বিসিবি সভাপতি থেকে যাচ্ছেন নাজমুল হাসানই
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় অনেক বছর পর একজন পূর্ণ মন্ত্রী পেয়েছে। মন্ত্রিত্ব পেয়ে নাজমুল হাসান নিয়মিত অফিসও করা শুরু করেছেন মন্ত্রণালয়ে। সঙ্গে সপ্তাহে অন্তত একদিন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে বসবেন, গতকাল বিভিন্ন ফেডারেশন কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের খেলার হালহকিকত জেনেছেন, নতুন স্টেডিয়াম বানানোর চেয়ে মাঠ তৈরিতে জোর দেবেন, বর্তমান স্টেডিয়ামগুলোর সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ করবেন—সবই আছে মন্ত্রীর কর্মপরিকল্পনায়।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে নাজমুল হাসানকে বুঝি মিস করতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। বিসিবি সভাপতি এখন গোটা দেশের খেলাধুলার দায়িত্বে। তাঁর দৃষ্টিটা এখন অন্য সব খেলায়ও ছড়িয়ে যাবে বলে বিসিবি শঙ্কিত হতেই পারে, ক্রিকেটের প্রতি নাজমুলের দৃষ্টিটা না আবার সরু হয়ে আসে!
বাস্তবে সেটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর নাজমুল হাসান যদিও বলেছেন, যত দ্রুত সম্ভব ক্রিকেট বোর্ডের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চেষ্টা করবেন; সেটি আপাতত হচ্ছে না বলেই জানা গেছে। নাজমুল হাসানের নেতৃত্বাধীন বিসিবির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৫ অক্টোবর পর্যন্ত। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নাজমুল হাসানও তত দিনই বিসিবির সভাপতির পদে থাকবেন। ২০২৫ সালের ৫ অক্টোবর বিসিবির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ শেষ হবে। এরপর হবে নতুন নির্বাচন। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে কাউন্সিলরদের ভোটে নির্বাচিত বোর্ড পরিচালকদের মধ্য থেকে পরিচালকেরা নতুন সভাপতি নির্বাচন করবেন, এটাই আছে বিসিবির গঠনতন্ত্রে। তার আগ পর্যন্ত নাজমুল হাসানই বিসিবি সভাপতি।
তখন অবশ্য শুধু সভাপতি পদে নয়, বিসিবির পুরো পরিচালনা পর্ষদেই আসতে পারে বড়সড় পরিবর্তন। নাজমুল হাসানের সঙ্গে তখন বিদায় নিতে পারেন অনেক বছর ধরে দেশের ক্রিকেট প্রশাসনে সম্পৃক্ত বর্তমান অনেক জ্যেষ্ঠ পরিচালক। নতুন করে বোর্ড পরিচালক হওয়ার দৌড়ে তাঁদের অনেকেই হয়তো নামবেন না। কয়েকজন জ্যেষ্ঠ পরিচালকের মধ্যে হওয়া মৌখিক আলোচনা সেরকমই বলে জানা গেছে। নিজেরা সরে গিয়ে বিসিবিতে নতুন মুখ আসার পথ আরও প্রশস্ত করে দেবেন তাঁরা। সদ্য ‘সাবেক’ বা বর্তমান ক্রিকেটারদের কেউও যদি ততদিনে ‘সাবেক’ হয়ে যান, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিসিবির পরিচালনা পর্ষদে তখন তাঁদেরও দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
কিন্তু যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী হয়ে যাওয়ার পর তত দিনই বা কেন বিসিবি সভাপতি পদে থাকবেন নাজমুল হাসান? গঠনতান্ত্রিক বাধা যদিও নেই, ক্রীড়া মন্ত্রী হয়েও একটা ক্রীড়া ফেডারেশনের সভাপতি থেকে যাওয়া স্বার্থের সংঘাত তো সৃষ্টি করতেই পারে। ১২ বছর ধরে তিনি বিসিবির সভাপতি, আবাহনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার সুবাদে ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক তারও আগে থেকে। বিসিবি সভাপতির দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে মন্ত্রিত্ব করলেও ক্রিকেটের প্রতি নাজমুল হাসানের এক ধরনের দুর্বলতা থাকাটাই স্বাভাবিক। আর যদি বিসিবি সভাপতি থেকেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব চালান, সেটা হয়ে পড়বে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
