লন্ডন থেকে এসে ইমরানুর দৌড়েছেন, এবার দৌড়াতে হবে বাংলাদেশকে
তুরস্ক থেকে কাল সন্ধ্যায় যখন খবরটা এল, ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। কারণ সেটা ছিল অনানুষ্ঠানিক খবর। সোজা বাংলায় বললে, মুখের কথা। কিন্তু সাংবাদিকদের তো মুখের কথা শুনে কোনো কিছু লিখে দেওয়া সম্ভব না। অবশ্যই তথ্যটি যাচাই-বাছাই করতে হবে। এর ওপর যে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার কথা বলছি, সেই ইসলামিক সলিডারিটি গেমসের সব রকমের হালনাগাদ তথ্য পাওয়াটা খুব দুষ্কর। যেমনটা অফিসে বসেই পেয়েছি বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসের সব রকমের খবর। কমনওয়েলথ গেমসের ওয়েবসাইটে ঢুকলেই মিলেছে কবে খেলা, কার সঙ্গে কে খেলছে, কোন দেশ কতগুলো পদক পাচ্ছে। কিন্তু তুরস্কের কনিয়াতে অনুষ্ঠানরত ইসলামিক গেমসের সব খবর জোগাড় করতে রীতিমতো গলদঘর্ম দশা।
কথাগুলো ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ টাইপ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে খবরের প্রসঙ্গে এত কথা, সেটাই এবার বলা যাক। বাংলাদেশের দ্রুততম মানব ইমরানুর রহমান ইসলামিক সলিডারিটি গেমসের ১০০ মিটার স্প্রিন্টের হিটে দৌড়েছেন কাল। সাধারণত আন্তর্জাতিক গেমসে বাংলাদেশের অ্যাথলেটদের হিটেই বাদ পড়ার শিরোনাম লিখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এ দেশের গণমাধ্যম। কিন্তু এই শিরোনাম বদলে দেওয়ার শুরুটা করে দিয়েছেন ইমরানুর।
গত বছর অক্টোবরে লন্ডনপ্রবাসী ২৯ বছর বয়সী এই অ্যাথলেটকে প্রথমবার গণমাধ্যমের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন। ইংল্যান্ড থেকে তাঁকে ঢাকায় উড়িয়ে আনার পর বিকেএসপিতে নেওয়া হলো ট্রায়াল। সেখানে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সময় নেন ১০.৪০ সেকেন্ড (হ্যান্ড টাইমিংয়ে)। ৬০ মিটারে ৬.৫০ সেকেন্ড। রুগ্নপ্রায় এ দেশের অ্যাথলেটিকসে ইমরানুরের আশা জাগানিয়া টাইমিং দেখে খুশি হলেন ফেডারেশন কর্মকর্তারা।
এরপর জানুয়ারিতে ঢাকায় জাতীয় অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে ১০.৫০ সেকেন্ড দৌড়ে ২২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভাঙলেন। মার্চে বেলগ্রেডে বিশ্ব ইনডোর অ্যাথলেটিকসে ৬০ মিটারে দৌড়ালেন ৬.৬৪ সেকেন্ডে। পৌঁছে গেলেন সেমিফাইনালে। এরপর থেকেই মূলত তাকে নিয়ে আশাবাদী হয়ে ওঠেন সবাই।
ইমরানুর ১৬ জুলাই ওরিগনে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে দৌড়ালেন ১০.৪৭ সেকেন্ডে। হিটের প্রিলিমিনারি রাউন্ড থেকে উঠলেন চূড়ান্ত পর্বের হিটে। চোটে পড়ে অবশ্য এরপর হিটে দৌড়াননি। সর্বশেষ বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসে দৌড়ালেন ১০.৪৬ সেকেন্ডে। টাইমিং নিয়ে হতাশায় থাকা ইমরানুর এরপর গতকাল তুরস্কে দৌড়েছেন ১০.০১ সেকেন্ডে। বাংলাদেশের কোনো স্প্রিন্টারের এমন টাইমিংয়ে দৌড়ানো তো অবিশ্বাস্যই।
