দিন আর আমার জন্মদিন—তিনটিই কাটল নতুন জামা ছাড়া। তবে ওর ওই জ্যাকেট আমাকে যে তৃপ্তি দিয়েছিল, তা বড় কোনো ফ্যাশন ডিজাইনারের জামাও দিত না।

স্ত্রী সঞ্জনার সঙ্গে বুমরা
ইনস্টাগ্রাম

বাচ্চাটা লাজুক ছিল অনেক, ওর বোনের মতো না। সে এখন কিংবদন্তি। ওর অর্জনের খাতায় যোগ করলে গতকাল রাতে (পরশু) আমাদের বিশ্বকাপ জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। প্রত্যেক ভারতীয়ই নিশ্চয়ই তাকে নিয়ে গর্ব করে, তার কাছ থেকে শেখে। সে এখনো আগের মতোই বিনয়ী আছে।

ওর নাম যশপ্রীত বুমরা।

ওর মায়ের জোরাজুরিতে একটা ম্যাচ দেখার চেষ্টা করেছিলাম বটে। কিন্তু অর্ধেক না যেতেই উঠে গেছি। আমি ক্রিকেটটা স্রেফ বুঝি না। হয়তো অঙ্গদ (বুমরার ছেলে) যদি ফুটবল খেলে, তাহলে দেখব!

এটা লিখছি, আপনাদের এটাই জোর দিয়ে বলতে যে আশা ছাড়বেন না। কারণ, ঈশ্বর আমাদের নিয়ে আশাহত হন না।

আরও পড়ুন

যশপ্রীতকে প্রথমবার হাতে নিতে পেরে আমি সৌভাগ্যবান ছিলাম। প্রায়ই কঠিন সময়ে আমাকে ওই মুহূর্তটাই আশা দেয়, জীবনের মুখোমুখি হওয়ার সাহস জোগায়। অবশ্যই ওর মা দালজিতেরই পুরো কৃতিত্ব এমন বাচ্চাদের মানুষ করার।

কয়েক মাস আগে যশপ্রীতের অসাধারণ স্ত্রী সঞ্জনা আমাদের দাওয়াত দিয়েছিল। এত সুন্দর রুচি, এত নম্র। খেয়াল করে দেখুন, আমার বাচ্চা যশপ্রীতেরই এখন সন্তান আছে—অঙ্গদ। অবশ্যই অঙ্গদ যশপ্রীতের ওই বয়সের চেয়ে অনেক বেশি হ্যান্ডসাম।

টুর্নামেন্টের সেরা ক্রিকেটার বুমরা
এক্স/বুমরা

আমি ব্যক্তিগত কথা খুবই কম লিখি, তবে এবার লিখতে চেয়েছি। কারণ, আমি চাই না কেউ জীবনে আশা হারাক। যশপ্রীত বুমরার কথা ভাবুন। তার সংগ্রাম। ঈশ্বর কীভাবে তাকে সাহায্য করেছেন। আমরা নিজেরা যদি এগিয়ে আসি, তাহলে ঈশ্বর সবাইকেই সাহায্য করবেন।

দয়া করে আমার সঙ্গে যোগ দিয়ে আমার বাচ্চা যশপ্রীত বুমরাকে অভিনন্দন জানান। বিশ্বকাপ জয়ের জন্য। আহমেদাবাদের একটা অখ্যাত এলাকা ও স্কুল থেকে গিয়ে সে আমাদের সবাইকে গর্বিত করেছে। বুমরাকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমি ওর মা দালজিত ও বোন জুহিকাকে ধন্যবাদ জানাই। সঞ্জনা তো অবশ্যই তার আত্মজ।

দুঃখিত যশপ্রীত, ফাইনাল ম্যাচটা দেখিনি আমি। তবে আমি তোমাকে ভালোবাসি!