ফেসবুক মেমোরিতে ফিরে আসা এই দিনের পুরোনো পোস্টগুলো যেমন নস্টালজিক করে তোলে, ক্রিকইনফোর ‘অন দিস ডে’ বিভাগটাও তা–ই। আজকের দিনে, বলা ভালো, আজকের তারিখে ক্রিকেট ইতিহাসে কোন বছরে স্মরণীয় কী ঘটেছিল, সেসবে চোখ বোলানো একরকম প্রাত্যহিক অভ্যাসই বলতে পারেন। নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারটা অবশ্য সব কটিতে ঘটে না। শতাব্দীপ্রাচীন অনেক ঘটনাও তো থাকে সেখানে। সেসব তো পড়ে জানা। প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার সুযোগ সেখানে নেই। স্মৃতি থাকলে না স্মৃতিকাতর হওয়ার প্রশ্ন আসে!
তবে ‘অন দিস ডে’–তে এমন অনেক কিছুও তো থাকে, যা হয়তো মাঠে বসেই দেখেছি। অথবা টেলিভিশনের পর্দায়। আবার এর বাইরেও কিছু থাকে, যা হয়তো সরাসরি দেখিনি, কিন্তু পেশার দায় বা দায়িত্ব থেকে তা নিয়ে অনেক লিখেছি। মনে পড়ে যায় এ নিয়ে তুমুল তোলপাড়ের সেই সময়টাও।
তা আজকের ’অন দিস ডে’–তে এমন কী আছে? আছে তো অনেক কিছুই। এর মধ্যে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হয়তো শহীদ আফ্রিদির কাণ্ডটাই। তবে বিবেচনাটা যদি হয় ‘সবচেয়ে ব্যতিক্রমী এবং সবচেয়ে মজার’, তাহলে সেটি আবার এক নম্বরে চলে আসে। সেই প্রসঙ্গটায় একটু পরে আসি। ৩১ জানুয়ারি ক্রিকেট ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য আর কী কী ঘটেছিল, তা আগে একটু দেখি নিই।
২৬ বছর আগে চেন্নাইয়ে ক্ল্যাসিক এক টেস্ট ম্যাচের সমাপ্তি দেখেছিল এই দিন। পিঠের ব্যথা নিয়েও শচীন টেন্ডুলকার ১৩৬ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলার পরও শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছিল সাকলায়েন মুশতাকের দুসরা।
ভারতের বাকি ব্যাটসম্যানদের সহায়তার কথা নাই–বা বললাম। ২৭১ রান তাড়া করতে নেমে ৮১ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলা ভারতকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন টেন্ডুলকার। স্কোর যখন ৬ উইকেটে ২৫৪—জয় থেকে ভারতের দূরত্ব মাত্র ১৭ রান—মনে হয় না কেউ ভেবেছিলেন, এই ম্যাচে ভারতের জয় ছাড়া অন্য কিছু সম্ভব। কিন্তু সাকলায়েনের দুসরায় টেন্ডুলকার আউট হওয়ার পরই তাসের ঘর ভারতের বাকি ব্যাটিং। পাকিস্তান জিতে যায় ১২ রানে। টেস্টটা টেলিভিশনে দেখেছি।
তারপরও কিছু ম্যাচ এমন হয় না, টেলিভিশনে দেখার পরও যা প্রেসবক্সে বসে দেখার মতোই তরতাজা স্মৃতি হয়ে থাকে। এই টেস্টটাও ছিল তেমন। ম্যাচ শেষের ওই দৃশ্যটাও—পরাজয়ের দুঃখ বুকে চেপে চেন্নাইয়ের দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছেন চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে ল্যাপ অব অনার দিতে থাকা পাকিস্তান দলকে।
ল্যান্স গিবসের কীর্তি নিয়ে অবশ্যই এমন কোনো স্মৃতি নেই। কারণ, সেটি সেই ১৯৭৬ সালে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের খোঁজখবরও যখন রাখতে শুরু করিনি। তবে দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার নায়কের সঙ্গে পরে শুধু দেখাই হয়নি, দীর্ঘ আড্ডাও দিয়েছি। ও হ্যাঁ, আগে তো বলে নেওয়া উচিত, এই দিনে ল্যান্স গিবস কী করেছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান অফ স্পিনার মেলবোর্ন টেস্টে ভেঙে দিয়েছিলেন ফ্রেড ট্রুম্যানের সবচেয়ে বেশি টেস্ট উইকেট নেওয়ার রেকর্ড।