বিসিবিতে নাজমুলের পরিচালনা পর্ষদের অন্য সদস্যরা অবশ্য মনে করেন না তাঁদের সভাপতি ক্রীড়া মন্ত্রী হয়েছেন বলে ক্রিকেট কোনো বাড়তি সুবিধা পাবে। সরকারের কাছ থেকে বিসিবি এমনিতেও কোনো আর্থিক সহযোগিতা নেয় না বলেই সেই সুযোগ নেই বলে দাবি তাঁদের। মন্ত্রী নাজমুল হাসান বিসিবি সভাপতি থেকে গেলেও তাই তাঁরা কোনো সমস্যা দেখছেন না। বরং উল্টো ভাবনা আছে। এই মুহূর্তে হঠাৎ নেতৃত্বে পরিবর্তন এলে বিসিবির চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি এবং আইসিসি ও অন্যান্য দেশের ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে বিসিবির কূটনৈতিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে শঙ্কা বোর্ডের।
পূর্বাচলে শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় নতুন ক্রিকেট মাঠ তৈরি ও মাঠের জন্য জমি কেনার প্রকল্পে হাত দিয়েছে বিসিবি। এসব প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়নের জন্য হলেও বিসিবির পরিচালকেরা চান অন্তত চলতি মেয়াদ পর্যন্ত সভাপতির পদে নাজমুল হাসানই থেকে যান। বিসিবির পরিচালক জালাল ইউনুস বলেছেন, ‘আমরা চাই বোর্ড সভাপতি হিসেবে তিনি তাঁর বর্তমান মেয়াদ শেষ করে যান। দেশের ক্রিকেটের উন্নয়নে বর্তমান বোর্ড যেসব পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য হলেও তাঁকে বোর্ডে দরকার।’ আরেক পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলমেরও একই কথা, ‘যে কোনো কিছুতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেহেতু গঠনতান্ত্রিক কোনো বাধা নেই, এখানেও সেটিই হওয়া উচিত।
বিসিবির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্য কয়েকজন পরিচালকেরও একই মত। তাঁদের দুই-একজনের কথায় অবশ্য এর অন্য কারণও খুঁজে পাওয়া গেছে। নাজমুল হাসান সভাপতিত্ব ছেড়ে দিলে বিসিবির শীর্ষ পর্যায়ে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে, সেটা অস্বস্তি ছড়াবে পুরো পরিচালনা পর্ষদে। কারণ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এরপর পরিচালকদেরই ভোটাভুটি করে তাদের মধ্য থেকে ঠিক করতে হবে পরবর্তী বোর্ড সভাপতি। বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ যেহেতু আর দুই বছরেরও কম সময় বাকি, এই সময়ের জন্য নিজেদের মধ্যে লড়তে চান না দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে কাজ করা এই পরিচালকেরা। তাঁরা মনে করেন, অন্য পথ যেহেতু নেই, নাজমুল হাসানই সভাপতি থেকে গেলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিটা এড়ানো যায়।
শুধু ক্রিকেট বোর্ড নয়, বোর্ডের বাইরে থাকা ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের ভাবনাও একইরকম। বিসিবির সাবেক পরিচালক ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন বলেছেন, ‘যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী হলেও যদি তিনি বিসিবি সভাপতি থাকা অবস্থায় অন্য খেলার উন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা রাখেন, তাহলে দুটো দায়িত্ব এক সঙ্গে পালনে আমি কোনো সমস্যা দেখি না।’ অন্য দেশের সঙ্গে ক্রিকেট কূটনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং আইসিসির সঙ্গে দীর্ঘ সংশ্লিষ্টতার কারণেও হুট করে নাজমুল হাসানের বিসিবি সভাপতির দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না বলে মনে করেন গাজী আশরাফ।
