ম্যাথুসের ‘টাইমড আউট’ নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিল এমসিসি
৬ নভেম্বর বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা–বাংলাদেশ ম্যাচে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ‘টাইমড আউট’ হন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস। এ নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে। পক্ষে–বিপক্ষে এখনো কথা হচ্ছে। ক্রিকেটীয় চেতনাকে সামনে টেনে এনে কেউ কেউ কাঠগড়ায় তুলেছেন ম্যাথুসের বিপক্ষে ‘টাইমড আউট’–এর আবেদন করা বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে। অনেকে আবার সাকিবের পক্ষ নিয়ে বলছেন, আউটটি যেহেতু আইনসিদ্ধ, তাই এতে সাকিবকে দোষারোপের কিছু নেই। ক্রিকেটের আইন প্রণয়নকারী সংস্থা মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি) এ নিয়ে আজ বিশদ ব্যাখ্যাসহ বিবৃতি দিয়েছে।
এমসিসি বিবৃতির আগে ‘টাইমড আউট’ হওয়ার নিয়মটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি এটাও মনে করিয়ে দিয়েছে, ম্যাথুস ফিল্ডিং দলের আবেদনের ভিত্তিতে আউট হন। সাদিরা সামারাবিক্রমা আউট হওয়ার পর লঙ্কান অলরাউন্ডার উইকেটে এসে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সাকিবের পরের ডেলিভারিটি খেলার জন্য প্রস্তুত হতে পারেননি। ক্রিকেটের আইনের ৪০.১.১ ধারায় টাইমড আউটের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে এমসিসি, ‘উইকেট পতনের পর কিংবা ব্যাটসম্যান অবসর নেওয়ার পর মাঠে আসা ব্যাটসম্যানকে কিংবা অন্য ব্যাটসম্যানকে পরের বলটা খেলার জন্য ৩ মিনিটের মধ্যে প্রস্তুতি সারতে হবে। এই শর্ত পূরণ না হলে মাঠে আসা ব্যাটসম্যানটি আউট হবেন, টাইমড আউট।’
এমসিসি মনে করিয়ে দিয়েছে, বিশ্বকাপের ম্যাচটি আইসিসির আন্তর্জাতিক ওয়ানডে প্লেয়িং কন্ডিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে এমসিসির আইনের ওপর আইসিসির প্লেয়িং কন্ডিশন প্রাধান্য পাবে। আইসিসির প্লেয়িং কন্ডিশনে ২ মিনিটের মধ্যে পরবর্তী বল খেলতে প্রস্তুত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া এই আইনের বাকি বিষয়গুলো একই।
এমসিসি এরপর ব্যাখ্যা করেছে, এই আইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ব্যাটসম্যানকে ‘বলটা খেলতে অবশ্যই প্রস্তুত হতে হবে।’ এমসিসি এরপর স্পষ্ট করে বলেছে, ‘বেঁধে দেওয়া ২ মিনিট সময়ের মধ্যে ম্যাথুস বল খেলতে প্রস্তুত ছিলেন না।’ হেলমেট নিয়ে সমস্যায় পড়ায় দেরি হয়েছে। তবে ম্যাথুস কীভাবে টাইমড আউট হওয়া এড়াতে পারতেন সেটাও ব্যাখ্যা করেছে এমসিসি, ‘নির্ধারিত ২ মিনিটের মধ্যে আম্পায়ারদের যদি জানানো হতো যে সরঞ্জামে সমস্যাজনিত যৌক্তিক কোনো কারণে দেরি হচ্ছে, তখন তাঁরা (আম্পায়ার) এটিকে নতুন ধরনের দেরি (যেমন ব্যাট ভেঙে যাওয়া) হিসেবে দেখতেন, এমনকি বিরতিও দিতে পারতেন। তখন দেরিটা যৌক্তিক হয়ে যেত এবং ব্যাটসম্যানও টাইমড আউট হওয়ার ঝুঁকিতে পড়তেন না। এমসিসি এর পাশাপাশি এটাও মনে করিয়ে দিয়েছে, ২ মিনিট সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর দুই আম্পায়ারই নিশ্চিত হয়েছেন যে দেরি হয়েছে। তবে (ফিল্ডিং দলের) আবেদনের আগ পর্যন্ত এটা বিবেচনা করা হয়নি।