আরেকটু কম সময় নিয়ে দৌড়ালেই ইমরানুর ৯ সেকেন্ডের ঘরে নামিয়ে আনতে পারতেন নিজের টাইমিং! দক্ষিণ এশিয়ায় ৯ সেকেন্ডের ঘরে টাইমিং নামিয়ে আনা অ্যাথলেট আছে শুধুই একজনের— শ্রীলঙ্কান ইউপুন আবেকুনের। ৩ জুলাই সুইজারল্যান্ডে একটি প্রতিযোগিতায় ৯.৯৬ সেকেন্ডে দৌড়েছিলেন তিনি। ১০ সেকেন্ডের কমে দৌড়ানো দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম স্প্রিন্টার এবার বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসে জিতেছেন ব্রোঞ্জ। ১০.১৪ সেকেন্ডে দৌড়েছেন ইউপুন। কমনওয়েলথ গেমসে এই ইভেন্টে সোনা জিতেছেন কেনিয়ার ফার্ডিনান্ড ওমানিয়ালা। তাঁর টাইমিং ১০.০২ সেকেন্ড। ফার্ডিনান্ডের চেয়ে ইমরানুর মাত্র ০.০১ সেকেন্ড কম দৌড়েছেন তুরস্কে!
লন্ডনে একটি ব্যাংকে চাকরি করেন ইমরানুর। স্ত্রী আর কন্যা নিয়ে দিব্যি সংসার। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে চলে অনুশীলন। এভাবে অনুশীলন করেই ইমরানুর দেখিয়ে দিলেন তাঁর ১০ সেকেন্ডের কমে দৌড়ানোর সামর্থ্য আছে। এখন তাঁর শুধু প্রয়োজন ভালোমানের কোচের অধীনে নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলন। প্রয়োজন আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা।
ভালো সুযোগ-সুবিধা আর একটু মানসিক সমর্থন, আর্থিক দুশ্চিন্তা থেকে যতটা সম্ভব মুক্তি—এই জিনিসগুলোর বিকল্প নেই। প্রতিবেশী দেশ ভারত তাদের ক্রীড়াবিদদের এই সুবিধাগুলো দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। যার ফলও পেতে শুরু করেছে তারা। গত বছর অনুষ্ঠিত টোকিও অলিম্পিকে বর্শা নিক্ষেপে ভারতকে সোনার পদক উপহার দিয়েছেন নীরজ চোপড়া। এবারের কমনওয়েলথ গেমসে অ্যাথলেটিকসের ইভেন্টগুলোতে দেখা গেছে ভারতীয় অ্যাথলেটদের দাপট। বেশ কয়েকটি পদকও জিতেছেন তারা। ভারতের কথা বাদ দিন, পাকিস্তানও এবারের কমনওয়েলথ গেমসের অ্যাথলেটিকসে একাধিক পদক জিতেছে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা পারলে আমরা পারব না কেন! ইমরানুররা প্রতিশ্রুতিশীল। তাদের সেরাটা বের করে আনার দায়িত্ব অবশ্যই অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের।
ইমরানুর দৌড়েছেন ১০.০১ সেকেন্ড গতিতে। আন্তর্জাতিক গেমস থেকে তাঁকে দিয়ে পদক আনতে হলে এবার আরও দ্রুতগতিতে ছুটতে হবে ফেডারেশনের। ১০.১ সেকেন্ড থেকে ইমরানুরের টাইমিং ‘১০-এর নিচে’ নামানোটাই বিরাট চ্যালেঞ্জ। আর সেই চ্যালেঞ্জ জিততে চাইলে কেবল ক্রীড়াবিদের সামর্থ্য বাড়ালেই হয় না, বাড়াতে হয় পুরো প্রক্রিয়ার সামর্থ্য।
বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সেই সামর্থ্য আছে কি না, দেখার বিষয় এখন সেটিই।