এ ক্ষেত্রে নাজমুল হাসানের জন্য তাঁর একটা পরামর্শও আছে, ‘আবাহনী থেকে শুরু করে ক্রিকেট বোর্ডেও লম্বা সময় ধরে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর পক্ষে হঠাৎ করে ক্রিকেট থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সহজ হবে না। কিন্তু যেহেতু তিনি এখন দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবক, অন্য খেলার ফেডারেশনগুলোর মধ্যে যেন এটা কাজ না করে যে তিনি শুধু ক্রিকেটের লোক, সেদিকে তাঁকে চোখ রাখতে হবে। অন্য খেলার উন্নয়নেও সমানভাবে কাজ করতে হবে।’
ক্রিকেট বিশ্লেষক ও কোচ নাজমুল আবেদীন নাজমুল হাসানের বোর্ড সভাপতি থেকে যাওয়াটাকে দেখছেন দুইভাবে। ‘বিসিবি একটিমাত্র খেলার ফেডারেশন, অন্যদিকে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিসিবিসহ সব ফেডারেশন। সে ক্ষেত্রে ক্রীড়া মন্ত্রীর একটা নির্দিষ্ট ফেডারেশনের সভাপতি হওয়াটা স্বার্থের সংঘাত তো তৈরি করেই’—কথাটা বলেই তিনি যোগ করেছেন, ‘…তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁকে (নাজমুল হাসান) যতটা চিনি বা জানি, উনি নিশ্চয়ই চেষ্টা করবেন স্বার্থের সংঘাতটা যেন তৈরি না হয়। সাংগঠনিক পর্যায়ে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সব খেলার উন্নয়নের জন্যই তিনি কাজ করবেন। আমার বিশ্বাস তিনি বিসিবি প্রধান ও ক্রীড়া মন্ত্রী হিসেবে নিজের কাজে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবেন।’
ক্রীড়া মন্ত্রী হওয়ার পর নাজমুল হাসানেরর বিসিবি সভাপতির পদ ছেড়ে দেওয়া উচিত কি না জানতে চাইলে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ বলেছেন, ‘এমন নয় যে বিসিবির অন্য পরিচালকদের সভাপতি হওয়ার যোগ্যতা নেই। কিন্তু বিসিবি প্রধান হিসেবে পাপন ভাইয়ের (নাজমুল হাসান) অবস্থান সব পর্যায়ে যতটা শক্ত, অতটা হয়তো অন্যদের হবে না। ক্রিকেটের ভালোর জন্যই তাই ওনার সভাপতি থাকা উচিত।’ আর স্বার্থের সংঘাতের বিষয়টি মাসুদ ছেড়ে দিয়েছেন নাজমুল হাসানের ওপর, ‘এটা নির্ভর করবে উনি যখন যে চেয়ারটায় বসবেন, সেটার মর্যাদার প্রতি সম্মান দেখানোর ওপর। ক্রিকেটের লোক বলে উনি যদি বিসিবির প্রতি দুর্বল থাকেন, তাহলে তো অবশ্যই সংঘাত তৈরি হবে। ক্রীড়া মন্ত্রী হিসেবে তিনি যদি ক্রিকেট সহ সব ফেডারেশনকে একই চোখে দেখেন, নিরপেক্ষ থাকেন তাহলে আর সমস্যা কোথায়?’
নাজমুল হাসান বিসিবি সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন আগে এবং সরকারের মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন পরে। মন্ত্রী হওয়ার পরও তাঁর বোর্ড সভাপতি থাকায় আইসিসি থেকেও তাই কোনো বাধা নেই। বিসিবির পরিচালকদের তাই সর্বসম্মত অলিখিত সিদ্ধান্ত—বোর্ড সভাপতি হিসেবে চলতি মেয়াদ পর্যন্ত তাঁরা নাজমুল হাসানকেই ধরে রাখবেন। আর ক্রিকেট থেকে সরে যাওয়ার ইচ্ছা যেহেতু নাজমুল হাসানেরও আপাতত নেই, অন্তত ২০২৫ সালের ৫ অক্টোবর পর্যন্ত তিনিই থেকে যাচ্ছেন ‘বিসিবি বস’।