সামারাবিক্রমা আউট হওয়ার পর ম্যাথুসের মাঠে আসার ঘটনার বিবরণও দিয়েছে এমসিসি, ‘(মাঠে) ৩০ গজ বৃত্তের মধ্যে ঢুকতে ৯০ সেকেন্ডের বেশি সময় নিয়েছেন ম্যাথুস। এরপর যখন বুঝতে পেরেছেন দেরি করে ফেলেছেন, তখন খানিকটা দৌড়ে উইকেটে এসেছেন। আগের উইকেট পতনের পর ঠিক ১ মিনিট ৫৪ সেকেন্ডের মাথায় ম্যাথুস হেলমেটের সমস্যাটা বুঝতে পারেন। সে সময় তিনি উইকেটে গার্ড (স্ট্যান্স) নেননি এবং বল খেলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। হেলমেটের সমস্যা ধরতে পারার পর ম্যাথুস আম্পায়ারদের সঙ্গে কথা বলেননি—সরঞ্জাম পাল্টাতে চাইলে একজন খেলোয়াড়ের কাছে প্রত্যাশিত আচরণ হলো তিনি আম্পায়ারকে জানাবেন। সেটা না করে তিনি ড্রেসিংরুমে ইঙ্গিত করেন হেলমেট পাল্টানোর। তিনি যদি আম্পায়ারকে সমস্যাটা বলতেন এবং একটু সময় চাইতেন, তাহলে তাঁরা (আম্পায়ার) তাঁকে হেলমেট পাল্টানোর অনুমতি দিতেন, তখন হয়তো বিরতি দেওয়া হতো এবং তাতে টাইমড আউট হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই থাকত না।
যেহেতু বিরতি নেওয়া হয়নি এবং ২ মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পর আউটের আবেদন করা হয়েছে, তাই ম্যাথুসকে আম্পায়ারদের আউট ঘোষণা করার সিদ্ধান্তটি সঠিক। আইনসিদ্ধভাবে এ ছাড়া আর কোনো রাস্তা ছিল না।
ম্যাথুস টাইমড আউট হওয়ার পর কিছু প্রশ্ন পেয়েছে এমসিসি। সেগুলো নিয়ে তাদের উত্তরসহ ব্যাখ্যা নিম্নরূপ—
—টাইমড আউট আইনের কী প্রয়োজন?
এই আইন ছাড়া উইকেট পতনের পর ব্যাটসম্যান সময় নষ্ট করতে পারেন। সময়মতো ক্রিজে না–ও আসতে পারেন। সময়ের হিসাব রাখা হয়—এমন ক্রিকেটে এই বিষয়গুলো সমস্যা তৈরি করতে পারে। যেমন (মাঠে) আলো কমে আসছে কিংবা ড্রয়ের সম্ভাবনা জেগেছে এমন মুহূর্তে। তবে সংক্ষিপ্ত সংস্করণের ক্রিকেটেও আইনটি প্রাসঙ্গিক। স্লো ওভাররেটের কারণে ফিল্ডিং দলগুলোকে প্রায়ই জরিমানা গুনতে হয়। হতে পারে সময় নষ্ট করা কারও উদ্দেশ্য নয়, তবু খেলাটাকে গতিশীল রাখতে এবং উইকেট পতনের পর দেরি যেন না হয়, তা নিশ্চিত করতে এই আইন প্রয়োজন।
—টাইমড আউট নিয়মে সরঞ্জামজনিত সমস্যায় কি আলাদা করে সময় বরাদ্দ দেওয়া উচিত?
এমসিসি সব সময়ই ক্রিকেটের আইন পরিমার্জনা করে থাকে। আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই আইনটি (টাইমড আউট) এর আগে কখনোই মাঠে ফলানো হয়নি, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেই মাত্র ছয়বার এমন ঘটনা ঘটেছে। এতে বোঝা যায়, এই মুহূর্তে নিয়মটা পাল্টানো আবশ্যক কিছু নয়। এ ছাড়া আম্পায়ারা যদি মনে করেন উইকেট পতনের পরের সময়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়, এমন কোনো কারণে দেরি হয়েছে, তাহলে তাঁরা অবশ্যই সময় নিতে পারেন, চাইলে বিরতিও ডাকতে পারেন—খেলায় বিঘ্ন ঘটলে এমনিতেই এটা করা হয়। এসব পরিস্থিতিতে একজন ব্যাটসম্যান টাইমড আউট হন না।
—ক্রিকেটের চেতনার কী ভূমিকা?