২০০৯ সালে সেন্ট ভিনসেন্টের হসপিটালিটি বক্সে বসে গিবসের মুখেই শুনেছিলাম সেই স্মৃতিচারণা—’লং অনে মাইকেল হোল্ডিং ক্যাচটা নিয়েছিল। ব্যাটসম্যান ছিল (ইয়ান) রেডপাথ।' উদ্যাপন-টুদ্যাপন কেমন হয়েছিল? গিবস একটা হাসি দিয়ে বলেছিলেন, 'আমাদের দলের এক খেলোয়াড় মাঠে শ্যাম্পেন নিয়ে এসেছিল। আমি একটা চুমুকও দিয়েছিলাম। এ জন্য পরদিন বেচারাকে আদালতে যেতে হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ায় কী যেন একটা আইন ছিল তখন।’
একটা টীকা অবশ্য এখানে আবশ্যিক মনে হচ্ছে। ল্যান্স গিবস নিজে আমাকে বলেছেন, তাঁর ৩০৮তম ক্যাচটা উঠেছিল লং অনে। ক্রিকইনফোর ‘অন দিস ডে’–তে কিন্তু লং অফ লেখা। গিবসের কথাতেই আস্থা রাখা উচিত সিদ্ধান্ত নিয়েও উইজডেন ক্রিকেটার্স অ্যালম্যানাকে ওই টেস্টের ম্যাচ রিপোর্টে একটা ঢুঁ মারলাম। সেখানে আবার লেখা, হোল্ডিং ক্যাচটা নিয়েছিলেন ডিপ মিডউইকেটে! মহা মুশকিল তো! আচ্ছা, বাদ দিই। লং অন, লং অফ, না ডিপ মিড উইকেট—এই তর্কের মীমাংসা এই লেখায় খুব জরুরি নয়।
মেলবোর্নের ওই টেস্টটাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ল্যান্স গিবসের শেষ উপস্থিতি। রেকর্ড ভাঙা উইকেটের পর আরেকটি উইকেট নিয়েছিলেন। তাঁর ৩০৯ উইকেটের রেকর্ড পাঁচ বছরও টেকেনি। ডেনিস লিলি রেকর্ডটা ভেঙে দেওয়ার সময় কি আফসোস হয়েছিল, আরও কিছুদিন খেলে গেলেই হতো! গিবস হেসে তাঁর হাতটা সামনে মেলে ধরেছিলেন। বল স্পিন করাতে করাতে তর্জনী বেঁকে গেছে, মধ্যমারও একই অবস্থা। গিবসের কথা মনে হলেই ওই হাতটা চোখ ভাসে।
৩১ জানুয়ারি ধরে ক্রিকেট ইতিহাসে পিছিয়ে গিয়ে খুঁজলে এমন ক্রিকেটীয় স্মৃতি আরও অনেক আছে। তবে ২০১০ সালের ৩১ জানুয়ারি এই দিনে পার্থে যা ঘটেছিল, তার তুলনা ক্রিকেট ইতিহাসে নেই। অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তান ওয়ানডে ম্যাচে টেলিভিশন ক্যামেরা হঠাৎ আবিষ্কার করল, একজন ক্রিকেটার 'ক্ষুধা' সহ্য করতে না পেরে বলে কামড় বসিয়েছেন। ক্রিকেট বলের অনেক ব্যবহার হয়েছে, তবে ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য এটাই প্রথম। ওই শক্ত গোলকটা যে এতটা উপাদেয়, তা শহীদ আফ্রিদির আগে কেউ বুঝতেই পারেননি। পরেও নয়। বল টেম্পারিংয়ে এর আগে-পরে হাতের নখ, বোতলের ছিপি, সিরিশ কাগজ...কত কিছুর ব্যবহারই না হয়েছে, তবে নিজের দাঁতের ব্যবহার সম্ভবত এই একবারই। কেমন দল অন্তঃপ্রাণ ক্রিকেটার, ভাবা যায়!
ঘটনাচক্রে শহীদ আফ্রিদি আবার সেই ম্যাচে পাকিস্তানের অধিনায়ক। ঘটনাচক্রে; কারণ, নিয়মিত অধিনায়ক মোহাম্মদ ইউসুফ খেলতে পারেননি বলে সেই দায়িত্ব চেপেছিল তাঁর কাঁধে। পাকিস্তান আবার সেই ওয়ানডে সিরিজের প্রথম চার ম্যাচেই হেরেছে। পঞ্চম ম্যাচে বল কামড়েও পাকিস্তানকে জেতাতে পারেননি আফ্রিদি। উল্টো দুই টি–টোয়েন্টির জন্য নিষিদ্ধ হতে হয় তাঁকে।
আফ্রিদির ওই কাণ্ডের চেয়ে এ নিয়ে এক ওয়েবসাইটে প্রকাশিত কার্টুনটাও কম মজাদার নয়। কী ছিল সেই কার্টুনে? টেলিভিশনে আফ্রিদিকে বল 'খেতে' দেখে সে সময়কার পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী আসিফ আলী জারদারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে ফোন করেছেন, ‘ওবামাজি, আরও কিছু ফান্ড পাঠান। আমাদের মানুষজন অনাহারে আছে এবং ক্রিকেট বল খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে।’