২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

মানকাডিং—ক্রিকেটীয় চেতনার হাওয়াই মিঠাই

ইংল্যান্ডের চার্লি ডিনকে মানকাডিং করেন ভারতের দিপ্তী শর্মাছবি: টুইটার

মানকাডিং!

আউটটি নিয়ে কথা উঠলে বাংলাদেশি ক্রিকেটভক্তদের সম্ভবত সবার আগে যে ঘটনাটা মনে পড়বে, ২০০৩ মুলতান টেস্টে পাকিস্তানের উমর গুল ননস্ট্রাইকিং এন্ড থেকে এগিয়ে যাওয়ার পরও বোলার মোহাম্মদ রফিকের রানআউট না করা।

সেই আউটটা হলে তখনো পর্যন্ত টেস্ট ম্যাচ না জেতা বাংলাদেশের জন্য হয়তো প্রথম জয়টা প্রায় নিশ্চিতভাবেই ধরা দিত। হয়তো বদলে যেত দেশের ক্রিকেটের ইতিহাসও।

যেমনটা হয়তো বদলাতে পারত ১৯৮৭ বিশ্বকাপে কোর্টনি ওয়ালশ যদি সেলিম ইউসুফকে ‘মানকাডিং’ করতেন। এর খেসারত দিয়ে সে ম্যাচে হেরে যাওয়া ওয়েষ্ট ইন্ডিজ সেবার ফাইনালে ওঠা দূর অস্ত, আর কখনো ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলতে পারেনি।

রফিক আর ওয়ালশ মানকাডিং না করার জন্য প্রচুর প্রশংসা পেয়েছেন। ‘স্পিরিট অব ক্রিকেট’ নামের এক বায়বীয় ধারণার পুষ্পবৃষ্টিতে ভিজেছেন। কিন্তু সবাই রফিক-ওয়ালশ নন। কারও কারও কাছে ক্রিকেটীয় চেতনার চেয়ে দলের জয়ই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ওয়েস্ট ইন্ডিজেরই কিমো পল নিজের দেশের জয়কে বড় করে দেখে মানকাডিং করেছিলেন রফিকেরই দেশে। এই বাংলাদেশেই ২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের শেষ ব্যাটসম্যানকে মানকাডিং করে দলকে জেতান ৩ রানে। পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজই চ্যাম্পিয়ন হয়।

মানকাডিং করা না করা নিয়ে এমন আরও অনেক ঘটনা আছে। সাম্প্রতিকতম ঘটনাটি হচ্ছে, ইংল্যান্ড-ভারত নারীদের তৃতীয় ওয়ানডেতে ভারতের দিপ্তী শর্মা চার্লি ডিনকে রানআউট করে দল জেতান। বোঝার বিষয় হলো এখানে রানআউট বলা হচ্ছে, কারণ আগামী মাস থেকে এই আউটকে ‘আনফেয়ার প্লে’ নামের ব্র্যাকেটের বাইরে এনে কেবল রান আউট হিসেবেই দেখা হবে।

এমসিসি আইনের ৩৮.৩.১ ধারায় আছে যে ‘বল খেলার মধ্যে থাকা অবস্থায়, যে মুহূর্তে বোলার সাধারণত ডেলিভারি করবেন বলে ধরে নেওয়া হয়, তার আগপর্যন্ত যেকোনো সময়ে ব্যাটার ক্রিজের বাইরে গেলে রানআউটের জন্য দায়ী হবেন।’

আইসিসি এই আউটকে স্বাভাবিক চোখে দেখতে শুরু করলেও ব্রিটিশ মিডিয়া যথারীতি অতীতের মতো এ নিয়ে তর্ক শুরু করেছে। তবে এই তর্ক কেবল ‘চেতনা’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এর পেছনে আছে বর্ণবাদের চোরাস্রোত।

১৩ ডিসেম্বর ১৯৪৭। অস্ট্রেলিয়া সফরে দ্বিতীয় টেস্টে সিডনিতে ভারতের ভিনু মানকড় স্বাগতিক ওপেনার বিল ব্রাউনকে বোলিং করার সময় রানআউট করেন। ওপরে উল্লেখ করা আইনে ভারতের সে সময়ের সেরা খেলোয়াড় তা করতেই পারেন। কিন্তু মানকড়ের সেই আচরণকে এতটাই অখেলোয়াড়সুলভ বিবেচনা করা হলো যে সেই থেকে এই আউটের আনঅফিশিয়াল নাম দেওয়া হলো ‘মানকাডিং’।

কিন্তু ব্যাপার কি এতটাই সরল? ক্রিকেট ঐতিহাসিক অভিষেক মুখার্জি এ নিয়ে কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছেন।

প্রথম কথা, ভিনু মানকড় ক্রিকেট ইতিহাসে এভাবে আউট করা প্রথম ব্যক্তি নয়। প্রায় ২০০ বছর আগে, ১৮৩৫ সালে ইংরেজ পেসার টমাস বার্কার এভাবে আউট করেছিলেন জর্জ বেইজেন্টকে। এরপর বার্কার অন্তত আরও তিনবার এই কাণ্ড ঘটান, যার মধ্যে একটি ঘটনা ছিল লর্ডসে। কেউ তখন ‘ক্রিকেটের জাত গেল, জাত গেল’ বলে হইচই করেননি। বরং সে সময় বেশির ভাগেরই মতামত ছিল, বোলার যদি টের পায় তুমি ক্রিজের বাইরে, আর তোমাকে আউট করে দেয়, তবে সেটা তোমারই বোকামি। সে সময়কার কিছু বইপত্রে এর স্পষ্ট উল্লেখ আছে।