২০২২ সালে লর্ডসে ইংল্যান্ড–ভারত মেয়েদের ওয়ানডেতে চার্লি ডিনকে রানআউট করেছিলেন দীপ্তি শর্মা। এরপর এমসিসি একটি বিবৃতি দিয়েছিল যেখানে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদটি আছে—
‘ক্রিকেট হলো নানা মতের খেলা, যে চেতনার ওপর ভিত্তিতে এটি খেলা হয় সেগুলোও আলাদা নয়। ক্রিকেটের চেতনার ধারক ও বাহক হিসেবে এমসিসি এটা প্রশংসা করে যে বিশ্বের আনাচকানাচ এটা নিয়ে বিতর্ক হয় এবং তা চলাই উচিত। কেউ হয়তো মনে করছে বোলার অন্যায্য সুবিধা পাচ্ছে, কেউ আবার বলছেন, নন স্ট্রাইকার ক্রিজে আগেই ছেড়ে গিয়ে অন্যায্য সুবিধাও নিচ্ছেন। এই ম্যাচের (ভারত–ইংল্যান্ড) শেষটা স্বাভাবিক না হলেও উত্তেজনাকর ছিল। ম্যাচটা খুব ভালোভাবে পরিচালনা করা হয়েছে, এর চেয়ে আর বেশি কিছু ভাবা উচিত নয়।’
এই বিবৃতির উদ্দেশ্য হলো সবাইকে এটা জানিয়ে দেওয়া, ক্রিকেটীয় চেতনার মালিক শুধু একজন খেলোয়াড়, একটি দেশ কিংবা শুধু একটি সংস্কৃতি নয়। আর খেলাটা খেলা হয় বিশ্বের আনাচকানাচ যেখানে মতের পার্থক্য থাকাই স্বাভাবিক। ক্রিকেটীয় চেতনার মূলে রয়েছে সম্মানবোধ এবং ন্যায্য খেলা। তবে এসব নিয়ে মতের পার্থক্য হওয়াটাও প্রত্যাশিত। কারও কাছে যেটা গ্রহণযোগ্য, সেটা অন্য কারও কাছে আবার অগ্রহণযোগ্য।
এমন অনেক সময় আছে যখন খেলোয়াড়েরা আউট করেন না, আবেদন করেন না কিংবা আবেদন তুলেও নেন। এমন সব সিদ্ধান্তের জন্য আইনের ছায়াতল আছে। আর আইনের অধীনে কিংবা ক্রিকেটীয় চেতনায় এগুলো বাধ্যতামূলকও নয়, তবু ফিল্ডিং দলের অধিনায়ক অনেক সময় আবেদন প্রত্যাহার করে নেন। এমন মুহূর্তগুলোকে ক্রিকেটীয় চেতনার ইতিবাচক উদাহরণ হিসেবেও তুলে ধরা হয়।
২০২২ ক্রিস্টোফার মার্টিন–জেনকিন্স স্পিরিট অব ক্রিকেট পুরস্কার এর ভালো উদাহরণ হতে পারে। রান নিতে গিয়ে নেপালের বোলার কামাল এইরির পায়ের সঙ্গে লেগে পড়ে গিয়েছিলেন আয়ারল্যান্ডের ব্যাটসম্যান অ্যান্ডি ম্যাকব্রাইন। নেপালের উইকেটকিপার আসিফ শেখ এ জন্য তাঁকে রানআউট করেননি। আসিফ তাঁকে রানআউট করলে সেটি কিন্তু আইনসিদ্ধই হতো। কেউ বলতে পারত না, তিনি চেতনাবিরোধী কাজ করেছেন। কিন্তু তিনি এমন একটা পথ বেছে নিয়েছিলেন, যে কারণে সবাই তাঁর স্তুতি গেয়েছেন।
আইন এবং প্লেয়িং কন্ডিশন খেলাটিকে পরিচালনা করে ঠিক যেভাবে বিভিন্ন আইন দ্বারা সমাজ পরিচালিত হয় এবং বিভিন্ন খেলাও পরিচালিত হয়। আর এসব নিয়মের বাস্তবায়ন নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হবে এবং প্রশ্নও উঠবে। আর এমন পরিস্থিতিতিতে খেলাটা কীভাবে খেলবেন, সেটা ঠিক করার দায়িত্ব খেলোয়াড়দের।