বার্কার তো বটেই, যাঁকে বলা হয় ভারতীয় ক্রিকেটের পথিকৃৎ—তখন এই খেলাটা ‘নেটিভ’দের শেখানোর ব্যাপারে যাঁর অবদানকে মহান করে দেখানো হয়, সেই লর্ড হ্যারিসও ইটন কলেজের হয়ে লর্ডসে হ্যারো কলেজের কনরাড ওয়ালরুথকে এভাবে আউট করেছিলেন, ১৮৭০ সালে।

একটা কথা বলে রাখা ভালো, ইটন আর হ্যারো হচ্ছে ব্রিটিশদের ‘মোরালিটি’ শেখার তীর্থস্থান। সেদিন কিন্তু হ্যারিসের আচরণকে কেউ অখেলোয়াড়চিত বলেননি, উল্টো প্রথম উইম্বলডন শিরোপাজয়ী স্পেনসার গোরে তাঁর বইয়ে হ্যারিসের আচরণকে সঠিক এবং ব্যাটসম্যানের আচরণকে ভুল বলে আখ্যা দেন।

লর্ড হ্যারিস
ছবি: এমসিসি

দ্বিতীয় কথা, মানকড় নাকি ব্রাউনকে আগে সতর্ক করেননি—এ দাবিও ভুল। মানকড় আউট করার আগে তাঁকে সতর্ক করেছেন। এমনকি এভাবে আউট করে পরের ইনিংসে আবারও সুযোগ পেয়েও ব্রাউনকে আউট করেননি। সর্বকালের অন্যতম সেরা লেগ স্পিনার, কিংবদন্তি অস্ট্রেলিয়ান বিল ও’রিলি এই ঘটনার উল্লেখ করে বলেছিলেন, ক্রিকেট আইনে এ নিয়ে বোলরের সতর্ক করারও দরকার নেই, কিন্তু  মানকড় ভদ্রতা দেখিয়ে সেটাও করেছেন। আউট হওয়ার দোষটা ব্রাউনেরই।

রসিক বিল ও’রিলি এই প্রসঙ্গে বেশ মজাও করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমার বোলিংয়ে জীবনেও এমন হবে না, কারণ দুনিয়ার কোনো ননস্ট্রাইকার আমার বল (ওপাশে) মোকাবিলার সময় রান নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকবে না।’

এমনকি স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, যিনি সে ম্যাচে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক—তিনিও ‘ফেয়ারওয়েল অব ক্রিকেট’ বইয়ে উল্লেখ করেন, ব্রাউনকে আগে সতর্ক করে মানকড় ভদ্রতার পরিচয় দিয়েছেন, আর আউটের পর দলের সবাই তা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি বিল ও’রিলি
ছবি: উইজডেন

পরের দিন অস্ট্রেলিয়ান সংবাদমাধ্যম ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ এই আউট নিয়ে জনতার মতামত জানতে চাওয়া হয়। বেশির ভাগ মত দেন, ব্রাউন একে তো বোকার মতো আউট হয়েছেন, উপরন্তু আউট হয়ে ব্যাট ছুড়ে মেজাজ দেখিয়েছেন। এমন আচরণ স্কুলপড়ুয়াদের কাছেও আশা করা যায় না। এমন লোক অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলার উপযুক্ত না।

প্রশ্ন হচ্ছে, এত কিছুর পরও কেন ভিনু মানকড় কলঙ্কিত? কেন তাঁর আচরণকে ‘অখেলোয়াড়সুলভ’ মনে করা হলো?

১৯৪৭ সাল। ভারত স্বাধীনতা পেয়েছে ছয় মাসও হয়নি। সদ্য সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভুরা আধিপত্য হারানোয় এমনিতেই বিরক্ত। এর মধ্যে ভারতীয় মানকড়ের হাতে একজন শেতাঙ্গের এভাবে আউট হওয়া—কে ভালো চোখে দেখবে! তাই বুঝি আউটটি নিয়ে ব্যাখ্যা পাল্টিয়ে জনমত ঘুরিয়ে দেওয়া হলো? যে আউটটি আইন মেনেই করা, তাকে তীব্র আদর্শবাদের রঙে নিমজ্জিত করে কি সাহেবদের অহম রক্ষা করা হয়েছিল? এককথায়, মোড়লগিরি ধরে রাখার চেষ্টা?  

এসব প্রশ্নের উত্তর কালের স্রোতে হারিয়ে গেছে। তবে খ্যাতিমান ক্রিকেট লেখক ও দার্শনিক সিএলআর জেমসের একটি কথায় চাইলে উত্তর খুঁজে নিতে পারেন, ক্রিকেটকে যারা কেবল খেলা হিসেবে দেখে, ওরা আসলে ক্রিকেট বোঝে না।